রাজনীতির পরিবারতন্ত্রের কংকাল নিয়ে বেহুলার মিছিল

নভেম্বর ১৯, ২০১৯

দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক মাজার গুলোতে খাদেমের অভাব নেই। খাদেমেরা জানে, বাংলাদেশে শেখ পরিবারের নতুন প্রজন্মের গদিনশীন বা জিয়া পরিবারের নতুন প্রজন্মের গদিনশীনের মাঝে প্রাণ খুঁজে পেতেই হবে। এই জনপদ নেতৃত্ব জন্ম দিতে অক্ষম। রাজনীতির ক্ষয়িষ্ণু মাজারগুলো ধরে ‘লালসালু’ উপন্যাসের মজিদের মতো কান্নাকাটি করে ‘প্রাণ খুঁজে পেলে’ নিঃস্ব ও হতদরিদ্র জীবনে বেশ আরামের পীরালী জুটে যায়।

কোনো পারিবারিক পেশা যুগের পর যুগ সুনামের সঙ্গে ধরে রাখা খুব কঠিন। একজন ভালো অভিনেতার ছেলে বা মেয়ে ভালো অভিনেতা হবেন কিংবা একজন নেতার ছেলে বা মেয়ে ভালো নেতা হবেন; সে নিশ্চয়তা নেই।

নগরীর যে সেরা টেইলর মাস্টারের কাছে আপনি যেতেন; আজ অনেক বছর পরে সেই শো-রুমে গিয়ে টেইলর মাস্টারের ছেলের দক্ষতা আপনাকে আকৃষ্ট না-ও করতে পারে। একটি পরিবারের একজন মানুষই একটি পেশায় সেরা হতে পারেন। কারণ সেই মানুষটি একে প্যাশন হিসেবে নিয়েছিলেন। তার ছেলে-মেয়ের কাছে; সেটা নেহাত পেশা। ফলে সেখানে সাফল্য আসা খুব কঠিন।

দক্ষিণ এশিয়ার লোকজ সমাজ ‘পীরের ছেলে’ পীর হিসেবে গদিনশীন হওয়া; জমিদারের ছেলে জমিদারির হাল ধরা বা ব্যবসায়ীর ছেলে ব্যবসার হাল ধরার সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত। সিনেমার নায়ক চান তার ছেলেটিকে চিত্রনায়ক হিসেবে দাঁড় করিয়ে দিয়ে যাবেন। বাস্তবে তা ঘটে না। কোথাও কেউ কাউকে দাঁড় করিয়ে দিতে পারে না।

দক্ষিণ এশীয় পীরবাদের অনুসরণে এই জনপদের দেশগুলোতে রাজনৈতিক পেশার পরিবার গড়ে উঠেছে। এই বড় বড় পরিবারের ছায়ায় নির্বাচনী এলাকা বা জায়গীরের নামে গড়ে উঠেছে; ছোট ছোট রাজনৈতিক পরিবারের জমিদারি। একেই আমরা বেশ আদর করে গণতান্ত্রিক প্রথা বলি।

সম্প্রতি বিএনপির শীর্ষ নেতা মীর্জা ফখরুল বললেন, ‘তারেকে বিএনপি প্রাণ পেয়েছে।’ এই যে একটি রাজনৈতিক পরিবারের মাঝে ‘প্রাণের ঠিকানা’ খুঁজে পাবার যে প্রবণতা; এই অলীক আস্থা ও ভক্তির যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি; তাকেই আমরা পরিবারতন্ত্র বলি।

দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক মাজার গুলোতে খাদেমের অভাব নেই। খাদেমেরা জানে, বাংলাদেশে শেখ পরিবারের নতুন প্রজন্মের গদিনশীন বা জিয়া পরিবারের নতুন প্রজন্মের গদিনশীনের মাঝে প্রাণ খুঁজে পেতেই হবে। এই জনপদ নেতৃত্ব জন্ম দিতে অক্ষম। রাজনীতির ক্ষয়িষ্ণু মাজারগুলো ধরে ‘লালসালু’ উপন্যাসের মজিদের মতো কান্নাকাটি করে ‘প্রাণ খুঁজে পেলে’ নিঃস্ব ও হতদরিদ্র জীবনে বেশ আরামের পীরালী জুটে যায়।

সম্প্রতি ভারতের গান্ধী পরিবারের রাজনৈতিকভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর আর সুযোগ নেই; এমন আশংকা প্রকাশিত হয়েছে নানা রাজনৈতিক বিশ্লেষণে। রাহুল গান্ধী কিংবা প্রিয়াংকা গান্ধীর পক্ষে পারিবারিক রাজনৈতিক পেশাটি কতটুকু ধরে রাখা সম্ভব তা নিয়ে সন্দিহান পর্যবেক্ষকরা।

