বই বলে বালিশ গছিয়ে দেবার ঝুঁকি

ডিসেম্বর ৭, ২০১৯

সিজনাল লেখক ও গবেষকদের অনুভূতির কড়াইয়ে টগবগ করতে থাকা পাঁপড় ভেজাল তেলে ভাজা হয়ে থাকে। লেখালেখি ও গবেষণায় নির্ভুল হবার গুণটি রাতারাতি কেউ অর্জন করতে পারে না। আজকের এই ফেসবুকের মোটিভেশনাল স্পিকার ও ইনফ্লুয়েন্সারের যুগে বইয়ের প্রচ্ছদ-লেখকের ছবি-সংস্কৃতি মামার লিখে দেয়া ভূমিকা হবে অনেক আকর্ষণীয়। ডিজাইনার গুচি ব্যাগের পাঁচ নম্বর নকল সংস্করণের মতো সব্বোনেশে সে আকর্ষণ।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মানুষ সিজনাল ব্যবসাগুলো খুব ভালো বোঝে। ঈদের সময় কোচগুলো দীর্ঘ সময় জ্যামে দাঁড়িয়ে থাকে; এটা বুঝে গ্রামবাসী কলসিতে করে পানি এনে বা ইদানিং পানির বোতল বিক্রি করে। কোথাও কোন দুর্ঘটনা ঘটলে বাদাম ও শসাওয়ালারা চলে আসে দুর্ঘটনা দেখতে আসা দর্শকদের সময় কাটানোকে আরো আনন্দঘন করতে।

দেশে ধর্মীয় চেতনার নহর বইলে; জনগণের মধ্যে ধর্মীয় অনুভূতির জোয়ার আসলে, পাঠক ও সরকার কিছু বই-পুস্তক কিনবে এটা অনুভূত হলে কিছু লোক ধর্মীয় বই-পুস্তক লিখতে লেগে পড়ে।

দেশে দেশপ্রেম চেতনার নহর বইলে, জনগণের মাঝে দেশপ্রেম অনুভূতি বেড়ে গেলে, পাঠক ও সরকার কিছু বই-পুস্তক কিনবে; এটা অনুভূত হলে কিছু লোক দেশপ্রেমমূলক বই-পুস্তক লিখতে লেগে পড়ে।

বলা বাহুল্য এসব লেখক রাতারাতি গজিয়ে যায়; ১৫ দিনের গবেষণায় আস্ত একটা বই লিখে ফেলে।

বৈশাখি মেলা সামনে রেখে মুড়ি-মুড়কি, মাটির পুতুল, চিনির ছাঁচ তৈরিতে যে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা প্রয়োজন হয়; ধর্মীয় বা দেশপ্রেম মেলা সামনে রেখে ‘বই-লেখা’র ক্ষেত্রে সেরকম অভিজ্ঞতার বিন্দুমাত্র প্রয়োজন হয় না।
প্রত্ন এলাকা ঘুরতে গেলে প্রাচীন উপকথা নিয়ে নিউজপ্রিন্ট কাগজে লেখা যেসব বই-পুস্তক পাওয়া যায়; সেগুলোর মান অনেক ভালো হয়; ধর্মীয় ও দেশপ্রেম অনুভূতি নিয়ে দ্রুততার সঙ্গে লেখা বইগুলোর চেয়ে।

ধর্ম-মন্ত্রণালয়ের পুস্তক ক্রয় তালিকায় ‘গ্যাটিস’ দিয়ে একটা ধর্মীয় অনুভূতি নিয়ে লেখা বই ঢুকিয়ে দিলেই লেখক-প্রকাশকের কেল্লা ফতে। আবার শিক্ষা-সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের গ্রন্থ ক্রয় তালিকায় গ্যাটিস দিয়ে দেশপ্রেম অনুভূতি নিয়ে লেখা একটা বই ঢুকিয়ে দিলেই
লেখক-প্রকাশের কেল্লাফতে।

