সাম্প্রদায়িকতার উস্কানি ‘লা গোবরিনা ফেস্ট’

ডিসেম্বর ১১, ২০১৯

ভারত ভেঙ্গে ইসলামি প্রজাতন্ত্র পাকিস্তান গড়ার শীর্ষ নেতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ তার পাশ্চাত্য শিক্ষার কারণে জীবন চর্যায় অসাম্প্রদায়িক ছিলেন। কিন্তু কেবল নিজের মন দিয়ে হয়তো ভারতকে বুঝতে চেষ্টা করেননি; চেষ্টা করেছেন হিন্দু ও মুসলমান সমাজটিকে ‘এজ ইট ইজ’ বুঝতে। সে কারণেই মুসলমানদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র গড়েছিলেন। এতে করে সাম্প্রদায়িক একটি রাষ্ট্র হিসেবে ‘এজ ইট ইজ’ পাকিস্তানকে দেখা গেছে সাতটি দশক। পাকিস্তানকে ঘিরে কোন প্রত্যাশা তৈরি হয়নি দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের মনে। যে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে ‘ভারত’কে ঘিরে।

ভারত বিভাজিত হবার কালে ভারতের শীর্ষ নেতা জওহরলাল নেহেরু ‘অসাম্প্রদায়িক’ ভারতের অঙ্গীকার করেছিলেন। নেহেরুর মনোজগত পাশ্চাত্য শিক্ষা ও জীবন-চর্যার সংস্পর্শে অসাম্প্রদায়িক ছিলো। তিনি কেবল নিজের মন দিয়ে ভারতকে বুঝতে চেষ্টা করেছিলেন। ভুলটা সেখানেই ছিলো।

ভারত ভেঙ্গে ইসলামি প্রজাতন্ত্র পাকিস্তান গড়ার শীর্ষ নেতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ তার পাশ্চাত্য শিক্ষার কারণে জীবন চর্যায় অসাম্প্রদায়িক ছিলেন। কিন্তু কেবল নিজের মন দিয়ে হয়তো ভারতকে বুঝতে চেষ্টা করেননি; চেষ্টা করেছেন হিন্দু ও মুসলমান সমাজটিকে ‘এজ ইট ইজ’ বুঝতে। সে কারণেই মুসলমানদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র গড়েছিলেন। এতে করে সাম্প্রদায়িক একটি রাষ্ট্র হিসেবে ‘এজ ইট ইজ’ পাকিস্তানকে দেখা গেছে সাতটি দশক। পাকিস্তানকে ঘিরে কোন প্রত্যাশা তৈরি হয়নি দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের মনে। যে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে ‘ভারত’কে ঘিরে।

১৯৪৭ সালে নেহেরুর কল্পিত ‘অসাম্প্রদায়িক ভারত’-এর ধারণাটি অবশ্য ভারতকে বিশ্ব দরবারে সম্মানিত করেছে। এই সেক্যুলার ব্র্যান্ডিং ভারতকে বিশ্ববাজারে ও বিশ্বপ্রজ্ঞার আসরে অনেক এগিয়ে দিয়েছে। এতে বোঝা যায়, নেহেরুর ইনসেপশান ভারতের মনীষার জগতে সত্যি সত্যিই ‘অসাম্প্রদায়িকতা’-র স্বপ্ন জারিত করতে সক্ষম হয়েছিলো।

কিন্তু নেহেরুর আশেপাশেই অস্বস্তি চেপে কংগ্রেসের অসাম্প্রদায়িকতার মুখোশ পরে বসে থাকা হিন্দুত্ববাদীরা অপেক্ষা করেছে ‘হিন্দু ভারত’-এর উত্থানের; অনুকূল সময়ের যখন তারা প্রকাশ্যে গেরুয়ার ঝান্ডা ওড়াতে পারবে।

আজো ভারতের প্রত্যন্ত গ্রামে গোবর ছুঁড়ে আনন্দ উদযাপনের চল রয়েছে। এ হচ্ছে দক্ষিণ এশিয় সংস্কৃতি ও সভ্যতার ‘লা গোবরিনা ফেস্ট’। ব্যক্তি অন্য ব্যক্তির দিকে, এক ধর্মের লোক আরেক ধর্মের লোকের দিকে, এক রাজনৈতিক দলের সমর্থক অন্য রাজনৈতিক দলের সমর্থকদের দিকে গোবর ছোঁড়ার বিনোদন দক্ষিণ এশিয়ার আদি ও অকৃত্রিম সাংস্কৃতিক ধারা।

নেহেরু এই লা গোবরিনা ফেস্টের লোকেদের ‘অসাম্প্রদায়িক’ বানানোর চেষ্টা করেছেন। এই রোমান্টিসিজম বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়, গল্পকার সাদাত হাসান মান্টো, কবি ফায়েজ আহমেদ ফায়েজ, কথা-সাহিত্যিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, পণ্ডিত সৈয়দ মুজতবা আলী হয়ে দক্ষিণ এশিয়ার অল্প সংখ্যক কিছু মানুষের মনে বসত গড়েছে।

