‘সহায়ক’ মানে ‘অসহায়’ সরকার

জুন ১১, ২০১৭

আমীন আল রশীদ ।। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি থেকে সরে এসে বিএনপি এখন বলছে, জাতীয় নির্বাচন হতে হবে ‘সহায়ক’ সরকারের অধীনে। সেই ‘সহায়ক সরকার’ কেমন হবে, তার একটা রূপরেখাও বিএনপি দেবে বলে শোনা যাচ্ছে। তবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘সহায়ক সরকারের কোনও বিধান সংবিধানে নেই। পৃথিবীর কোনও গণতান্ত্রিক দেশে সহায়ক সরকারের বিধান নেই। নির্বাচনকালীন নির্বাচন কমিশনই মূল বিষয়। নির্বাচন কমিশনের অধীনেই নির্বাচন হবে।’
তিনি বলেন,‘অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের মতো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার রুটিন ওয়ার্ক দায়িত্ব পালন করবে।’ তিনি বিএনপিকে ‘আশ্বস্ত’ করে বলেন, ‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ যেসব মন্ত্রণালয় নির্বাচনি কাজে সহায়তা করবে সেই সব মেশিনারিজ নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। কাজেই বিএনপির ভয় পাওয়ার কোনও কারণ নেই।’
সংবিধান অনুযায়ী, ২০১৯ সালের ২৯ জানুয়ারির মধ্যে একাদশ সংসদ নির্বাচন হতে হবে। শোনা যাচ্ছে আগামী বছরের জানুয়ারির শেষদিকে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার। কিন্তু আলোচনাটা বারবার ঘুরে ফিরে সেই একই বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে যে, কার অধীনে নির্বাচন হবে? সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল এবং পঞ্চদশ সংশোধনীর ফলে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক বা নির্বাচনকালীন অন্য কোনও নির্দলীয় সরকারের সুযোগ নেই। ভোট হবে সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে। এই সময়ের মধ্যে সরকার পদত্যাগ করে যে অন্য কারও ওপরে দায়িত্ব দেবে, এমন কোনও বিধানও নেই। তার মানে সংবিধান অনুযায়ী ভোট হবে বর্তমান সরকারের অধীনেই। আরও স্পষ্ট করে বললে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকা অবস্থাতেই। এর ব্যত্যয় ঘটাতে চাইলে সংবিধানে সংশোধন আনতে হবে।

বিএনপি যে সহায়ক সরকারের কথা বলছে, সংবিধানে সরাসরি সেরকম কোনও বিধান না থাকলেও যে সরকারের অধীনেই নির্বাচন হোক না কেন, তারা নির্বাচন কমিশনকে একটি সুষ্ঠু ও প্রভাবমুক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠানে সহায়তা করবে, এটিই গণতান্ত্রিক রীতি। যদিও নির্দলীয় সরকার ছাড়া রাজনৈতিক সরকারের অধীনে যে প্রভাবমুক্ত নির্বাচন হয় না, তার অনেক উদাহরণ এরইমধ্যে তৈরি হয়েছে। আবার রাজনৈতিক সরকারের অধীনে যে ভালো নির্বাচন হয়, সেই উদাহরণও নারায়ণগঞ্জ ও কুমিল্লা সিটিতে দেশবাসী দেখেছে। অর্থাৎ নির্বাচনে কোনও প্রভাব বিস্তার করবে কিনা করবে না, তার পুরোটা নির্ভর করে সরকারের সদিচ্ছা ও আন্তরিকতার ওপরে। সরকার কতটা গণতান্ত্রিক এবং জনমতের প্রতি কতটা শ্রদ্ধাশীল, তার ওপরে নির্ভর করে সে জাতীয় নির্বাচনে কোনও প্রভাব বিস্তার করবে কী করবে না।

