টার্গেটে ব্লগাররা, নেপথ্যে কে?

এপ্রিল ৯, ২০১৩

mmnঢাকা জার্নাল: বাংলা ব্লগের যাত্রা শুরু ২০০৫ সালে। বলা হয়, সে সময়ে সারাদেশে সব জেলায় একযোগে ৫শ’ বোমা বিস্ফোরিত হয়। ওই ঘটনায় তাৎক্ষণিক সংবাদের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু কোনোভাবেই সঠিক সংবাদ পাওয়া যাচ্ছিল না। ঠিক তখনই সামহোয়্যার ইন ব্লগ জন্মের প্রক্রিয়া শুরু হয়। যদি তাই হয় তবে বলেই দেওয়া যায়, মৌলবাদের বিরুদ্ধেই বাংলা ব্লগের জন্ম।

আট বছরের মাথায় ২০১৩ সালে ব্লগসংখ্যা ১শ’ ছাড়িয়ে গেছে। আজ বাংলা ব্লগ থেকেই মৌলবাদ, যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী অগ্নিশিখা ছড়িয়ে গেছে সারাদেশে। সরকারও এর পক্ষে ছিল। সংসদে খোদ প্রধানমন্ত্রী গণজাগরণের পক্ষে কথা বলেছেন। অনেক রাজনীতিবিদও পক্ষেই অবস্থান নিয়েছিলেন।

কিন্তু বিপদ হলো ধর্ম ইস্যু। ধর্মীয় ইস্যু দিয়ে বিভ্রান্ত করা হলো আমজনতাকে। দাঁড়িয়ে গেল হেফাজতে ইসলাম নামে একটি ধর্মাশ্রয়ী সংগঠন। যাদের কোনো কার্যক্রম কখনও চোখে পড়েনি, সেই হেফাজতে ইসলাম এখন বাংলাদেশের রাজনীতিতে যেন বড় এক আতঙ্কের নাম। বিএনপি বা জামায়াত ছাড়িয়ে এখন হেফাজতই যেন দেশের প্রধান বিরোধী দল। বিরোধী দলের কোনো নেতাও কথা বলছেন না এ নিয়ে। সবাই যেন মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছেন।

তবে এরই মধ্যে বড় ঘটনাটি হলো ব্লগারদের উপর নির্যাতন। এখন পর্যন্ত ৪ জন ব্লগারকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সুস্পষ্ট কোনো প্রমাণ না থাকলেও বলা হচ্ছে, তারা ইসলামবিরোধী লেখা দিয়ে উস্কানি দিয়েছেন। তার আগে আরও ভয়াবহ কাজটি হয়েছে ৮৪ জনের একটি তালিকা নিয়ে। বলা হয়েছে, তালিকাটি নাস্তিক ব্লগারদের তালিকা। তথ্য প্রমাণ ছাড়া সরকার সে তালিকা সংবাদমাধ্যমেও প্রকাশ করে দিয়েছে।

এ তালিকা কারা করেছে কিংবা কিসের ভিত্তিতে তৈরি হয়েছে তা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করছেন ব্লগাররা। যদিও সংবাদমাধ্যম থেকে প্রাপ্ত খবরে দেখা যায়, কটূক্তিকারীদের শনাক্ত করতে গঠিত নয় সদস্যের কমিটির সঙ্গে আলেম সমাজের বৈঠকে এ তালিকা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ে হস্তান্তর করা হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, আলেম সমাজ কি ব্লগ বোঝেন?

ভয়াবহ বিষয়টি হলো, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় অভিযোগ জানানোর জন্য একটি ই-মেইল আইডি প্রকাশ করেছে। এতেই সরকারের দুরদর্শিতার অভাব প্রকট হয়েছে। যে কোনো নামে ওয়ার্ডপ্রেসে ভুয়া ব্লগ খুলে সেখানে ধর্ম অবমাননাকর বিভিন্ন লেখা ঢুকিয়ে দেওয়া যাবে। সেই ভূয়া ব্লগের রেফারেন্স যদি সেই ই-মেইল ঠিকানায় পাঠানো হয় তখন ফেঁসে যাবে আরেকজন। অতএব সংশয় থেকেই যাচ্ছে।

এ তালিকা সম্পর্কে গবেষক, বিজ্ঞানলেখক, ব্লগার এবং মুক্তমনার প্রতিষ্ঠাতা ড. অভিজিৎ রায়  বলেন, “আমার কোনো ধারনা নেই, কে তালিকা করে দিয়েছে। হতে পারে সরকারের পক্ষ থেকে কেউ কিংবা হতে পারে ব্লগারদের মধ্যকার কেউ। যাদের মুক্তমত জিনিসটা পছন্দ হয়নি। এরকম অনেকেই তো আছেন চারপাশেই।

তিনি বলেন, “মুক্তচিন্তার কেউ আক্রান্ত হলে তারা হাততালি বাজান। ‘থাবাবাবা’ মারা যাবার পর ঈমামকেও হত্যার ফতোয়া দেওয়া ব্লগার তো দেখেছি আমরা। কাজেই তালিকা যে কেউই করতে পারেন।”

