টিআইবির নির্বাচনকালীন সরকারের কাঠামো প্রস্তাব

এপ্রিল ১২, ২০১৩

sm20121014045155ঢাকা জার্নাল: আসন্ন নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে যখন সব মহলে অনিশ্চয়তা তখন নির্বাচনকালীন সরকার পদ্ধতির একটি কাঠামো গণমাধ্যমের সামনে উপস্থাপন করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।

অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও সকলের অংশগ্রহণে আগামী দশম সংসদ নির্বাচন নিশ্চিত করাই ১১ সদস্য বিশিষ্ট নির্বাচনকালীন সরকার কাঠামো প্রস্তাবের মূল উদ্দেশ্য বলে জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) ।

শুক্রবার দুপুর ১২টায় ব্র্যাক সেন্টার ইন-এ আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে টিআইবি এই প্রস্তাব উপস্থাপন করে।

প্রেস কনফারেন্সে বক্তব্য রাখেন টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, সদস্য এম হাফিজউদ্দিন খান, নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান।

অনুষ্ঠানে কার্যপত্র উপস্থাপন করেন টিআইবি’র গবেষণা বিভাগের প্রোগ্রাম ম্যানেজার রুমানা শারমিন। সম্ভাব্য সরকারের গঠন প্রক্রিয়া, এখতিয়ার ও সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় আইনগত ও সাংবিধানিক পরিবর্তনের বিষয়গুলি তুলে ধরেন ড. ইফতেখারুজ্জামান।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা উচ্চ আদালতের রায় অনুযায়ী ‘ডকট্রিন অব নেসেসিটি’তে পরিণত হয়েছে উল্লেখ করে টিআইবির এই কার্যপত্রে সংসদীয় ঐকমত্য কমিটির কাঠামো, গঠন প্রক্রিয়া, কার্যক্রম এবং নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থার প্রস্তাবিত কাঠামোর বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়।

প্রস্তাব অনুযায়ী সংসদীয় ঐকমত্য কমিটি ও নির্বাচনকালীন সরকার উভয় ক্ষেত্রেই জনপ্রতিনিধিদের প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে সুলতানা কামাল বলেন, “এ মুহূর্তে চলমান সাংঘর্ষিক পরিস্থিতির নানা রূপের মধ্যে আমরা চাচ্ছি এর সমাধান। এমন অবস্থায় রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচন নিয়ে একটি সমঝোতায় আসতে পারলে সকল হতাশা কেটে স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরে আসতে পারে।”

তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলো দিনের পর দিন সংঘর্ষ চালিয়ে আমাদের জীবন যেভাবে বিপর্যস্ত করছে, তাতে আমাদের একটা দায়িত্ব আছে, তাদেরকে আলোচনায় বসতে বলা। দু দলই নির্বাচনে অংশ নেবে। সুষ্ঠু ও সুন্দর নির্বাচনের জন্য আলোচনায় বসতেই হবে।’

তিনি বলেন, “টিআইবির তাগিদ সুশাসন প্রশ্নে। এ কারণেই আমরা এই প্রস্তাব নিয়ে হাজির হয়েছি।”

হাফিজউদ্দিন খান বলেন, “দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব নয়। তবে স্বচ্ছ নির্বাচনের মনোভাব থাকলেই একটি সমাঝোতায় পৌঁছানো সম্ভব হবে বলে আমরা মনে করি।”

টিআইবির প্রধান নির্বাহী ড. ইফতেখারুজ্জামান নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থার প্রস্তাবনা তুলে ধরে বলেন, ‘এখানে আমরা সুষ্ঠু নির্বাচনের একটা কাঠামো ও প্রক্রিয়া তুলে ধরেছি। এ প্রক্রিয়ার বাইরে নতুন যে কোন ফর্মুলাও আসতে পারে। আমরা এ প্রস্তাব সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলোর কাছেও উপস্থাপন করবো।’
টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক বলেন, “ টিআইবি প্রস্তাবিত সরকার ব্যবস্থায় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ভূমিকাই নির্ধারক, ফলে এই ব্যবস্থায় অনির্বাচিতদের হস্তক্ষেপের আশঙ্কা দূর হবে। ঐকমত্য কমিটির মাধ্যমে প্রস্তাবিত এই ব্যবস্থায় সরকার ও বিরোধী সকল পক্ষের গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের রাজনৈতিক দলের নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই বাছাই বা নির্বাচন করবেন। তাই এই প্রস্তাব সরকার ও বিরোধী উভয় দলের কাছেই গ্রহণযোগ্যতার দাবি রাখে।”
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, কমিটিতে সদস্য মনোনয়নের ক্ষেত্রে পরস্পরের প্রতি সহিষ্ণু মনোভাব, প্রতিপক্ষ দলের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য আস্থাভাজন প্রভৃতি বিষয় বিবেচনায় রেখে সদস্য মনোনয়ন দিতে হবে।”

কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া

কার্যপত্রের প্রস্তাবনায় বলা হয়, নির্বাচনী সরকার গঠনের প্রথম ধাপে একটি কমিটির জন্য মনোনয়ন আহ্বান করবেন স্পিকার। রাজনৈতিক দলগুলোর মনোনীত সদস্যদের তালিকা স্পিকারের কাছে হস্তান্তর করা হবে। সদস্য নির্বাচনের পর স্পিকার প্রথম সভা আহ্বান করবেন। কমিটি কার্যকর থাকাকালীন সকল সাচিবিক দায়িত্ব পালন করবেন জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের সচিব। একটি সংসদীয় ঐকমত্য কমিটির মাধ্যমে নির্বাচনকালীন সরকারপ্রধানসহ অন্য সদস্যদের মনোনয়ন দেওয়া হবে।

ঐকমত্য কমিটির কাজ

নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধানসহ মোট ১১ সদস্যের তালিকা প্রস্তুত করার জন্য কমিটি কাজ করবে। সরকার প্রধানের ক্ষেত্রে উভয় জোটের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য একজন নির্বাচিত বা অনির্বাচিত ব্যক্তিকে মনোনয়ন দেবে। এই কমিটি নির্বাচনকালীন সরকারের বাকি ১০ জনের তালিকা চূড়ান্ত করবে। কমিটি সংসদের নির্ধারিত মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার পূর্ববর্তী ৩০ দিনের মধ্যে গঠিত হয়ে নির্বাচনকালীন সরকারের সদস্যদের তালিকা প্রস্তুত করবে, যেন সংসদের নির্ধারিত মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রপতি সংসদ ভেঙে দিয়ে উক্ত সরকারের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করতে পারেন।

ঐকমত্য কমিটি আলোচনার মাধ্যমে কমিটির মধ্য থেকে গ্রহণযোগ্য দুইজনকে নির্বাচন করবে যারা যৌথভাবে আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। তারা ওই কমিটির মুখপাত্র হিসেবে যে বিষয়গুলো জনস্বার্থে প্রকাশযোগ্য সেগুলো নিয়মতান্ত্রিকভাবে জনসম্মুখে প্রকাশ করবেন। তারা কমিটির সভা আহ্বান করবেন এবং সার্বিক সমন্বয়কারীর দায়িত্ব পালন করবেন।

নির্বাচনকালীন সরকারের কাঠামো

টিআইবি’র কার্যপত্র অনুযায়ী দুইটি বিকল্প ধরে ঐক্যমত কমিটি নির্বাচনকালীন সদস্যদের তালিকা প্রণয়ন করবেন। বিকল্প ‘ক’ অনুযায়ী ঐক্যমত কমিটি প্রথমে নিজেদের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে নির্বাচনকালীন সরকার প্রধান এবং তার সঙ্গে আলোচনার প্রেক্ষিতে অন্যান্য ১০ সদস্যের তালিকা প্রস্তুত করবেন। বিকল্প ‘খ’ অনুযায়ী কমিটি আলোচনার মাধ্যমে প্রথমে ১০ সদস্যের তালিকা প্রস্তুত করবেন এবং উক্ত ১০ জনের মধ্যে আলোচনার প্রেক্ষিতে একজনকে সরকার প্রধান হিসেবে মনোনয়ন দেবেন। গ্রহণযোগ্য নির্বাচিত বা অনির্বাচিত একজন ব্যক্তি নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান হবেন।