সিটি করপোরেশন বা অন্যান্য স্থানীয় সরকার নির্বাচনের জয়-পরাজয়ের সঙ্গে সরকার পরিবর্তনের কোনও সম্পর্ক না থাকায় সেসব নির্বাচনে সরকারের নিরপেক্ষতায় ক্ষতি নেই। বরং তারা নিরপেক্ষ থেকেই এই বার্তা দিতে চায় যে, তাদের অধীনে জাতীয় নির্বাচনও অবাধ ও সুষ্ঠু হবে। কিন্তু জাতীয় নির্বাচন যেহেতু সরকার পরিবর্তনের সাথে সম্পর্কিত, সে কারণে সেই নির্বাচনে সরকার আখেরে কতটা নিরপেক্ষ থাকবে এবং নির্বাচন কমিশন আসলেই কতটা প্রভাবমুক্ত থাকবে বা থাকতে পারবে, সেটিই চ্যালেঞ্জ এবং এ কারণেই আসে নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের প্রসঙ্গ। সেটি নামে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার হোক কিংবা অন্য কিছু্।

যুক্তরাজ্যে ৮ জুন অনুষ্ঠিত মধ্যবর্তী নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলেও টিকে গেছেন প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে। যদিও এই মধ্যবর্তী নির্বাচনের ব্যাপারে তার ওপরে কোনও চাপ ছিল না। যেমন ছিল না তার পূর্বসূরী ডেভিড ক্যামেরনের ক্ষমতা ছাড়ার ওপরে। কিন্তু ব্রেক্সিট ইস্যুতে গণভোটে হেরে যাওয়ায় তিনি আর প্রধানমন্ত্রী পদে থাকাটা নৈতিক মনে করেননি। করেননি বলেই ২০১৫ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দ্বিতীয় মেয়াদ শুরুর মাত্র এক বছরের মাথায় পদত্যাগ করেন। এরপর দায়িত্ব নেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থেরেসা মে। আরও অন্তত তিন বছর ক্ষমতায় থাকার কথা ছিল তার। কিন্তু এরইমধ্যে তিনি যে মধ্যবর্তী নির্বাচন দিলেন। নির্বাচন আহ্বানের সময় তিনি বলেছিলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে বিচ্ছেদের আলোচনায় ব্রিটেনের পক্ষে শক্ত দর-কষাকষির জন্য যে দৃঢ় নেতৃত্ব প্রয়োজন, সেই ম্যান্ডেটের জন্যই এই নির্বাচন। জনগণ তাকে সেই ম্যান্ডেট দিয়েছে।

ব্রিটেনের এই নির্বাচন হয়েছে ক্ষমতাসীনদের অধীনেই এবং তারা নির্বাচনে কোনও প্রভাব বিস্তার করেনি। সেটি ব্রিটেনে সম্ভবও নয়। বরং নির্বাচনে ক্ষমতাসীনরা বরাবরই সহায়তা করে। এটিকেই বলে নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার। গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের যে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বহুল বিতর্কিত ডোনাল্ড ট্রাম্প জয়ী হলেন, সেই নির্বাচন চলাকালীন প্রেসিডেন্টের চেয়ারে ছিলেন বারাক ওবামা। কিন্তু বিরোধী রিপাবলিকানরা কখনও বলেনি যে, ওবামার অধীনে নির্বাচনে যাবো না বা নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার চাই। বলেনি এ কারণে যে, রিপাবলিকান এবং ডেমোক্র্যাট সবাই জানে, ক্ষমতায় যে দলই থাকুক, নির্বাচনে তারা খুব বেশি প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না। কারণ তাদের ভোটিং সিস্টেমই এমন যে, সেখানে টুকিটাকি কিছু অভিযোগ শোনা গেলেও ভোটে ফল উল্টে দেওয়ার মতো ডাকাতি হয় না। কিন্তু আমাদের দেশেরে সব রাজনৈতিক দলই বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় ভোট নিয়ে চিন্তিত থাকে। কারণ তারা ভোটের ব্যাপারে ক্ষমতাসীনদের বিশ্বাস করে না। বিশ্বাস করে না কারণ, তারাও যখন ক্ষমতায় ছিল ওই একই কাজ করেছে, কম আর বেশি। সে কারণেই তারা নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা বলে, সহায়ক সরকারের কথা বলে। আখেরে সবই অবিশ্বাস আর আস্থাহীনতার ফল।

