হোটেল দ্য রেইন ট্রি
মে ১৩, ২০১৭ মাসকাওয়াথ আহসান । । নগরে উন্নয়নের অবিরাম বৃষ্টি; চারিদিকে সোনামাছ লাফ ঝাঁপ দিচ্ছে। যেসব প্রোলেতারিয়েতের কপাল খুলে তারা বুর্জোয়া হয়ে যাচ্ছে; তাদের এই ভরপুর উন্নয়ন বৃষ্টিতে একটু বৃক্ষের নীচে আশ্রয় দিতে একজন আইনপ্রণেতা খুলেছেন রোমান্টিক এক হোটেল। সেখানে কোনো বরাহ তার সন্তুষ্টির জন্য যা চাইবে তাই সরবরাহ করা হয়। বরাহ আর সরবরাহের বুলবুলি-আখড়াই-এ নব্য বাবুরা সেখানে আসে। আইন প্রণেতার ছেলেটি তার বন্ধুপ্রতিম সোনামাছদের জন্য ছাদে রোমান্টিক বৃষ্টি ও সাঁতারের পরিবেশ নিশ্চিত করে।
হঠাৎই দুজন তরুণীর করা পুলিশি অভিযোগে বুলবুলি-আখড়াই-এর রোমান্টিক আখড়াটির খবর বেরিয়ে আসে। খবরটা রোমান্টিক নয়। কারণ অভিযোগ ধর্ষণের। নগরের এক স্বর্ণকারের ছেলে আর তার দালাল বন্ধু “পিঁপড়াবিদে”র বিরুদ্ধে “জন্মদিনের পার্টিতে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে এসে দুই তরুণীকে ধর্ষণের” অভিযোগ লিপিবদ্ধ হয়।
খবরটা মিডিয়ায় চাউর হলে একজন অভিযুক্তের স্বর্ণকার পিতা মন্তব্য করে, সেইদিন সেখানে যদি কিছু ঘটে থাকে; তা সমঝোতার ভিত্তিতেই ঘটেছে।
খবরটা শুনে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বাসেত সাহেব বলে, মাইয়া মানুষ এতো রাইতে নামেহরামের লগে পাট্টিতে গেছে; নিশ্চয়ই এইখানে টাকা-পয়সা লেনদেনের ব্যাপার আছে।
বাসেত সাহেবের স্ত্রী আরো ক্ষেপে ওঠে, এইসব মাইয়ারে বিষ গুইলা খাওয়ানো উচিত। আমার মাইয়া হইলে তাই করতাম।
একজন উন্নয়ন হকার মন্তব্য করে, দেশটারে আগে জঙ্গির দেশ প্রমাণে ব্যর্থ হইয়া এখন উন্নয়নের শত্রুরা দেশটারে ধর্ষণের দেশ প্রমাণে উইঠা-পইড়া লাগছে। মাইয়াগুলি কী সাধু নাকী; নিশ্চয়ই ফাইভ স্টারে খাওনের লোভে গেছে; টেকাটুকার ব্যাপারও থাকতে পারে। এইডারে ধর্ষণ বলা একটা গভীর ষড়যন্ত্র।
একজন অনুভূতি গবেষক তার প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বলে, নারীরা বেশি স্বাধীনতা ভোগ করতে গিয়াই এইসব হইতেছে। পর্দা-পুসিদা সহযোগে ঘরে না থাইকা বাইরে ঢলাঢলি করতে গেলে এমন হইবোই।
একজন প্রগতিশীল নারী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাণীচিরন্তনীমুলক স্ট্যাটাস দেন, মেয়ে তুমি দেখে শুনে বন্ধু নির্বাচন করো। কোথাও যাবার আগে দু’বার চিন্তা করো।
এই এতোক্ষণের আলোচনায় কেউই উল্লেখ করেনা; যে ছেলে বন্ধুটি মেয়ে দুটিকে বার বার ফেসবুক মেসেঞ্জারে অনুরোধ করে এই “বৃষ্টি ও আসল পুরুষ”দের ডেরায় নিয়ে আসে; সেই ছেলে সমাজের প্রচলিত মানদণ্ডে সম্ভ্রান্ত ঘরের ছেলে; স্বর্ণকারের ছেলেটি শহরের সেরা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল থেকে পাস করা; আর স্বর্ণকারের ছেলের দালাল বন্ধুটি পিঁপড়াবিদ্যায় পারদর্শী। গোটা শহরে ঘুরে