ইসি গঠন ও শক্তিশালী করতে খালেদার ২০ প্রস্তাব

নভেম্বর ১৮, ২০১৬

khalada4ঢাকা জার্নাল: সব রাজনৈতিক দলের মতামতের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন গঠন ও শক্তিশালী করতে ২০টি প্রস্তাব দিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।

একইসঙ্গে নির্বাচনকালীন সময়ে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয় ও প্রতিষ্ঠানের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে বেশকিছু সুপারিশ তুলে ধরেছেন তিনি।

শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর একটি হোটেলে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এই প্রস্তাব তুলে ধরেন খালেদা জিয়া।

আগামী ফেব্রুয়ারিতে শেষ হচ্ছে কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ। নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য আগেরবারের মতো সার্চ কমিটি গঠনের কথা বলছেন ক্ষমতাসীনরা।

তবে বিএনপি বলছে, সার্চ কমিটি গঠনের সব দলের মতামত নিতে হবে। ইসি গঠনের বিষয়ে বিএনপি আলাদা প্রস্তাব দেবে বলেও দলটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে।

এর আগে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য বিএনপির প্রস্তাব নিয়ে বৃহস্পতিবার রাতে দলের সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারণী  ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করেন খালেদা জিয়া।

সব রাজনৈতিক দলের ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে ইসি গঠনের দাবি জানিয়ে খালেদা জিয়া বলেন, সব নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল অথবা স্বাধীনতার পর কোনো না কোনো সময়ে জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব করেছে এমন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধির সঙ্গে রাষ্ট্রপতি আলোচনা করবেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য কমিশনারদের যোগ্যতা অযোগ্যতা ও মনোনয়নের প্রশ্নে ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত আলোচনা অব্যাহত থাকবে।

রাষ্ট্রপতি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐক্যমত্যের ভিত্তিতেই একটি বাছাই কমিটি করবেন, প্রস্তাব জানিয়ে তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতি সর্বজন শ্রদ্ধেয় সৎ, নিরপেক্ষ, অভিজ্ঞ, নৈতিকতা ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ব্যক্তিদের দ্বারা ৫ সদস্যের বাছাই কমিটি করবেন।

‘বাছাই কমিটির আহ্বায়ক হবেন অবসরপ্রাপ্ত প্রাক্তন বিচারপতি (জ্যেষ্ঠতা ক্রমানুসারে) আর সদস্য হিসেবে থাকবেন আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত একজন বিচারপতি, অবসরপ্রাপ্ত সৎ এবং দল নিরপেক্ষ একজন সচিব, (তবে অবসরপ্রাপ্ত মন্ত্রী পরিষদ সচিব এবং বিভিন্ন সময়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন এমন কোন কর্মকর্তা বাছাই কমিটির সদস্য হতে পারবেন না), অবসরপ্রাপ্ত সৎ এবং দল নিরপেক্ষ একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, সর্বজন শ্রদ্ধেয় দল নিরপেক্ষ একজন সৎ, দক্ষ ও যোগ্য জ্যেষ্ঠ নারী। তারা প্রত্যেকেই থাকবেন বিতর্কের উর্ধ্বে এবং অবসর গ্রহণের পর সরকারের কোন লাভজনক পদে ছিলেন না’, বলেন বিএনপি নেত্রী।

রাষ্ট্রপতি সঙ্গে বৈঠকে প্রত্যেক রাজনৈতিক দল বাছাই কমিটির সদস্য নিয়োগের জন্য প্রতি পদের বিপরীতে দুই জনের নাম ও পরিচয়সহ সুস্পষ্ট প্রস্তাব লিখিতভাবে পেশ করবে বলে প্রস্তাব রাখেন খালেদা জিয়া।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে একজন গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিকে নিয়োগের সুপারিশ করে এজন্য বেশকিছু যোগ্যতার সুপারিশ করেন বিএনপি নেত্রী।

‘সর্বজন শ্রদ্ধেয় সৎ, মেধাবী, দক্ষ, সাহসী, প্রাজ্ঞ এবং নৈতিকতা, ব্যক্তিত্ব ও কর্ম অভিজ্ঞতা সম্পন্ন এবং সকল বিচারে দল-নিরপেক্ষ এবং বিতর্কিত নন এমন একজন ব্যক্তি প্রধান নির্বাচন কমিশনার হবেন। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে অধিষ্ঠিত ছিলেন এমন একজন ব্যক্তি, অথবা বাংলাদেশ সরকারের একজন সচিব যিনি অবসর গ্রহণের পর সরকারের কোন লাভজনক পদে নিয়োজিত নহেন বা ছিলেন না, অথবা একজন বিশিষ্ট নাগরিক-প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হতে পারবেন’, বলেন তিনি।

