‘বিদেশে বিপুল টাকা পাচারের কারণ দর্শাতে হবে’

নভেম্বর ২২, ২০১৯

জাতির জনক এ জনপদটিকে ‘চোরের খনি’ বলেছিলেন। আর ‘চাটার দল’টিই চেটেচুটে টাকা-চুরি করে সে ব্যাপারে সতর্ক করেছিলেন তিনি।

এই যে এতো নেতা-কর্মীকে মুজিব কোট পরে আঙ্গুল উঁচিয়ে ঘুরতে দেখি; এই যে ফেসবুকের কাভারে এমনকি প্রোপিকে এতো এতো বঙ্গবন্ধুর ছবি; সারাক্ষণ এতো এতো বঙ্গবন্ধুর আদর্শের মন্ত্র পড়ে ক্ষমতার আস্ফালন! তা বঙ্গবন্ধুর ঠিক কোন আদর্শটি আত্মস্থ করেছেন তারা! এতো যে পিতা বলে তাঁর সমাধিতে গিয়ে হাউমাউ করে কাঁদে কতশত লোক; তারা বঙ্গবন্ধুর ঠিক কোন উপদেশ মেনে চলেছেন!

গত কয়েক বছরে ব্যাপক অর্থপাচারের ঘটনা ঘটেছে। কেবল ২০১৫ সালেই কমপক্ষে ৫০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে গেছে বাংলাদেশ থেকে। প্রতিবছর জনগণের দেয়া করের ৩৬ শতাংশই পাচার হয়ে গেছে। এ টাকা পাচার যেন অপ্রতিরোধ্য; এ নিয়ে ক্ষমতাসীন সরকারের কোন হেলদোল নেই। তাদের ক্ষমতার মধুচন্দ্রিমার নেশাই যেন ফুরায় না।

এ ব্যাপারে ক্ষমতাসীন সরকারকে আমরা সাধারণ জনগণ একটি কারণ দর্শাও নোটিশ দিচ্ছি এই লেখার মাধ্যমে। তাদেরকে জানাতে হবে কীভাবে এই বিপুল অর্থ পাচার হলো! পাচার রোধ করতে না পারার জন্য শাস্তির মুখোমুখি করতে হবে এই সরকারকে। সরকারের এ ব্যাপারে জবাবদিহিতা জনগণের প্রাধিকার বা এনটাইটেলমেন্ট।

জাতির জনক এ জনপদটিকে ‘চোরের খনি’ বলেছিলেন। আর ‘চাটার দল’টিই চেটেচুটে টাকা-চুরি করে সে ব্যাপারে সতর্ক করেছিলেন তিনি।

এই যে এতো নেতা-কর্মীকে মুজিব কোট পরে আঙ্গুল উঁচিয়ে ঘুরতে দেখি; এই যে ফেসবুকের কাভারে এমনকি প্রোপিকে এতো এতো বঙ্গবন্ধুর ছবি; সারাক্ষণ এতো এতো বঙ্গবন্ধুর আদর্শের মন্ত্র পড়ে ক্ষমতার আস্ফালন! তা বঙ্গবন্ধুর ঠিক কোন আদর্শটি আত্মস্থ করেছেন তারা! এতো যে পিতা বলে তাঁর সমাধিতে গিয়ে হাউমাউ করে কাঁদে কতশত লোক; তারা বঙ্গবন্ধুর ঠিক কোন উপদেশ মেনে চলেছেন!

টাকা পাচারের যে হিসাব পাওয়া যাচ্ছে; তাতে বাংলাদেশ লুটপাট হয়ে গেছে; এতো খুবই স্পষ্ট। এই যে এতো বড় গলা করে, ক্ষমতাসীন দলের পিকেটাররা কথায় কথায় জনগণের পিঠের চামড়া তুলে নিতে চায়; বিস্মিত হই। চোরের মা-বাপ-ভাই-বোন-বেয়াইয়ের এতো বড় গলা আসে কোত্থেকে!

এই যে দেশের কৃষক-শ্রমিক-প্রবাসী রেমিটেন্স শিকারি-মেহনতি মানুষের তিল তিল পরিশ্রমে গড়ে তোলা ব্যাংক রিজার্ভ-জিপিডি গ্রোথ; এই কষ্টের ধন চুরি করে দুবাই-মালয়েশিয়া-সিঙ্গাপুর-ক্যানাডাসহ নানাদেশে পাচারের ‘সাগর-ডাকাতি’; এর পর কী করে জনগণের সামনে মুখ দেখাবেন ক্ষমতাসীন দলের সরকারি দায়িত্বপ্রাপ্ত লোকেরা আর সরকারি চাকুরেরা; যারা ‘রাজার আকার নিয়ে’ ঘুরছেন আর চর্বি জমা শরীর নড়িয়ে জনগণকে ‘স্যার ডাকতে বাধ্য করছেন! কোন দায়িত্বটা সুচারুরূপে পালন করেছেন তারা। এতোগুলো লোককে মোটা বেতন আর সুবিধাদি দিয়ে রাষ্ট্র পুষলো এতোদিন; সেটা কী তাদের চেহারা দেখার জন্য! কোন কাজটা দক্ষতার সঙ্গে করে দেখালো এরা!

