‘ডাক্তার’ আমাদের কাছের আত্মীয়

ডিসেম্বর ৪, ২০১৯

বাংলাদেশে ‘ইংলিশ মিডিয়াম’ নামের একটি উদ্ভট শিক্ষা-ব্যবস্থা রয়েছে। সন্তানকে মাতৃভাষা বাংলা ভুলিয়ে দিয়ে ফট ফট করে ইংরেজি বলা শিখিয়ে ক্যানাডা-এমেরিকা-ইংল্যান্ডের হবু নাগরিক হিসেবে তৈরিই এই মাধ্যমের কাজ। বাস্তবে যদিও সাধারণ শিক্ষা থেকে আসা ছাত্র-ছাত্রীরাই বিদেশে উচ্চশিক্ষাগ্রহণে অপেক্ষাকৃত সফল; পশ্চিমা দেশগুলোতে শ্রমে ও ঘামে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু ইংলিশ মিডিয়ামের বাহিরী চটকে আকৃষ্ট অভিভাবকরা।

মানুষের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় হচ্ছেন ডাক্তাররা। কারণ মৃত্যুশয্যায় অন্যান্য আত্মীয় কেবল আমাদের জীবনের জন্য প্রার্থনা করতে পারেন। আর ডাক্তাররা তখন তাদের দক্ষতায় আমাদের ফিরিয়ে আনতে পারেন মৃত্যুর দুয়ার থেকে।

বাংলাদেশে জনসংখ্যার তুলনায় ডাক্তারের সংখ্যা অনেক কম। সে কারণেই ডাক্তারদের পেশাগত চাপ অনেক বেশি। এর মাঝেও ডাক্তারেরা সাধ্যমত স্বাস্থ্য সেবা দিতে চেষ্টা করেন।

স্বাস্থ্যসূচকে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে। শিশু ও মাতৃ-মৃত্যুর হার সন্তোষজনকভাবে কম। পোলিও নির্মূলেও বাংলাদেশ সফল হয়েছে। পরিবার-পরিকল্পনার ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ সম্ভব অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করে রেখেছে পরিস্থিতি। মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে। সুতরাং স্বাস্থ্য-ক্ষেত্রে ডাক্তারদের সামষ্টিক অর্জন রয়েছে।

বাংলাদেশের ডাক্তারদের বিরুদ্ধে কয়েকটি অভিযোগ রয়েছে। তাদের ব্যবহার খারাপ, তাদের টাকার লোভ রয়েছে, রোগ নির্ণয় ও নির্মূলের ক্ষেত্রে দক্ষতার অভাব রয়েছে আর সরকারি ডাক্তাররা গ্রামে যেতে চান না।

এই ত্রুটিগুলো সার্বিকভাবে বাংলাদেশ সমাজের মূল্যবোধের অবক্ষয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত। এখানে সামাজিক শিষ্টাচার লোপ পেয়েছে; টাকার লোভ সর্বব্যাপী, দক্ষতা অর্জন না করেই দক্ষতার ভান এখানে প্রতিদিন দৃশ্যমান। আর শো-অফ নির্ভর নাগরিক জীবনের লোভে সবাই শহরমুখী।

ডাক্তাররা যেহেতু অন্য কোন সভ্য সমাজ থেকে আসেননি; এই অবনতিশীল বাংলাদেশ সমাজের অংশ; কাজেই কেবল তাদের কাছ থেকেই সভ্যতার প্রত্যাশা বাস্তব নয়।

উল্লেখ্য যে ‘ডাক্তারদের নিয়ে’ অনুরূপ অভিযোগ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোতেও রয়েছে। সামগ্রিকভাবে দক্ষিণ এশিয়া সভ্যতার ট্রেনটি মিস করাতে আজো রয়ে গেছে অসভ্যতার অচলায়তনে।

ডাক্তারদের মর্যাদার বিষয়টিতে কিছু ঝুঁকির জায়গা বাংলাদেশে রয়েছে। ক্ষমতাসীন সরকারের সমর্থক গ্রাম্য টাউট ও মিডলম্যানেরা; সংঘর্ষে মানুষ হত্যা করে ডাক্তারকে ‘স্বাভাবিক মৃত্যু’র সার্টিফিকেট দিতে ও মামলায় মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে বাধ্য করে। হাসপাতালের যন্ত্রপাতি ক্রয়ে চাঁদার জন্য মুখিয়ে থাকে তারা। আবার জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের ডাক্তারদের ওপর তাদের কথিত নির্বাহী ক্ষমতার ছড়ি ঘুরিয়ে বস হতে চান; স্যার ডাক শোনার আকুতিও তাদের মাঝে থাকে।