পাকিস্তানের ভুট্টো পরিবারের নবীন গদিনশীন সদস্য বিলওয়াল ভুট্টো তাদের পারিবারিক রাজনৈতিক ব্যবসাটি ধরতে পারবে; এমন মনে করে না অধিকাংশ পর্যবেক্ষক।

পাকিস্তানের নওয়াজ পরিবারের নবীন প্রজন্মের গদিনশীন মরিয়ম নওয়াজ পারিবারিক রাজনৈতিক ব্যবসা ধরে রাখতে মরিয়া হলেও; তার ব্যাপারে সাধারণ মানুষের আগ্রহ খুবই কম।

বৃটেনে রাজপরিবারের মাজারটিকে ধরে রেখে; খাদেমেরা উপনিবেশগুলোকে রাজকীয় জীবন কাটিয়ে যে কথিত এরিস্ট্রোকেসির অনুসন্ধান করেছিলো; সেই মডেলটিই আজো অনুসৃত পুরো দক্ষিণ এশিয়ায়।

কিন্তু আধুনিক বৃটেন নতুন নেতা তৈরি করে; মাজার সংস্কৃতিতে রাজনীতি ও গণতন্ত্র চলে না এই বোঝাপড়া থেকে। ইউরোপের গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে নতুন নতুন নেতৃত্ব তৈরি হয়। কয়েকটি পরিবারের মাজার ধরে কান্নাকাটি করে দলীয় ‘অনুভূতি’র মিছিল করার গ্রাম্যতা থেকে তারা অনেক আগেই মুক্তি পেয়েছে।

এই রাজনৈতিক পীর প্রথার আদিম লীলাভূমি দক্ষিণ এশিয়া এর ভ্যাড়ভেড়ে গ্রাম্য দলীয় অনুভূতির রাজনৈতিক ব্যবসায় বড় বড় রাজনৈতিক পরিবারের ছায়ায় তৈরি করে ঠগী ও লুন্ঠক একটি সম্প্রদায়। এদের লুন্ঠনে ঝাঁঝরা হয়ে ধুঁকছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো।

একটি দুটি ডিগ্রি নেয়ায় যারা শার্ট-প্যান্ট পরতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন; তারা পিতার কৃষিক্ষেত্রে গিয়ে তাকে সাহায্য করতে সংকোচ বোধ করেন। কৃষিকাজ তাদের কাছে লজ্জার কাজ। এই নব্য শিক্ষিত ছেলেটিকে আকর্ষণ করে; রাজনীতির মাজার ব্যবসার খাদেমের চাকরি। সরকারি ঠিকাদারির কাজ নিয়ে দালান নির্মাণে রডের পরিবর্তে বাঁশ ব্যবহার, রেল-লাইনের রক্ষণাবেক্ষণে লোহার পাতের পরিবর্তে বাঁশ সরবরাহ, সরকারি ক্রয়ের দায়িত্ব নিয়ে অস্বাভাবিক দামে বালিশ-ক্রয়, কিংবা ছোট দোকানি, হাতুড়ে, রিক্সাওয়ালা, কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের কাছ থেকে চাঁদা আদায়ের লাইসেন্স খুবই আকৃষ্ট করে দলীয় ফুটসোলজারদের।

ভাগ্যপরিবর্তনের রাজনৈতিক মাজারের খাদেম হয়ে এরা লুটপাট করে জাতির ভাগ্য। আর রাজনৈতিক পরিবারগুলোর সদস্যরা মাঝে মাঝে মিডিয়ায় এসে নিজের সততার গল্প নিজে শুনিয়ে যান। উনি একাই সাধু বাকি সব চোর। সুতরাং খাদেমেরা তার জন্য বেহেশতে প্লট বুকিং দেয়।

এইসব আউটডেটেড রাজনীতির পরিবারতন্ত্রের কংকাল নিয়ে গণতন্ত্রের বেহুলাদের রাজনৈতিক মিছিল দেখে; কেঁদে বুক ভাসায় পল্লী-জনতা। এই যে নিষ্প্রাণ কংকাল থেকে ‘প্রাণ’ খুঁজে পাবার যে লোকজ ঐতিহ্য; এ হচ্ছে যে সর্বনাশা আশা ও স্বপ্নের গোলকধাঁধা; যেখানে তীব্র হয় ঘন অন্ধকার; চলতে থাকে জনমৃত্যুমিছিল। ঠগীরা রাজনীতির ক্যাসিনোতে বড় দান মেরে বিদেশে সেকেন্ডহোমে পালিয়ে যায়। লুন্ঠিত জনগণ তখন আবারো কংকালের কাছে ‘প্রাণ প্রার্থনা’ করে। এইরকম প্রতারণা-লুন্ঠন-প্রাণ সঞ্চারের আশা-আনন্দ-দুঃখ বেদনা নিয়েই দক্ষিণ এশিয়ার এইসব দিনরাত্রি।

মাসকাওয়াথ আহসান, লেখক ও সাংবাদিক

ঢাকা জার্নাল, নভেম্বর ১৯, ২০১৯