জিয়া ফিরে ফিরে আসে

নভেম্বর ১৫, ২০১৯

শেরে বাংলা ধমক দেন, এক ওয়াক্ত নামাজ তো পড়ো না; রোজার দিনে সকাল সকাল ব্রেকফাস্ট করো; আবার কথায় কথায় বিসমিল্লাহ বলো। তোমার ভাব-চক্কর কিন্তু ভালো না।

মাসকাওয়াথ আহসা: পলাশীর যুদ্ধ উপস্থিত। লর্ড ক্লাইভ দুঃশ্চিন্তায় হাসফাঁস করছেন। সিরাজউদ্দৌলার এতো সৈনিকের সামনে কী বৃটিশ সৈনিকরা দাঁড়াতে পারবে!

জিয়াউর রহমান খুশিজলে চুমুক দিয়ে বলেন, অবশ্যই পারবে। মীরজাফরেরা নিষ্ক্রিয় থাকবে। বাঙালি সেনাদের মনোবল ভেঙ্গে যাবে। বৃটিশের দালালি করার জন্য আঁকুপাঁকু করছে ভারতবর্ষের লোক। সুতরাং গো এহেড।

লর্ড ক্লাইভ জিয়ার খুশি জল পাত্রে নিজের খুশিজলের পাত্র ঠেকিয়ে বলেন, চিয়ার্স।

লাহোর প্রস্তাব রাখার আগে দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত শেরে বাংলা, বাংলার হিন্দু রাজা-জমিদারদের হাত থেকে মুক্ত করে বাংলার কৃষক-প্রজাদের পাঞ্জাবের মুসলিম বাদশা ও জমিদারদের পীড়নের যন্ত্রে ফেলে দিচ্ছি না তো আবার পাকিস্তানের সঙ্গে সম্মিলিত স্বাধীনতার সংকল্পে!

জিয়াউর রহমান বলেন, হিন্দু জমিদারের হাতে দলাই-মলাই হয়েছে; এবার মুসলমান জমিদারের হাতে দলাই-মলাই হোক। তবু যদি হুঁশ ফেরে আপনার বাচ্চা ছেলে প্রজাদের। প্রস্তাব দিয়ে দিন বিসমিল্লাহ হির রাহমানির রাহিম বলে।

শেরে বাংলা ধমক দেন, এক ওয়াক্ত নামাজ তো পড়ো না; রোজার দিনে সকাল সকাল ব্রেকফাস্ট করো; আবার কথায় কথায় বিসমিল্লাহ বলো। তোমার ভাব-চক্কর কিন্তু ভালো না।

জিয়াউর রহমান

১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের স্বাধীনতার ঠিক আগের ব্রাহ্মমুহূর্তে নার্ভাস মোহম্মদ আলী জিন্নাহ। মাথার হ্যাট খুলে টুপি পরে আয়নার সামনে নিজেকে বার বার দেখছেন আর বলছেন, নাহ টুপিতে ঠিক মানাচ্ছে না।

জিয়াউর রহমান এক গ্লাস খুশিজল এগিয়ে দিয়ে বলেন, একটু চুমুক দিন; নার্ভাসনেস কমে যাবে।

১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতার আগের ব্রাহ্মমুহূর্তে নার্ভাস নেহেরু। বিড় বিড় করে বলেন, ভারত দু’টুকরো করার জন্য ইতিহাস কী আমাকে ক্ষমা করবে।

জিয়াউর রহমান টিপ্পনী কাটেন, খণ্ড হবার আর কী দেখেছেন; আরো খণ্ড হবে। আপনি চালাইয়া যান। দুনিয়াটা মস্তো বড়; খাও-দাও ফূর্তি করো।

স্বাধীন পাকিস্তানে প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জাকে সরিয়ে ক্ষমতা দখলের আগে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান কিছুটা জ্বরে আক্রান্ত। জিয়া থার্মোমিটার এগিয়ে দিয়ে বলেন, সবে তো কলির সন্ধ্যে; এরপর উন্নয়নের ঢোল বাজাবেন, বুনিয়াদি গণতন্ত্রের নামে ভোটারহীন নির্বাচন করবেন। এগিয়ে যান স্যার; আপনাকে দেখেই তো আমরা শিখবো!

আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে নির্বাচনের সময় ফাতেমা জিন্নাহ গভীর চিন্তিত। উনার নির্বাচনি প্রচারণা প্রধান শেখ মুজিব জীবন দিয়ে খাটছেন পাকিস্তানে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে।

জিয়া তখন আইয়ুব খানকে বুদ্ধি দেন, পূর্ব পাকিস্তানের ভোট ভাসানি আর শেখ মুজিব এই দুটি শিবিরে বিভক্ত। আপনি ভাসানিকে ডেকে একটু শ্রদ্ধা-ভক্তি প্রদর্শন করলে দিশা পাবেন। রাতের ভোট করতে কোন বাধাই থাকবে না।

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ। চট্টগ্রামে মাইকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ চলছে। আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান বঙ্গবন্ধুর পক্ষে রেডিওতে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেছেন। কিন্তু স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংগঠক বেলাল মোহম্মদ বলছেন, যুদ্ধের সময় আমরা মাইনরদের পাশে একজন সামরিক মেজর প্রয়োজন।

জিয়া তখন জিপে বসে ফুলের পাঁপড়ি ছিঁড়ে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, বাংলাদেশ নাকি পাকিস্তান কোনটা আগামি!