শিক্ষক-ডাক্তার এমন পেশার মানুষ যারা জাতির মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের মতো সবচেয়ে গুরুত্ব বিষয়ের দেখভাল করেন; তাদের ওপর ক্ষমতার ছড়ি ঘুরিয়েই পেশা দুটোর প্রতি আকর্ষণ ও মোটিভেশান নষ্ট করা হয়েছে। যথাযথ মর্যাদা পেলে সে আনন্দে তারা অনেক ভালো কাজ করতে পারবেন; এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়।

বর্তমানে বাংলাদেশে সরকারি বেতন-ভাতার যে স্কেল; তা মোটামুটি সন্তোষজনক। এতে অনায়াসে জীবন নির্বাহ সম্ভব। কিন্তু দুর্নীতি বিপ্লবের কারণে রাজনীতি-ব্যবসা-প্রশাসন-পুলিশ-ঠিকাদারির লোকেরা যেভাবে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে; তাতে ব্যাপক বড়লোকি দেখানো সমাজ তৈরি হয়েছে। এটি সামাজিক বিশৃংখলা তৈরি করেছে। রাষ্ট্রের সম্পদ চোরগুলো জীবনে সাফল্যের নতুন নতুন সূচক তৈরি করেছে। তারা লুন্ঠনের টাকায় কেবল দেশেই প্রাসাদ গড়ে ক্ষান্ত হয়নি;ইদানিং বিদেশে ‘সেকেন্ড হোম’ নির্মাণকে নতুন সাফল্যের লক্ষ্যমাত্রা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

এই বিশৃংখল সামাজিক বাস্তবতায় শিক্ষক ও ডাক্তারদের পক্ষে কেবল বেতন-ভাতা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকা অত্যন্ত কঠিন। কারণ তাকে সমাজে বসবাস করতে হয়। চোখের সামনে দম্ভভরে চোরদের ছড়ি ঘুরাতে দেখলে সৎ মানুষের কাজের আগ্রহ হারিয়ে ফেলা অস্বাভাবিক নয়।

বাংলাদেশে ‘ইংলিশ মিডিয়াম’ নামের একটি উদ্ভট শিক্ষা-ব্যবস্থা রয়েছে। সন্তানকে মাতৃভাষা বাংলা ভুলিয়ে দিয়ে ফট ফট করে ইংরেজি বলা শিখিয়ে ক্যানাডা-এমেরিকা-ইংল্যান্ডের হবু নাগরিক হিসেবে তৈরিই এই মাধ্যমের কাজ। বাস্তবে যদিও সাধারণ শিক্ষা থেকে আসা ছাত্র-ছাত্রীরাই বিদেশে উচ্চশিক্ষাগ্রহণে অপেক্ষাকৃত সফল; পশ্চিমা দেশগুলোতে শ্রমে ও ঘামে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু ইংলিশ মিডিয়ামের বাহিরী চটকে আকৃষ্ট অভিভাবকরা।

এ কারণে উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে পোস্টিং পাওয়া সরকারি কর্মকর্তারা ঢাকায় স্ত্রী-সন্তানদের রেখে বাচ্চাকে ইংলিশ মিডিয়াম পড়াতে চেষ্টা করেন। দুটো জায়গায় পরিবার ছড়িয়ে থাকায় জীবন নির্বাহের খরচ দ্বিগুণ হয়ে যায়। আবার শিশুর ইংলিশ মিডিয়ামে শিক্ষা-খরচ বহন সাদা-শিশু-হস্তী লালনের মতো।

জাতীয় পর্যায়ে কার্যকর কর্মকৌশল গ্রহণের মাধ্যমে উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের স্কুল-কলেজগুলোতে শিক্ষার মান বৃদ্ধি করা গেলে; মাতৃভাষার পাশাপাশি ইংরেজি শেখার সুযোগ সৃষ্টি করা গেলে; সরকারি কর্মকর্তারা অতীতের মতো তাদের সন্তানদের সেখানেই স্কুলে-কলেজে পড়াতে পারলে; গ্রামে ডাক্তার থাকতে চায় না; এ অভিযোগের উপশম সম্ভব। উল্লেখ্য যে, এখন ইন্টারনেট মাধ্যমে ইংরেজির এতো ভালো দূর-শিক্ষক রয়েছেন যারা কথিত ইংলিশ মিডিয়াম শিক্ষকদের চেয়ে অনেক দক্ষ।

