বিশ্বজিৎ আপনি মারা গেলে চলবে না; আপনাকে আমার সঙ্গে আদালতে যেতে হবে

ডিসেম্বর ১১, ২০১৯

ভদ্রলোকের মেয়ে ল্যাপটপ এনে বাবাকে বিশ্বজিৎ হত্যা মামলার বিস্তারিত দেখায়। বিস্ময়ের সঙ্গে বলে, ভিডিও ফুটেজে-স্টিল ছবিতে দেখা যাচ্ছে হরিণ শিকারীরা রড, লাঠি, ধারালো অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে ছেলেটা কীভাবে আঘাতে আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছে। পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে সে অসংখ্য ক্ষতের কথা বলা হয়েছে; এমনকী যে ডোম লাশটা তদন্তের জন্য দেখেছিলো সেও অসংখ্য ক্ষত পেয়েছিলো। কিন্তু ডাক্তার ময়না তদন্তে কেবল দুটি চাকুর আঘাত খুঁজে পায়।

বিশ্বজিৎ হত্যা মামলায় নিম্ন আদালত নৃশংস এ হত্যা মামলায় ২১ আসামির মধ্যে আট জনকে মৃত্যুদণ্ড ও ১৩ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিলেন। পরে মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের আপিল শুনানি শেষে রবিবার হাইকোর্ট দু’জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন ও ১৫ জনকে যাবজ্জীবন দেন। খালাস পাওয়া চার ছাত্রলীগ নেতা কারাগারে ছিল।

টিভিতে খবরটা শুনে এক প্রবীণ ভদ্রলোক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, যতদিন হরিণ লিখতে না শিখছে ততদিন হরিণ শিকারীরাই ইতিহাস লিখবে।

ভদ্রলোকের স্ত্রী বলেন, আস্তে বলো; দেয়ালেরও কান আছে। উন্নয়নের শত্রু হিসেবে তোমার বিরুদ্ধে ৫৭ ধারায় মামলা হয়ে যাবে। আবার মেয়ে বড় হয়েছে; এমনিতেই ভয় পাই কবে হরিণ শিকারীদের চোখে পড়ে যায়।

টিভিতে বিশ্বজিৎ হত্যা মামলার পরের খবরটাই আসে, হরিণ শিকারীরা দুজন তরুণীর শ্লীলতাহানি করেছে প্রকাশ্য কাঁচাবাজারে।

প্রবীণ ভদ্রলোক বলেন, আদালত অবশ্য দুঃখ প্রকাশ করে বলেছে, রাজনৈতিক ক্যারিয়ারকে সমৃদ্ধ করতেই হরিণ শিকারীরা অপরাধ করে। এরাই ভবিষ্যতে বড় নেতা হবে বলে ধরে নেয়া হয়।

ভদ্রমহিলা বলেন, কী দরকার ছিলো আমাদের ছেলেটাকে এতো কষ্ট করে পড়ালেখা শেখানোর। হরিণ শিকারীদের দলে ভীড়ে গেলে বোনের নিরাপত্তাটাও দিতে পারতো, আবার পরে বড় নেতাও হতে পারতো। ছেলে চাকরি করে রিটায়ারমেন্টের পর হয়তো সামান্য কিছু পেনশন পাবে। অথচ তুফান নামে একটা ছেলে হরিণ শিকারীদের দলে যোগ দিয়ে মাত্র দু’বছরে দুই কোটি টাকার মালিক হয়েছে। আবার ধর্ষণের অপরাধে গ্রেফতার হয়েছে; নিশ্চয়ই একদিন বড় নেতাও হবে।

ভদ্রলোকের মেয়ে ল্যাপটপ এনে বাবাকে বিশ্বজিৎ হত্যা মামলার বিস্তারিত দেখায়। বিস্ময়ের সঙ্গে বলে, ভিডিও ফুটেজে-স্টিল ছবিতে দেখা যাচ্ছে হরিণ শিকারীরা রড, লাঠি, ধারালো অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে ছেলেটা কীভাবে আঘাতে আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছে। পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে সে অসংখ্য ক্ষতের কথা বলা হয়েছে; এমনকী যে ডোম লাশটা তদন্তের জন্য দেখেছিলো সেও অসংখ্য ক্ষত পেয়েছিলো। কিন্তু ডাক্তার ময়না তদন্তে কেবল দুটি চাকুর আঘাত খুঁজে পায়।

ভদ্রমহিলা বলেন, এতোগুলো হরিণ শিকারী ছেলেটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো রড-ধারালো অস্ত্র নিয়ে; আর ডাক্তার পেলো মাত্র দুটি আঘাতের চিহ্ন!