অসাম্প্রদায়িকতার স্বপ্ন তাড়িত আরেক রাজনৈতিক নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ’-এর অঙ্গীকার নিয়ে দেশটির স্বাধীনতার নেতৃত্ব দেন।
এই অসাম্প্রদায়িকতার ধারণা অনেক আগেই দক্ষিণ এশিয়ার বাউল ও সুফি সাংস্কৃতিক ধারায় তৃণমূলের মানুষের কাছে পৌঁছেছিলো। কিন্তু জনমানুষের বিভাজনের নেশার কারণে সে সংস্কৃতি টেকসই হয়নি জনজীবনে।

খেটে খাওয়া মানুষের চিন্তা করার সময় নেই কে হিন্দু-কে মুসলমান তা দেখার; কিন্তু সমাজে ক্ষমতার মিডলম্যান যারা; ধর্ম ও রাজনৈতিক অনুভূতি আর বিভাজনের ম্যানেজার যারা; তাদেরকে পারস্পরিক ঘৃণার কারখানাটি চালু রেখে লুন্ঠন করে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকতে হয়; খুন বা ধর্ষণ করে ধরা পড়লে দেশ থেকে পালিয়ে গিয়ে লুন্ঠনের পয়সায় দ্বীপ কিনে সেকেন্ড হোম গড়তে হয়। এই মিডলম্যান শ্রেণীটি যে ভাবেই হোক ধর্মীয় বা রাজনৈতিক বিভাজন ধরে রাখতে চেষ্টা করে।

ভিন্ন ধর্ম ও রাজনৈতিক আদর্শের মানুষের মিলিত হবার সম্ভাবনা দেখলেই এরা দেখবেন সোশ্যাল মিডিয়ায় এসে মনে করিয়ে দেবে, তোর জেঠুর শ্বশুরকে খুন করেছিলো ওর মেসোর ভাগ্নে; ওর সঙ্গে হাত মিলাসনে।

আপনি ভিন্ন ধর্ম-বর্ণ-গোত্র- মতের লোকের সঙ্গে হাত মেলাতে গেলে এই ঘৃণা বিক্রির মিডলম্যানেরা পেছন থেকে জাপ্টে ধরবে। এইভাবে ক্রমাগত মানুষের সম্মিলনকে প্রতিহত করতে করতে দক্ষিণ এশিয়া আজ এ জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে।

সাংস্কৃতিকভাবে একটি অত্যন্ত অনগ্রসর সমাজের কিছু সংস্কৃতি প্রিয় মানুষের প্রচেষ্টায় সমাজকে মেক-আপ পরিয়ে সংস্কৃতি সভা-টিভি-চলচ্চিত্রে হাজির করায় ইলিশানের যে জগত তৈরি হয়েছিলো ভারতকে ঘিরে; গেরুয়া বৃষ্টিতে সে মেক-আপ ধুয়ে ভারত স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করেছে।

‘অসাম্প্রদায়িকতা’-র রোমান্টিকতা এই প্রতিকূল পরিবেশে গভীর প্রেমে পরিণত হবে; এমন একটা প্রত্যাশা তবু রয়ে যায়। নাৎসি জার্মানির উত্থানের পর ঘৃণা-বিদ্বেষের আগুনে পুড়ে অপেক্ষাকৃত অহিংস, অসাম্প্রদায়িক ও সভ্য জার্মানির অভিষেক ঘটেছিলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে। দক্ষিণ এশিয়া ঘৃণা-বিদ্বেষের আগুনে পুড়েছে গত সাতটি দশকে। কিন্তু নেহেরুর ‘অসাম্প্রদায়িকতা’-র মঞ্চে বসে কংগ্রেসের প্রবীন রাজনীতিক সাম্প্রদায়িকতার মন্ত্র পাঠ করায়; দক্ষিণ এশিয়ার মানুষ এগুলোকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে ভেবেছে।

অবশেষে প্রাজ্ঞ কংগ্রেস নেতা যেদিন, হিন্দুত্ববাদী একটি অনুষ্ঠানে গিয়ে মুগ্ধতার সঙ্গে যজ্ঞে অংশ নিলেন; দক্ষিণ এশিয়ার মুখমণ্ডল থেকে ‘অসাম্প্রদায়িকতা’-র মেক-আপ খসে পড়লো। ভারতকে এই প্রথম এজ ইট ইজ দেখতে পাওয়া গেলো।

এই একচুয়ালাইজেশান ভালো; নিজের শেকড়কে খুব ভালোভাবে জানা প্রয়োজন। তবে সাত-দশকে অনেক পুড়েছে দক্ষিণ এশিয়া; পোড়ার জন্য অবশিষ্ট কিছু নেই। দক্ষিণ এশিয়ার ছাই গাদায় বসে আমরা এখনো প্রতিহিংসাকে ‘মানুষের জন্য মানুষের ভালবাসা’ দিয়ে প্রতিরোধের সংকল্প করতে পারি; সভ্য দক্ষিণ এশিয়ার স্বপ্ন বিনির্মাণ করার সাহস দেখাতে পারি।