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংগঠকেরা জিয়াকে কালুর ঘাট বেতার কেন্দ্রে নিয়ে যান। জিয়া বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। এরপর কালুরঘাটে পাকিস্তানি দখলদার সেনারা হামলা করলে, জিয়া বাহুবলির মতো ট্রান্সমিটার তুলে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে রেখে আসেন।

স্বাধীন দেশে ‘এদেশ কেন এখনো স্বর্গ হলো না’ এই আক্ষেপে তরুণেরা অস্থির। চারিদিকে চোরের খনি ও চাটার দলের বাড়াবাড়ি। বঙ্গবন্ধু আশাহত; তবু একদলীয় শাসন এনে দেশটাকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা চেষ্টা করছেন। জিয়া একদলীয় সরকারের পক্ষে একটা আর্টিকেল লিখে ফেলেন।

ওদিকে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার জন্য ঘুরছে তারই ঘনিষ্ঠ অনুচরেরা। কাছের লোক বাঁশ হবার জনপদ এটা। জিয়া আবার লনে বসে ফুল ছিঁড়ে আগামির সিদ্ধান্ত নিতে চেষ্টা করেন। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলেই বলেন, গো এহেড গো এহেড।

জিয়া তাকে সুপারসিড করে আরেকজনকে সেনাপ্রধান বানানোর আক্ষেপে ‘বঙ্গবন্ধু হত্যার পর’ ভাবেন, এই তো সেনাপ্রধান হবার সুযোগ এলো।

কিন্তু খালেদ মোশাররফেরা জিয়াকে গৃহবন্দী করলে; জিয়া নার্ভাস হয়ে কর্ণেল তাহেরকে ফোন করেন। কর্ণেল তাহের জিয়াকে মুক্ত করে দেশের ক্ষমতা তার হাতে দিয়ে দেয়া মাত্র জিয়া ম্যাকিয়াভেলির গ্রন্থ খুলে বসেন। বিপ্লব ও প্রতিবিপ্লবের পর বিপ্লবীদের বাঁচিয়ে রাখতে নেই; ফলে ক্যাঙ্গারু আদালতে তাহেরের ফাঁসি হয়ে যায়।

এরপর জিয়া তার সঙ্গে সহমত না হলেই ক্যাঙ্গারু আদালত বসিয়ে ফাঁসি দিতে শুরু করেন। আর তৈরি করেন এক রাজনৈতিক গবেষণাগার। সেইখানে নানারকম খুশিজল তৈরি হয়। বহুদলীয় গণতন্ত্রের ককটেল পার্টি চলতে থাকে চারিদিকে। উনি গর্বের সঙ্গে বলেন, আই উইল মেইক পলিটিক্স ডিফিকাল্ট।

সুতরাং হাউজি খেলার প্রচলন হয়। জুয়া খেলার নেশায় উন্মত্ত হয়ে ওঠে জামায়াত ও বিএনপি। আর আওয়ামী লীগ জেলে বসে বা বাসায় বসে টুল টুল করে তাকিয়ে দেখে সেই ক্যাসিনো ফেস্ট। মনে মনে বলে, দেখে নিস একদিন আমরাও।

জিয়া পাকিস্তান ও ভারত উভয় দেশের গোয়েন্দাদের প্রিয় ব্যক্তি এরশাদকে সেনা-প্রধান করেন। বালুচ বিচ্ছিন্নতাবাদি আন্দোলন থেকে মনিপুর-নাগাল্যান্ড বিচ্ছিন্নতাবাদি আন্দোলন সব জায়গায় খুশিজল ছিটিয়ে পাকিস্তান-ভারতকে দুর্বল করে দেন।

বঙ্গবন্ধু আইকনটিকে জাদুকর ডেভিড কপারফিল্ডের মতো পর্দা দিয়ে ডেকে দেন। জনগণ যেহেতু ফিডার বেবি; তারাও জিয়ার ফাঁদে পা দেয়। জিয়া চীনকে ডেকে বলেন, আজি হতে সাড়ে তিনদশক পরে রোহিঙ্গাদের বার্মা থেকে পিটিয়ে ভাগিয়ে দিতে হবে। মনে রাখবেন, মাও সে তুং বলেছেন, অস্ত্রই সকল ক্ষমতার মূল।

জিয়ার গবেষণাগারের শরবত খেয়ে সেই যে বৃটিশের ‘বণিকের মানদণ্ডকে রাজদণ্ড’ করার প্রতিযোগিতায় বিএনপি ও আওয়ামী লীগ দৌড়াতে থাকে; এখন বাংলাদেশের ৯২ শতাংশ সাংসদ ব্যবসায়ী। রাজনীতিকের চিহ্ন মাত্র নেই রাজনীতিতে।

‘জিয়া হত্যাকাণ্ডের’ একটি নিখুঁত নাটক রচিত হয়। কিন্তু কেউ জানে না জিয়াই সেকেন্ড হোম কনসেপ্টের জনক। কাজেই পৃথিবীর কোথায় কোন সেকেণ্ড হোমে বসে বাংলাদেশ রাজনীতির কলকাঠি নাড়ছেন তিনি; তা আর কেউ জানে না।

কেবল সমকালের ‘রাতের ভোটের’ মাঝে জিয়ার ‘হ্যা-না’ ভোটের ছায়া দেখে চমকে ওঠে মানুষ।

মাসকাওয়াথ আহসান, লেখক ও সাংবাদিক।

ঢাকা জার্নাল, নভেম্বর ১৫, ২০১৯