পশ্চিমা দেশগুলোতে শহর ছেড়ে গ্রামে থাকার প্রবণতা বাড়ছে। আর ইন্টারনেট যুগে কেন্দ্র-প্রান্ত বলে তো কিছু নেই; ইন্টারনেট থাকা মানেই চলমান বিশ্বের সঙ্গে থাকা। আমরা দক্ষিণ এশিয়রা সভ্যতার খবর সবসময় দেরিতে পাই। ফলে আমাদের সভ্য হতে দেরি হয়ে যায়।

বাংলাদেশের রাজধানী শহর ঢাকা জনঘনত্বের অস্বাভাবিকতায় মৃত্যুমুখী। সেখানে বাতাস এতোই দূষিত যে; নিশ্বাস-প্রশ্বাসে বিষ ঢুকে পড়ে। অথচ এখনো পরিবেশ ও প্রতিবেশগত দিক থেকে ঢাকার বাইরের পুরো বাংলাদেশই সবুজ ও স্বাস্থ্যপ্রদ এক একটি জনপদ।

যদিও নীতি নির্ধারকরা সভ্যতার চলতি হাওয়ার খোঁজ না রাখায়; অষ্টাদশ শতকের পশ্চিমের মতো গ্রামগুলোকে শহর বানাতে মরিয়া। এই নীতি-নির্ধারকদের একবিংশের গ্রামমুখী ও সবুজ মুখী উন্নয়নের বিশ্বহাওয়ার কথা বোঝানো প্রয়োজন।

আর ডাক্তার ও অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তাদের স্ত্রীদের বোঝাতে হবে আধুনিক বিশ্বের গ্রামমুখী প্রবণতার কথা। সমাজের সাংস্কৃতিক উপাদান ধারণ করেন নারী। ভাবিরা টিভির বিজ্ঞাপন দেখে; স্মার্ট হয়ে যাওয়া ফেসবুক সেলিব্রেটি ভাবিদের ভাবভঙ্গি দেখে, অনাবাসী ভাবীদের ‘নাগরিক-পুলকে’র গপ্পোগুজব শুনে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন। ভাইকে ঢাকায় বাসা নেয়ার চাপ দিতে থাকেন। ভাইকে তখন উপজেলা ও জেলায় একা পড়ে থাকতে হয়। আর বাচ্চাটার মুখ দেখতে ঘন ঘন দৌড়াতে হয় ঢাকায়। এই বাস্তবতার কারণে গ্রামে ডাক্তার পাওয়া যায় না।

এই সব বাস্তবতা বিবেচনায়; ডাক্তারদের সেবার মান আশানুরূপ না হবার বিষয়টি সমানুভূতির সঙ্গে দেখতে হবে। ডাক্তার ও রোগি পরস্পরের প্রতি ক্রোধ-প্রদর্শন করে কোন সমাধান আসবে না। আর রোগীদেরকেও আচার-আচরণে পরিশীলিত হতে হবে। রোগীর মৃত্যু হলেই ডাক্তারকে ধরে অপমান করা অত্যন্ত অযৌক্তিক আচরণ। ডাক্তার সতত রোগির জীবন বাঁচাতে চেষ্টা করেন। সেখানে তিনি ব্যর্থ হতে পারেন। কিন্তু এর জন্য তার ওপর দায় চাপানো নির্বুদ্ধিতা। অন্যদিকে ডাক্তারদেরও শিখতে হবে, রোগির সঙ্গে ভালো ও সহানুভূতিশীল আচরণ তাকে অর্ধেক সারিয়ে তোলে।

সামাজিক আচরণে শিষ্টাচার ফিরিয়ে আনা গেলেই ডাক্তার ও রোগির সম্পর্ক সুন্দর হয়ে আসবে। পরস্পর দোষারোপ নয়; নিজের আচরণটিকে সভ্য করে তুললেই কেবল সভ্যতার দেখা মেলে।

মাসকাওয়াথ আহসান, লেখক ও সাংবাদিক