চোরের খনির পাহারাদাররা জড়িত না থাকলে কখনোই এতো বিপুল অর্থ দেশের বাইরে পাচার হতে পারে না! সুতরাং এর কারণ দর্শাতে হবে ক্ষমতাসীন সরকারকে!

এই সর্বব্যাপী লুন্ঠন ক্ষমতাসীন সরকার আর তার সমর্থকদের দায়; পাচার হয়ে যাওয়া ফেরত আনা তাদের দায়িত্ব। বঙ্গবন্ধুর খুনী আর একাত্তরের ঘাতকদের ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টার সঙ্গে এখন যুক্ত করতে হবে; বাংলাদেশের টাকা-পাচারকারী গ্যাং-টিকে ফেরত আনার কাজ। এটিই এখন ক্ষমতাসীন সরকারের প্রধান দায়।

সাবেকি বিএনপি-জামায়াত আমলে দুর্নীতি ও টাকাপাচারের ঘটনা ঘটেছে জন্যই তারা ক্ষমতা থেকে ছিটকে পড়েছে। জনগণ আজো ‘হাওয়া ভবন’-এর নাম শুনলে ভয় পায়।

কাজেই চলমান আওয়ামী লীগ আমলে যে পাহাড়-প্রমাণ দুর্নীতি আর বিদেশে টাকা পাচারের ঘটনা ঘটলো; তাতে এই দলটির কী শাস্তি হওয়া উচিত তা ক্ষমতাসীনদেরই ভেবে দেখতে বিনীত অনুরোধ রইলো। দেশময় ‘খাওয়া ভবন’ আর টর্চার সেলের কারণে জনগণ কতটা ভীত-সন্ত্রস্ত; তার একটা বিহিত করতে হবে এখনই।

পরম করুণাময় প্রধানমন্ত্রী সুযোগ পেলেই বাংলাদেশের ধনী হয়ে ওঠার গল্প শোনান। সাধারণ মানুষের উপার্জনে বৈদেশিক রিজার্ভ বাড়ার এই গল্পটিতে ক্ষমতাসীন দলের কৃতিত্ব কোথায়! প্রধানমন্ত্রীকে ‘চোরের খনি’-র কোন অর্থনীতিক সর্দার বুঝিয়েছেন, দেশ ধনী হলে; কিছু লোক ধনী হবেই। এটা কোন অর্থনৈতিক পুরানের গল্প জানিনা। সিঙ্গাপুর-মালয়েশিয়া রাষ্ট্রের ধনী হবার সময়টিতে এরকম দুর্নীতি করে ধনী হওয়া বা বিদেশে টাকা-পাচারের ঘটনা ঘটেনি। সম্পদ দেশের মধ্যেই সঞ্চালিত হওয়ায় শক্তিশালী অর্থনীতি দাঁড়িয়ে গেছে দেশ দুটিতে।

ক্ষমতাসীন সরকারের খুব পরিচিত প্যাটার্ন হচ্ছে, যে কোন সংকটের দায় বিএনপি-জামায়াতের’ ওপর চাপিয়ে দেয়া। মানে বিএনপি ক্ষমতায় থাকলেও তাদের দোষ; আবার ক্ষমতায় না থাকলেও তাদের দোষ। আওয়ামী লীগের এই যে ‘নিষ্পাপ শিশু’ বা ‘অনাঘ্রাতা কুমারী’র মতো যে আচরণ; এটা খুবই চোর-বান্ধব। ক্ষমতা-কাঠামোর চোর ও চোরের খনির পাহারাদাররা ভাবে, দোষ হইবো বিএনপির; আমরা টেকা-টুকা পাচার কইরা সেকেন্ড হোম বানাইয়া লই।

হলোও তাই। দুবাই-মালয়েশিয়া-সিঙ্গাপুর-ক্যানাডায় গিজগিজ করছে চোরেদের সেকেন্ড হোম। চোরের সপরিবারে দেয়া ফেসবুক সেলফিতে তাদের সাফল্যের ঝিলিক দেখে, দেশের সাধারণ মানুষ ভাবছে, এবার চোর হতে হবে। শিশুরা জীবনের লক্ষ্য স্থির করছে, বড় হইয়া চোর হইতে চাই।

মাসকাওয়াথ আহসান, লেখক ও সাংবাদিক