ড. অভিজিৎ বলেন, “আমি শুনেছি, গনজাগরণ মঞ্চের পর ব্লগারদের ছবি দিয়ে ক্রমাগতভাবে আমার দেশ পত্রিকাটিতে যে বিষোদগার করা হয়েছিল, সেটাও নাকি এরকম একজন করেছিলেন। ব্লগ থেকে কিছু স্ক্রিন শট কপি করে আমার দেশে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। আর সরকার কিংবা বিটিআরসি থেকেই যখন ই-মেইল দিয়ে সহায়তা চাওয়া হল, তখন যে কেউই এভাবে যে কারো বিরুদ্ধে কিছু পাঠিয়ে দিতে পারেন। জিঘাংসামুলক অভিসন্ধি থেকেই যে এটা করা হয়েছে তা নিশ্চিত, সেটা যে পক্ষই করুক।”

অন্যদিকে ব্লগের উপর সরকারের প্রথম খড়গটি নেমে আসে জনপ্রিয় ব্লগ ‘আমার ব্লগ’-এর উপর। আমার ব্লগের কাছে সরকারের পক্ষ থেকে বেশ কয়েকজন ব্লগারের তথ্য উপাত্ত চাওয়া হয়। কিন্তু আমার ব্লগ কর্তৃপক্ষ ব্লগার নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে তথ্য দেয়নি। এরপরই বাংলাদেশে আমার ব্লগ বন্ধ হয়ে যায় কোনো পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই।

আমার ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা সুশান্ত দাসগুপ্ত  বলেন, “এই তালিকার দিকে নজর দিলে দেখা যায়, বেশিরভাগ ব্লগাররাই বর্তমানে ইন-অ্যাকটিভ। অনেকেই ব্লগিং ছেড়ে দিয়েছেন। এ থেকে বোঝা যায়, যে বা যারা এ লিস্ট দিয়েছে সে বা তারা পুরনো ব্লগার। তারা প্রথম থেকেই এ ধরনের লিস্ট করে আসছে এবং প্রতিনিয়ত সেই লিস্ট আপডেটেড করেছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, বাংলাব্লগে জামায়াত শিবির জড়িত।”

এই ৮৪ জনের কোন ক্ষতি হলে হুকুমের আসামি করা উচিত জামায়াত ও হেফাজতে ইসলামের মতো দলগুলোর নেতাদের। শুধু তাই নয়, বিটিআরসি ও সরকার এর দায় এড়াতে পারে না।

এছাড়াও গ্রেফতার হওয়া ব্লগার রাসেল পারভেজের স্ত্রী ড. আসমা বেগম তার স্বামী সম্পর্কে  বলেন, “রাসেল কখনোই ধর্ম নিয়ে উস্কানিমুলক কিছু লেখেনি। বরং রাসেল ধর্মের বৈজ্ঞানিক যৌক্তিক বিষয় বিশ্লেষণ করেছেন। সেটা মোটেও উস্কানিমুলক নয়।”

এছাড়াও ৮৪ জনের তালিকা সম্পর্কে ড. আসমা বলেন, “এ তালিকা সম্পর্কে কিছুই জানি না। জানতে চাইও না। কে এই তালিকা করেছে সেটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ সরকার এ তালিকা গ্রহণ করেছে স্পষ্ট কোন ব্যাখ্যা ছাড়াই। তবে যারা এ তালিকা করেছে তারা সরকারের মন্দ করার জন্যই করেছে।”

এভাবেই ব্লগার ও তাদের পরিবারের মধ্যে চলছে উৎকণ্ঠা। অনেক ব্লগার ও ব্লগ মডারেটর এ নিয়ে কোনো কথাই বলতে চান নি। আবার অনেকে বলেছেন, তারা শংকিত, আতংকিত।

একইসঙ্গে এ তালিকা নিয়ে তারা বলেন, এ তালিকা প্রকাশ করে ৮৪ জন মানুষকে চিরজীবনের জন্য হুমকির মুখে ঠেলে দেওয়া হলো। এদের মধ্যে কেউ যদি নির্দোষ প্রমাণও হয় তারপরও তাদের জীবন হুমকির মুখে চলে গেল। এমনকি এ তালিকায় এমন অনেক ব্লগার আছেন যারা ধর্ম নিয়ে যৌক্তিক-অযৌক্তিক কোনো কিছুই লেখেন নি। তারপরও তাদের নাম তালিকায় আছে। ঠিক কি কারণে তালিকায় তাদের নাম আছে তা এখনও অস্পষ্ট।

গণজাগরণ আন্দোলনের শুরুতে অনেক ব্লগারকে সরকার গানম্যান দিতে আগ্রহী ছিল। (কিন্তু ব্লগাররা গানম্যান নিতে রাজি হন নি। কারণ শত শত ব্লগারের জীবন জামায়াত-শিবিরের হুমকির মুখে। তার মধ্যে ২০-২৫ জনের জন্য গানম্যান তারা নিতে চান নি।) অথচ সেই সরকার দুই মাসের মাথায় ব্লগারদের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে তাদের গ্রেফতার করছে। যা সত্যিকার অর্থে বিস্ময়করও বটে। ধর্মের বিরুদ্ধে কুৎসা রটিয়ে উস্কানি দিয়েছেন বলে যাদের নামে অভিযোগ তোলা হচ্ছে, তারা আসলেই উস্কানি দিয়েছেন কি না- সে বিষয়ে নিশ্চিত কোনো তথ্য প্রমাণ ছাড়াই ব্লগার গ্রেফতার মুক্তচিন্তার উপর আঘাত বলেই মনে করছেন ব্লগার ও প্রগতিশীল মানুষ।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.