আমরা একটু বোঝার চেষ্টা করি যে, নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার মানে আসলে কী হওয়া উচিত? বস্তুত সহায়ক সরকার মানে ‘অসহায় সরকার’। অর্থাৎ নির্বাচনকালীন সরকার থাকবে ক্ষমতাহীন। ভোটের যাবতীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনা এবং প্রশাসনের যাবতীয় বিষয়াদি নিয়ন্ত্রণ করবে নির্বাচন কমিশন; সেখানে সরকারের কোনও খবরদারি থাকবে না। সরকার কেবল রুটিন ওয়ার্ক করবে। নির্বাচন কমিশন যে হুকুম করবে সেটি তামিল করবে। মাঠ প্রশাসন চলবে নির্বাচন কমিশনের কথায়। অর্থাৎ ভোটের সময় প্রধান নির্বাচন কমিশনারই বস্তুত প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করবেন। আর রাষ্ট্রের অভিভাবক হিসেবে রাষ্ট্রপতি প্রয়োজনে তাকে (সিইসি) পরামর্শ দিতে পারেন। সহায়ক সরকার মানে নির্বাচন কমিশন যে ধরনের সহায়তা চাইবে, সরকার সেই সহায়তা দিতে বাধ্য। পুলিশ-প্রশাসনের কোথাও সরকার কোনও প্রভাব বিস্তার করবে না বা করতে পারবে না। সেটি নিশ্চিত করা গেলেই কেবল একটি অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন হতে পারে। আর একটি ভালো নির্বাচন মানে যেহেতু সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন, সুতরাং কার্যত রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় থাকলেও এবং প্রধানমন্ত্রী হিসেব শেখ হাসিনা দায়িত্বে থাকলেও নির্বাচন কমিশন যদি সত্যিকারেই তার দায়িত্ব পালনের মতো যোগ্য, ক্ষমতাবান এবং নিরপেক্ষ হয়, সেই নির্বাচন সবার কাছে গ্রহণযোগ্য না হওয়ার কোনও কারণ নেই।

কিন্তু দলগুলোর মধ্যে, বিশেষ প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে আস্থার সংকট কিভাবে কাটবে, সেটি দেশের রাজনীতিতে একটি বড় প্রশ্নবোধক চিহ্ন। রাখঢাক না রেখেই বলা যায়, এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় এ দুই দলের ভেতরে যে ঐক্য হয়েছিল, সেরকম ঐক্য বোধ হয় আর কখনোই সম্ভব নয়। বরং তাদের মধ্যে আস্থাহীনতা এবং প্রতিহিংসা ক্রমশ বাড়ছে। আর একটা সময় পর্যন্ত যে ধরনের ধর্মনিরপেক্ষতা আর প্রগতিশীলতার পক্ষে আওয়ামী লীগের শক্ত অবস্থান ছিল, সেই জায়গাটিও এখন বেশ নড়বড়ে এবং প্রশ্নের মুখে। অর্থাৎ বিএনপির সঙ্গে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক চিন্তা ও দর্শনের পার্থক্য কমে আসছে। ফলে দেশের ইসলামিক শক্তিগুলোর ওপরে নিয়ন্ত্রণ ইস্যুতে ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বিরোধ যে আরও বাড়বে এবং সংকটের নতুন ডাইমেনশন তৈরি হবে, সে বিষয়ে সন্দেহ কম। অতএব শুধু আগামী জাতীয় নির্বাচন কেমন হবে, সেটিই এখন আর একমাত্র প্রশ্ন নয়। এখন আরও বড় প্রশ্ন, রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ তার অসাম্প্রদায়িক আর প্রগতিশীল অবস্থান আদৌ ধরে রাখতে পারবে কি না?

লেখক: সাংবাদিক ও লেখক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.