প্রাণীজগতের স্বাধীনতা সংঘ

এপ্রিল ১২, ২০১৩

people-bg20130330064206মিরপুর চিড়িয়াখানার শিম্পাঞ্জির খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। আমরা যেভাবে হাত দিয়ে কমলার খোসা ছাড়িয়ে খাই, শিম্পাঞ্জিও কমলা খাচ্ছিলো অনেকটা সেভাবে। হঠাৎ শুনি আমার ঠিক পাশেই এক ছোট্ট বন্ধু তার বাবাকে বলছে, “বাবা, শিম্পাঞ্জিটা নিশ্চয়ই খুব খারাপ কাজ করেছিলো। নাহলে জেলখানায় থাকবে কেনো?” ছেলেটির বাবা কি উত্তর দিয়েছিলো তা মনে নেই; কিন্তু আমার আসলেই প্রশ্ন জেগেছিলো শিম্পাঞ্জিটাকে বিনা অপরাধে এভাবে আটকে রাখা আদৌ উচিত কি না।

তোমাদের কি কখনো মনে হয়েছে, প্রাণীদেরও অনুভূতি থাকতে পারে, ব্যথা থাকতে পারে কিংবা পারস্পারিক ভালোবাসা থাকতে পারে? প্রাণীদেরও পরিবার থাকতে পারে, ব্যক্তিত্ব থাতে পারে, ইচ্ছে থাকতে পারে? চিড়িয়াখানাতে, বৈজ্ঞানিক বিভিন্ন পরীক্ষাগারে, বাসাবাড়ির খাঁচায় যে সমস্ত বন্যপ্রাণীকে পোষ না মানিয়ে আটক রাখা হয়; সেসব প্রাণীর কি ইচ্ছে করে না, আবার তাদের পরিবারে ফিরে যেতে? এসব প্রশ্নকে সামনে রেখেই একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা “প্রাণীজগতের স্বাধীনতা সংঘ” বা Animal Liberation Front, সংক্ষেপে এএলএফ।

প্রাণীজগতের নৈতিক অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে অনেকগুলো সংস্থা আছে। অনেক বিশ্ববিখ্যাত সংস্থার নাম হয়তো তোমরা জানো। কিন্তু এই সংস্থাটির নাম কেনো বিশেষভাবে বলছি? কারণ, এর কাজের ধরন। শুধু প্রাণীদের অধিকার আদায়ের জন্য চিৎকার চেঁচামেচি করেই এরা ক্ষান্ত নয়। বরং এরা প্রাণীদের পক্ষ থেকে অত্যাচারকারী মানবজাতির বিরুদ্ধে একরকম যুদ্ধ ঘোষণা করেছে!

ভাবছো সংঘটি কি প্রাণীরাই চালাচ্ছে নাকি? না। প্রাণীরা পারছে না, এটি চিন্তা করে মানুষই তাদের পক্ষে এটি চালাচ্ছে। জানতে চাও, যুদ্ধটা তারা কীভাবে করছে? বিভিন্ন পরীক্ষাগার, খামার থেকে বিপন্ন প্রাণীদের উদ্ধার করে তারা তাদের বিশেষ আবাসন আর পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করছে। কখনোই উদ্ধার প্রক্রিয়াটি সোজা হয় না। হয় চুরি করে মুক্ত করতে হয় প্রাণীগুলিকে; এমনকি অস্ত্র ব্যবহার করে মালিকদের ভয় দেখিয়ে প্রাণীদের মুক্ত করতেও পিছপা হয় না এএলএফ।

এএলএফ এর সবচেয়ে বিখ্যাত গল্পটি অবশ্য একটি ব্যর্থ গল্প। চলো সেটি শোনা যাক।

এডওয়ার্ড টব নামের একজন মন-বিশেষজ্ঞ ১৭টি ম্যাকাক বানর (macaques) নিয়ে একটি গবেষণা করছিলেন। বানরের এই প্রজাতিটি অত্যন্ত বুদ্ধিমান প্রজাতি। তবে গবেষণাটি করার সময় তিনি বানরদের যেভাবে ব্যবহার করেছিলেন, সেই প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত নিষ্ঠুর। বানরদের হাতের পায়ের স্নায়ু কেটে ফেলা হতো— দেখা হতো মাথা তারপরেও হাত-পাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে কি না। সবচেয়ে করুণ হলো, তাদের রাখা হতো আলো-বাতাস নেই এমন ঘরে, নড়ারও জায়গা নেই এমন খাঁচার মধ্যে, কোনো চিকিৎসা ছাড়াই। পরীক্ষাটি চলছিলো সম্পূর্ণ গোপনে।

এদিকে এরই মধ্যে এডওয়ার্ড টবের সহকারী হিসেবে গবেষণায় যোগ দেন অ্যালেক্স পাচেকো। অ্যালেক্স এবং তার কয়েকজন বন্ধুর একটি সংগঠন ছিলো People for Ethical Treatment of Animals, সংক্ষেপে পিইটিএ। প্রাণীদের যাতে অপব্যবহার না করা হয় সেজন্য তারা কাজ করতো। অ্যালেক্স মূলত সংগঠনটির স্পাই হিসেবে গবেষণায় ঢোকেন। সেখানে তিনি বানরদের অবস্থা দেখে বিস্মিত হন।

অ্যালেক্সের সহায়তায় সেখানে পুলিশ ঢোকে, এডওয়ার্ড টবের বিরুদ্ধে গোটা ছয়েক মামলা হয়, তার জরিমানা হয়। তবে বানরদের আর সুস্থ জীবনে আনা সম্ভব হয়নি। অ্যালেক্স ও তার বন্ধুদের পিইটিএ পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক সংগঠন এএলএফ-এ পরিণত হয়। এডওয়ার্ড টবের গবেষণাও বিফলে যায়নি। স্ট্রোক করে অচল হয়ে পড়া রোগির চিকিৎসায় এ গবেষণা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

আমরা যেসব ওষুধ খাই, তার প্রত্যেকটি আবিষ্কার করার জন্য অনেক প্রাণীকে অসুস্থ হতে হয়, জীবন দিতে হয়। আমাদের আমিষের অভাব মেটাতে প্রাণীদের জীবন দিতে হয়। আমাদের আনন্দ দিতে প্রাণীদের বন্দি থাকতে হয় খাঁচায়।

উপায়টা একটু অদ্ভুত হলেও, এসব প্রাণীর কিছু অংশকে মুক্তি দিতে কাজ করে চলেছে এএলএফ। একটি খাঁচার পাখিকে আকাশে উড়িয়ে দিতে আমরা যে আনন্দ পাই, মনে হয় এএলএফ-এর সদস্যরা তাদের কাজ করে সেই শান্তিটাই পায়।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.