তবে অবসরপ্রাপ্ত মন্ত্রিপরিষদ সচিব এবং বিভিন্ন সময়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন এমন কোন কর্মকর্তা প্রধান নির্বাচন কমিশনার পদে পদায়নের যোগ্য হবেন না বলেও প্রস্তাব রাখেন বিএনপি প্রধান।

নির্বাচন কমিশনার হিসেবে যেসব যোগ্যতার সুপারিশ করেছে খালেদা জিয়া, এর মধ্যে রয়েছে-

* একজন নারীসহ সর্বজন শ্রদ্ধেয়, সৎ, মেধাবী, দক্ষ, প্রাজ্ঞ, সাহসী, নৈতিকতা, ব্যক্তিত্ব ও কর্ম অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ও সকল বিচারে দলনিরপেক্ষ এবং বিতর্কিত নহেন এমন ব্যক্তিদের মধ্যে হতে চারজন নির্বাচন কমিশনার নিযুক্ত হতে পারবেন।

* ন্যূনপক্ষে জেলা জজের মর্যাদা সম্পন্ন অবসরপ্রাপ্ত বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা, ন্যূনপক্ষে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদমর্যাদা সম্পন্ন অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা, ন্যূনপক্ষে যুগ্মসচিব পদমর্যাদার অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা, সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী, প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা সম্পন্ন শিক্ষাবিদ এবং সর্বজন শ্রদ্ধেয় বিশিষ্ট নাগরিকদের মধ্য হতে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন।

খালেদা জিয়া বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলো রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বৈঠকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের জন্য প্রতি পদের বিপরীতে দুই জনের নাম ও পরিচয়সহ সুস্পষ্ট প্রস্তাব লিখিতভাবে পেশ করবেন। বাছাই কমিটি এই সকল নাম হতে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের জন্য দুই জন এবং নির্বাচন কমিশনারের জন্য আট জন এইভাবে মোট দশ জনের নাম বাছাই করবে। এই প্রক্রিয়ায় বাছাই কমিটি প্রথম প্রস্তাবিত ব্যক্তিদের বিষয়ে বিচার বিশ্লেষণ করবে এবং তাদের মধ্যে যেসব ব্যক্তির নাম সব রাজনৈতিক দলের প্রস্তাবনায় অভিন্ন রয়েছে তাদের নাম রাষ্ট্রপতির নিকট প্রেরণের জন্য চূড়ান্ত করবে।

তিনি বলেন, এইভাবে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের জন্য দুই  জন এবং নির্বাচন কমিশনারের জন্য আট জন অভিন্ন পাওয়া না গেলে বাছাই কমিটি সব রাজনৈতিক দলের সাথে প্রয়োজন বারবার আলোচনা করবে।

বিএনপি প্রধান তার প্রস্তাবনায় বলেন, রাষ্ট্রপতি বাছাই কমিটি কর্তৃক প্রধান নির্বাচন কমিশনারের জন্য বাছাইকৃত দুই জনের মধ্যে হতে এক জনকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং বাছাই কমিটি কর্তৃক নির্বাচন কমিশনারের জন্য বাছাইকৃত আট জনের মধ্য হতে চার জনকে নির্বাচন কমিশনার পদে চূড়ান্ত করবেন।

তিনি বলেন, ‘বাছাইকৃত দুজনই অসম্মতি প্রকাশ করলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার মনোনয়নের জন্য একই প্রক্রিয়া ও পদ্ধতিতে নতুন করে বাছাই প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে।’

নির্বাচন কমিশন (ইসি) শক্তিশালীকরণ প্রক্রিয়াকে ঢেলে সাজানোর সুপারিশ ও পদক্ষেপ নেওয়ার প্রস্তাব দেন খালেদা জিয়া।

এজন্য ইসিকে অধিকতর কার্যকর ও শক্তিশালী এবং আরপিওসহ অন্যান্য নির্বাচনী বিধি-বিধান সময় উপযোগী ও যৌক্তিকিকরণের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কারের প্রস্তাব দেন তিনি।

নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব সচিবালয় গঠনের প্রস্তাব রেখে বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, ‘জাতীয় সংসদের নিজস্ব সচিবালয় থাকবে বলে উল্লেখ আছে। একইভাবে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের জন্যও নিজস্ব সচিবালয় গঠন করতে হবে। বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের আর্থিক স্বাধীনতা থাকতে হবে।’

নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতার প্রশ্নে মাঠ পর্যায়ে নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার দাবি জানান তিনি। একই সঙ্গে বিগত নির্বাচনে যাদের বিরুদ্ধে দলীয় আনুগত্যের অভিযোগ রয়েছে এদের তালিকা করে প্রত্যাহার করতে সুপারিশ করেছেন বিএনপি প্রধান।

সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার নিয়োগ, উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের প্রত্যাহার করে নতুন কর্মকর্তা নিয়োগের ব্যবস্থা গ্রহণের প্রস্তাব দেন তিনি।

নির্বাচন তফিসল ঘোষণার তারিখ থেকে নির্বাচিত নতুন সরকার দায়িত্ব না নেওয়া পর্যন্ত প্রশাসনের দায়িত্বশীলদের বদলি ও পদায়ন সম্পূর্ণভাবে নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ারভুক্ত থাকবে বলেও সুপালিশ করেন তিনি।

খালেদা জিয়া প্রস্তাব দেন, নির্বাচন কমিশন নির্বাচনকালীন সময়ে প্রতিরক্ষা বাহিনীকে বিচারিক ক্ষমতা প্রদান করে সব নির্বাচনী এলাকায় টহলসহ ভোটকেন্দ্রে ও বিশেষ বিশেষ স্থানে মোতায়েনের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এই ব্যবস্থা ভোট গ্রহণ দিবসের সাত দিন পূর্ব হতে নির্বাচনী ফলাফলের গেজেট প্রকাশনা পর্যন্ত স্থায়ী হবে।

ভোটার তালিকা হালনাগাদ, নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষন, নির্বাচনী তফসীল ঘোষণার সাত দিনের মধ্যে জাতীয় ও স্থানীয় পর্যবেক্ষক সংস্থার নাম ও পরিচয় প্রকাশ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা, বিদেশি পর্যবেক্ষক সংস্থা এবং বিদেশি রাষ্ট্র কর্তৃক নিয়োজিত পর্যবেক্ষকদের নাম ও তালিকা প্রকাশ করার সুপারিশ করেন খালেদা জিয়া।

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণমূলক, গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠনই যথেষ্ট নয়। নির্বাচন কমিশনকে সর্বাত্মক প্রশাসনিক ও লজিস্টিক সহযোগিতা প্রদান এবং প্রতিরক্ষা বাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমর্থন ও সহযোগিতা ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান ও নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করা অসম্ভব।’

খালেদা জিয়া বলেন, ‘একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার ব্যতিরেকে এ সব সহযোগিতা নিশ্চিত করা এবং সুষ্ঠু অবাধ, নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব নয়।’

সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের স্বার্থে নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের রূপরেখা ভবিষ্যতে জাতির সামনে তুলে ধরা হবে বলেও জানান খালেদা জিয়া।

সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি নেতাদের মধ্যে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ, তরিকুল ইসলাম, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, মাহবুবুর রহমান, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, ড. আবদুল মঈন খান, মির্জা আব্বাস, নজরুল ইসলাম খান, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, এনাম আহমেদ চৌধুরী, আলতাফ হোসেন চৌধুরী, হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন, শামসুজ্জামান দুদু, অ্যাডভোকেট জয়নাল আবেদিন, আবদুল মান্নান, আবদুল আউয়াল মিন্টু, অ্যাডভোকেট আহমদ আজম খান, ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন, আমান উল্লাহ আমান, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, খায়রুল কবির খোকন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

২০ দলীয় জোটের নেতাদের মধ্যে কর্নেল (অব.) অলি আহমেদ, সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহীম, আন্দালিব রহমান পার্থ, শফিউল আলম প্রধান, ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, জেবেল রহমান গানি গোলাম মোর্ত্তজা, আজহারুল ইসলাম, মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, সাঈদ আহমেদ, সাইফুদ্দিন আহমেদ মনি, মো. আবদুর রকিব প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে প্রবীণ আইজীবী ব্যারিস্টার রফিক উল হক, প্রাক্তন গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ, সাংবাদিক মাহফুজুল্লাহ, জাবির প্রাক্তন উপাচার্য ড. মোস্তাহিদুর রহমান, দিলারা চৌধুরী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

ঢাকা জার্নাল, নভেম্বর ১৮, ২০১৬।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.