ঘুরে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে একটু পরিচিত মহলের নারী-পুরুষদের সঙ্গে ছবি তুলে বেড়ায়। মিডিয়ার এনটারটেইনার হিসেবে নব্য বুর্জোয়াদের সবরকমের প্রত্যাশা পূরণে রোমান্টিক এনটারটেইনমেন্টের উদ্যোক্তা সে। পিঁপড়া বিদ্যা দিয়ে সে পুরো শহরের চোখে ধোকা দিয়েছে; সেখানে দুটি তরুণী কী করে বুঝবে এরা বন্ধু নয় দানব। এদের কাছে বন্ধুত্ব মানে ধর্ষণ।
পিঁপড়াবিদের আরেক সাবেক আইন প্রণেতার সঙ্গে ঘনিষ্টতার ছবি ও আওয়াজে তার পিতার নামটি অজ্ঞাত থেকে যায় পুলিশের কাছে। সে ক্ষমতাবৃক্ষের দত্তক নেয়া পুত্র হিসেবে ধরাছোয়ার বাইরে থেকে যায়। কয়েকদিনের সময় ক্ষেপনের পর ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্ত স্বর্ণকার পুত্র ও যে ছেলেটির সঙ্গে বন্ধুত্বের ভিত্তিতে মেয়ে দুটি ঐ জন্মদিনের পার্টিতে এসেছিলো; এইদুজন ধরা পড়ে যায়। কিন্তু পিঁপড়াবিদ রয়ে যায় অধরা। অনেকটা সময় পেয়েছে সে পিঁপড়ার গর্তে লুকিয়ে পড়তে।
স্বর্ণকারের ছেলের নিকটাত্মীয় অবশ্য একজন ক্ষমতা জ্যোতিষী। ক্ষমতা বন্ধুর বাসায় স্বর্ণকারের ছেলেটিকে তার সহযোগীসহ লুকিয়ে রেখেছিলো সে। আর মিডিয়াকে ডেকে দম্ভের সঙ্গে বলেছে, মেডিক্যাল পরীক্ষায় কিছুই পাওয়া যাবে না। তখন খেলা হবে।
মিডিয়ায় ওই ক্ষমতা বাড়িতে লুকিয়ে রাখার খবরে বিরক্ত হয় ক্ষমতা হকারেরা। তারা বলে, সব কিছুতেই ক্ষমতারে না জড়াইলে মিডিয়ার পেটের ভাত হজম হয় না।
এক লোক ক্ষমতা হকারকে মনে করিয়ে দেয়, ঘটনা ঘটেছে ক্ষমতার হোটেলে, ক্ষমতার ছেলে ঘটনার রাতে ঘটনাস্থলে স্বর্ণকারের ছেলেটিকে ফুল দিয়ে এসেছে; ক্ষমতার ছেলের মাধ্যমেই হোটেলে রুম বুকিং দেয়া হয় বলে মিডিয়ায় খবর এসেছে। আরো ক্ষমতারা এই বৃষ্টি বৃক্ষের বুলবুলি-আখড়াই-এ আসে; এসব খবরও মিডিয়ায় আসছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যারা ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছে; অনুসন্ধানী সিটিজেন জার্নালিজম করে ঘটনা জানাতে চেষ্টা করেছে; তাদের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নেমে পড়ে উন্নয়ন ও ক্ষমতার সাইড কিক গ্যাং-এরা। তারা সমস্বরে বলে,
–এদের কথা বিশ্বাস করবেন না। এরা উন্নয়নের শত্রু।
অবশ্য দুজন আসামি গ্রেফতার হবার পর প্রতিবাদীরা কিছুটা শান্ত। প্রাথমিক খবরে জানা যায়, স্বর্ণকারের ছেলে ও তার সহযোগী ধর্ষণের দায় স্বীকার করেছে। ক্ষমতার হোটেলেই এই ধর্ষণের উপযোগী রোমান্টিক বিভীষিকার পরিবেশ তৈরি করা হয়েছিলো এটাও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
এক ফেসবুক বিবেক চুপ করে থাকতে থাকতে দমবন্ধের উপক্রম হলে অকস্মাত বলেই ফেলে, যাই কন মাইয়াগুলিরও দোষ আছে!
লেখক: ব্লগার ও প্রবাসী সাংবাদিক
ঢাকা জার্নাল, মে ১৩, ২০১৭।