সামনে বঙ্গবন্ধু জন্মশতবার্ষিকী; এরপর স্বাধীনতার পঞ্চাশ বর্ষ পূর্তি আসছে। এসময় স্বাভাবিকভাবেই মানুষ বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে জানতে চাইবে। মানুষ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসভিত্তিক বই পড়তে চাইবে। বঙ্গবন্ধু আর মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানা সচেতন নাগরিকের কর্তব্য।

মেলায় বাসি তেলে ভাজা পাঁপড় ভাজা খেলে বড় জোর দুটো দিন পেটের গড়বড় থাকবে। কিন্তু ধর্ম ও দেশপ্রেম বিষয়ক বইয়ের লেখক একে বাসি তেলে ভেজে আনলে পাঠকের জানার যে গড়বড় হয়; এর প্রভাব সুদূর-প্রসারী।

খোলা-বাজারের পাঁপড় বা তেলে গোলমাল থাকলে কোন অসুবিধা নেই; কিন্তু প্রতিষ্ঠিত শপিংমলের পাঁপড় বা তেলে গড়বড় থাকলে তা প্রশ্নযোগ্য। কাজেই ধর্ম বা দেশপ্রেম নিয়ে খোলাবাজারে বিক্রি হওয়া গ্রন্থে গড়বড় থাকতে পারে। কারণ পৃথিবী যতদিন থাকবে পচা পাঁপড়, ভেজাল তেল, বানোয়াট ধর্মীয় অনুভূতি, খণ্ডিত ও বানোয়াট তথ্য সম্বলিত দেশপ্রেমমূলক গ্রন্থ বাজারে থাকবে। কিন্তু সরকার যেসব বই কেনে সেগুলোর মান পরীক্ষা করে নেয়া জরুরি। কারণ জনগণের অর্থে জনগণের সন্তানের পড়ার জন্য কেনা এ বইগুলো বিভিন্ন শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ও লাইব্রেরিতে সাজানো থাকবে।

সিজনাল লেখক ও গবেষকদের অনুভূতির কড়াইয়ে টগবগ করতে থাকা পাঁপড় ভেজাল তেলে ভাজা হয়ে থাকে। লেখালেখি ও গবেষণায় নির্ভুল হবার গুণটি রাতারাতি কেউ অর্জন করতে পারে না। আজকের এই ফেসবুকের মোটিভেশনাল স্পিকার ও ইনফ্লুয়েন্সারের যুগে বইয়ের প্রচ্ছদ-লেখকের ছবি-সংস্কৃতি মামার লিখে দেয়া ভূমিকা হবে অনেক আকর্ষণীয়। ডিজাইনার গুচি ব্যাগের পাঁচ নম্বর নকল সংস্করণের মতো সব্বোনেশে সে আকর্ষণ।

তাই সরকারের পক্ষ থেকে যেসব বই-পুস্তক কেনা হবে সেগুলো পড়ে ভেতরটা দেখে নিতে হবে। নির্ভুল কনটেন্টের বই ছাড়া আধা-খ্যাঁচড়া কোন জিনিস ‘বঙ্গবন্ধু’ ও ‘মুক্তিযুদ্ধ’-র মতো এতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে শিশুদের হাতে তুলে দেয়া ঠিক হবে না।

নীতি-নির্ধারণী মহলে একটু সিনিয়র মানুষেরা কাজ করেন। আজকের যুগে এমন সব চোখ ধাঁধানো জাদুকর টাইপের ‘চতুর’ তৈরি হয়েছে যে তারা সিনিয়ারদের কাছে আইফেল টাওয়ার বা তাজমহল বিক্রি করে দিতে পারে। তাই অত্যন্ত সাবধান থাকতে হবে ‘সরকারিভাবে বই ক্রয়ের’ ক্ষেত্রে। নইলে পরে দেখা যাবে এরা ‘বই’ বলে ‘বালিশ’ গছিয়ে দিয়েছে।