ভদ্রলোক বলেন, দুটি আঘাতের চিহ্নের কারণে নিম্ন আদালতের রায় বদলে গিয়ে হাইকোর্টে মাত্র দুজনের মৃত্যুদন্ড হলো; তার মধ্যে একজন পলাতক; আরেকজন ঠিকই সাধারণ ক্ষমা নিয়ে বেরিয়ে যাবে; অথবা এর হয়তো বড় নেতা হওয়ার সম্ভাবনা নাই; তাই তার একারই মৃত্যুদন্ড হবে।

ভদ্রমহিলা ধমক দেন, তোমাকে বলেছি না আগ বাড়িয়ে কোন মন্তব্য করবে না। পাড়ার হরিণ শিকারীরা শুনে ফেললে বিপদ হবে।

–পাঁচবছরে একটি মৃতদেহের অসংখ্য ক্ষত হারিয়ে গিয়ে মাত্র দুটি ক্ষত পাওয়া গেলো; আর কিছু সময় পার হলে; বৃহত্তর তদন্তে হয়তো বলবে মৃতদেহের শরীরে কোন ক্ষতই ছিলো না।

মেয়েটি বলে, সবচেয়ে অবাক লাগছে; ভিডিও ফুটেজে, স্টিল ছবিতে পুরো হত্যা দৃশ্য দেখা যাওয়ার পরেও; উচ্চ আদালত কেন এই ময়না তদন্ত রিপোর্ট বিবেচনা করে রায় বদলালেন। আগে ময়না তদন্তকারী ডাক্তারকে আদালতে ডেকে ফুটেজ দেখিয়ে জিজ্ঞেস করতে পারতেন, এতোগুলো হরিণ শিকারী একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়েছে; গোটা শরীর রক্তাক্ত হয়ে গেছে; আর আপনি মাত্র দুটি আঘাতের চিহ্ন খুঁজে পেলেন!

ভদ্রলোক হতাশা প্রকাশ করেন, উচ্চ আদালত যেখানে বলছে, অপরাধ সংঘটিত হয়েছে তা প্রমাণিত; তাহলে সে অপরাধে কেবল দুজন মৃত্যুদন্ড পেল; চারজন খালাস পেলো; বাকীদের যাবজ্জীবন কারাদন্ড; চারজন খালাস পেল কীভাবে!

মেয়েটি বলে, নিম্ন আদালতের রায়ে ন্যায়বিচার পাওয়ার পর হরিণ শিকারীদের দলের যে ফেসবুক পিকেটাররা বড় গলা করে বলেছিলো, দেখলেন ঠিকই ন্যায়বিচার পাওয়া গেলো; আমরাই পারি; ভরসা রাখুন; এখন তারা কী বলবে!

ভদ্রলোক বলেন, তারা আর কী বলবে; সর্বাঙ্গে ব্যথা ওষুধ দেবে কোথা! তাছাড়া যতক্ষণ ময়না তদন্তে ডাক্তারের মাত্র দুটি ক্ষত চিহ্ন খুঁজে পাওয়ার রহস্য উন্মোচিত না হচ্ছে; ততক্ষণ বিচার বিভাগের ওপর দায় চাপিয়ে দিয়ে হরিণ শিকারীরা নতুন নতুন শিকারের খোঁজে বের হবে।

মেয়েটা দুঃখ করে বলে, বিশ্বজিৎ যদি আদালতে এসে সাক্ষী দিতে পারতো!

ভদ্রমহিলা বলেন, তোর কী মাথা খারাপ হয়ে গেলো মৃতদেহ কী করে আদালতে এসে সাক্ষী দেবে! আর নিম্ন আদালতে তো প্রত্যক্ষদর্শীরা এসে সাক্ষ্য দিয়েছে; তার ভিত্তিতে আট জনকে মৃত্যুদণ্ড ও ১৩ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছিলো। কিন্তু ডাক্তারের ময়না তদন্তের ওপর ভিত্তি করে তদন্ত কর্মকর্তা যে প্রতিবেদন দিয়েছে, তার প্রেক্ষিতেই উচ্চ আদালত দু’জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন ও ১৫ জনকে যাবজ্জীবন দেন। চারজন খালাস পেয়ে যায়।

ভদ্রলোক দুঃখ করে বলেন, বিশ্বজিৎকে বাঁচানোর জন্য আইন নেই; কিন্তু আইনের মারপ্যাঁচে বিশ্বজিৎ-এর খুনীদের বাঁচানোর ব্যবস্থা ঠিকই আছে।

হঠাতই কে যেন বলে, তবুও ভিডিও ফুটেজ আর স্টিল ছবিগুলো আছে জন্য অন্তত সবাই জানতে পারলো আমাকে প্রকাশ্যে দিনের আলোয় হত্যা করা হয়েছে। ওগুলো না থাকলে হরিণ শিকারীরা ঠিকই বলে দিতো, নো ওয়ান কিলড বিশ্বজিৎ।

সবাই বারান্দায় বেরিয়ে দেখে একটি রক্তাক্ত শরীর নিয়ে বিশ্বজিৎ দাঁড়িয়ে। ভদ্রমহিলা এগিয়ে গিয়ে বলেন, চলো বাবা তোমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাই।

-আমি তো মারা গেছি।

মেয়েটা বলে, আপনি মারা গেলে চলবে না; আপনাকে আমার সঙ্গে আদালতে যেতে হবে সাক্ষী দিতে।