হাইজেনিক রিলেশন ও নারীর এসক্যাপ রুট

নভেম্বর ২২, ২০১৬

imageইশরাত জাহান ।।অনেকগুলো শব্দ বলি আমি। ‘কোয়ালিশন’ ‘হাইজেনিক রিলেশন’ ‘স্পেস দেওয়া’ ‘নাইসলি কুইট’ ‘পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ’। কিন্তু সমাধানসূত্র’র একেকটি প্রশ্নের ধাক্কায় আমি নিথর হয়ে যাই। এইসব বেছে খুঁজে ভেবে বের করা শব্দ মুহূর্তে ধোঁয়াটে হয়ে যায়, অর্থহীন হয়ে যায়। কি যাতনা বিষে বুঝিবে সে কিসে…। কোন মনোরোগ চিকিৎসক বা আমার মতো হোস্টের পক্ষে কোন উত্তর দেয়া সম্ভব হয় না।

নারীটির কণ্ঠ ভেজা ভেজা। বলেন, স্বামী অনেকদিন ধরে ইগনোর করে। অভিমানের দেয়াল উঠতে উঠতে এত উঁচু হয়ে গেছে যে আমি আর সে দেয়াল ডিঙাতে যাইনি। নিজের মধ্যে যে জগত তৈরি করার কথা বলেন আপনারা, আমি সেরকম জগত তৈরি করে নিয়েছিলাম। নিজের মতোই থাকতাম। আমার একটা ২১ বছরের মেয়ে আছে। এখন কদিন আগে আমার স্বামী জানিয়েছেন, তিনি আরেকটি বিয়ে করবেন। সবকিছু ঠিকঠাক। সব শুনে আমার মেয়েটা এতো হার্ট হয়েছে যে সে এখন সবার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। পড়াশোনাও ছেড়ে দিয়েছে। বলেন, এখন আমি কি করবো? স্পেস তো দিয়েছিলাম আমি, তাহলে এরকম হলো কেন? আমি আমার মা-বাবাকেও কিছু জানাইনি তাতে আমার স্বামীর সাথে আমার বাবা মায়ের সম্পর্কটা খারাপ হতো। এখন কি জানানো উচিত? আমি কিছুই করি না, এখন হয়তো বাবার বাড়িতে গিয়েই উঠতে হবে এই বয়সে।

আমি এবং আমার গেষ্ট মনোরোগ চিকিৎসক মেখোলা সরকার এতক্ষন যে কথার তুবড়ি ছুটাচ্ছিলাম দুজনেরই মন খারাপ হয়ে যায়। টেলিভিশনের ক্যামেরায় সেই মন খারাপ ধরা পড়ে কি না জানি না।

একজন পুরুষ, যার ২১ বছরের একটা মেয়ে আছে সে সগর্বে ঘোষণা দিতে পারে তার একটা প্রেম আছে এবং এখন সে বিয়ে করতে চায়। আগের সংসারের মায়েরে বাপ। পুরুষ তার প্রেম থাকলে স্পষ্ট বলার সাহস রাখে। সমাজ তাকে সেই স্পর্ধা দিয়ে রেখেছে।

এখন নারী আপনাকে বলি কি, যতদিন আপনি পার্টনারকে ‘স্বামী’ ভাববেন, আপনার ‘মালিক’ ভাববেন ততদিন এই সমস্যার সমাধান নেই। নিজেকে পার্টনারের সমকক্ষ না ভাবলে ইচ্ছে হলে সে আপনাকে ‘পুতুল পুতুল’ করে আদর করবে, শাড়ি-গয়না ইত্যাদি কিনে দেবে আবার ইচ্ছে হলে ছুঁড়েও ফেলে দেবে। যতদিন না আপনার ছুঁড়ে ফেলার সক্ষমতা অর্জন হবে ততদিন আপনিই নিক্ষিপ্ত হতে পারেন মনে রাখবেন।

আর এই যে মা-বাবাকে না জানিয়ে ‘স্বামীর’ সম্মান রক্ষা করা, আসলে আপনি কার সম্মান রক্ষা করলেন? বা করেন? কেন করেন? কেন কোন কাজ করেননি এতোদিন? স্বামী আপনাকে মাথায় করে রাখবে সেই আহ্লাদে? এইসব আহ্লাদ ভাঙার সময় তো এসেছে। তাছাড়া সম্পর্ক নানান কারণেই ভাঙতে পারে। আমি এই যে বলি হাইজেনিক রিলেশনের কথা। স্বামী বা স্ত্রী হয়তো আর আকর্ষিত হচ্ছেন না একে অপরের প্রতি। কিন্তু সামাজিক বা পরিস্থিতির কারণে ভাঙতেও পারছেন না বিয়ে। কি করবেন? পারষ্পরিক শ্রদ্ধাবোধ টিকিয়ে রেখে সংসারটা টেনে যাবেন? সেটা করতে পারলে ভালো, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেটা সম্ভব হয় না। এই যে এক্ষেত্রে যেমন সম্ভব হলো না। নারীটি তো নিজের মতো করে একটা জগত তৈরি করেছিলেন, কিন্তু দুরত্ব বাড়তে বাড়তে পুরুষটি একসময় জানিয়ে দিলেন তিনি বিয়ে করছেন। কোনরকম আলাপ আলোচনার ধার ধারলেন না। হতে পারে হয়তো পুরুষটির দিক থেকেও কোন যুক্তি আছে। কিন্তু এটা ঠিক পুরুষেরা খুব দৃঢ়তার সাথে এসব বলতে করতে পারেন, সমাজ অতটা রুড হন না তাদের প্রতি।

কিন্তু নারী? এইযে আপনি বললেন, নিজের একটা জগত গড়ে নিয়েছিলেন, আসলেই কি জগতটা নিজস্ব ছিল? পার্টনারের এই ঘোষণায় আপনার নিজস্ব বলে ভাবা জগতটাও অচেনা হয়ে যাবে না তো? আমি কিন্তু এটা খুব ভালোমতো বুঝতে পেরেছি, ক’দিন বাদেই আত্মীয়-স্বজনসহ পুরো পৃথিবী অচেনা হয়ে যাবে এই নারীর কাছে। স্বামী পরিত্যাক্ত হিসেবে ট্রিট হবেন তিনি।

প্রত্যেকটা মেয়েরই সম্ভবত আয়নার সামনে দাঁড়ানো উচিত। এইযে ‘স্বামী’ কেন্দ্রিক পৃথিবী, এই পৃথিবীকে সজোরে লাত্থি মারা উচিত। যত যাই কিছু ঘটুক নিজের পেশা, নেশা আর নিজস্বতার সাথে কোনরকম আপোষ না করা উচিত। তারপরেও কত কি ঘটতেই পারে। জীবন বিচিত্র, কিন্তু আস্থা আর বিশ্বাসের খেলাপ করে যে পুরুষ, যে ‘স্বামী’ তাকে সজোরে ছুঁড়ে ফেলে নিজ জীবনযাপনের একটা রাস্তা নারী আপনাকে রাখতেই হবে।

লেখক: সাংবাদিক

ঢাকা জার্নাল, নভেম্বর ২২, ২০১৬।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.