সম্মেলনে আরো উল্লেখ করা হয়, কমিটি সরকার প্রধানের বিষয়ে ঐকমতে পৌঁছতে না পারলে ৩ জনের একটি তালিকা স্পিকারের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রেরণ কর‍া হবে। এরপর উক্ত তালিকা থেকে রাষ্ট্রপতি একজনকে সরকার প্রধান নিযুক্ত করবেন।

নির্বাচনকালীন সরকারের উভয় জোট থেকে মন্ত্রিসভার ১০ জন সদস্যের তালিকা প্রণয়নের ক্ষেত্রে টিআইবি’র কার্যপত্রে তিনটি প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে। বিকল্প ‘ক’ অনুযায়ী উভয় জোট থেকে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, বিকল্প ‘খ’ অনুযায়ী নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ও অনির্বাচিত বা নির্দলীয় ব্যক্তিবর্গ এবং বিকল্প ‘গ’ অনুযায়ী শুধু অনির্বাচিত নির্দলীয় ব্যক্তিদের সমন্বয়ে নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভা গঠিত হবে।

অন্যদিকে একই মন্ত্রিসভা গঠনের ক্ষেত্রে বিগত তিনটি নির্বাচনে প্রাপ্ত মোট ভোটের দলীয় অনুপাতের ভিত্তিতে সদস্য মনোনয়নের সূত্র তুলে ধরে টিআইবি জানায়, পূর্বের তিনটি বিকল্পের ক্ষেত্রেই এই আনুপাতিক হার প্রযোজ্য হবে।

নির্বাচনকালীন সরকারের এখতিয়ার

কার্যপত্র অনুযায়ী, নির্বাচনকালীন সরকারের মেয়াদ হবে দায়িত্ব গ্রহণের দিন থেকে পরবর্তী ৯০ দিন। এই ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে। শুধু গুরুতর প্রাকৃতিক দুর্যোগকালীন অবস্থায় রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আলোচনার সাপেক্ষে সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সর্বোচ্চ ৯০ দিন পর্যন্ত এই সরকারের মেয়াদ বৃদ্ধির বিষয়টি বিবেচনা করা যাবে। এই সরকারে কোন সদস্য সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। তারা দশম সংসদে নির্বাচিত সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে ওই সংসদের নির্ধারিত মেয়াদ পর্যন্ত সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানে অধিষ্ঠিত হতে পারবেন না।

টিআইবি আরো জানায়, এই সরকার শুধু নির্বাচন সংক্রান্ত ও দৈনন্দিন প্রশাসনিক অপরিহার্য কার্যক্রম পরিচালনা করবেন। মন্ত্রিসভার সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করে নির্বাচনকালীন সরকার প্রধান মন্ত্রণালয় বণ্টনের বিষয়টি নির্ধারণ করবেন।

দলগুলোর কাছে এই প্রস্তাব পাঠিয়েছেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন,  “প্রাথমিকভাবে আমরা গণমাধ্যমের কাছে উপস্থাপন করলাম। পরে বিবেচনার জন্য প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলোর কাছে পাঠানো হবে।”

রাষ্ট্রপতির সার্বিক ভূমিকা

টিআইবি সংবাদ সম্মেলনে জানায়, তাদের প্রস্তাবিত নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির সাংবিধানিক ভূমিকার পাশাপাশি নির্বাচনকালীন সরকারের শপথ গ্রহণের জন্য প্রধান বিচারপতিকে আমন্ত্রণ জানানো হবে।তিনি সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে বিতর্ক সমাধানের পরামর্শ দেবেন। উক্ত সরকারের মন্ত্রিসভার কোন সদস্যকে অপসারণের বা অর্ন্তভূক্তির ক্ষেত্রে নির্বাচনকালীন সরকার প্রধানের সঙ্গে পরামর্শক্রমে পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন এবং নির্বাচনের পর নতুন সরকার গঠনের জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠ দল বা জোটকে আহ্বান জানাবেন।

প্রস্তাবিত নির্বাচনকালীন সরকারের কাঠামো ও কার্যক্রমের সফল বাস্তবায়নের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা চুক্তি এবং টিআইবি’র প্রস্তাব গৃহীত হলে তা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ ও প্রয়োজনে এ বিষয়ে গণভোটের ব্যবস্থার প্রস্তাব করেছে টিআইবি।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.