‘ম্যাচটা দে, একেবারে পোড়ায়্যা দেই’

নভেম্বর ৬, ২০১৬

shakil-1ঢাকা জার্নাল : ‘আমি দৌড়ে একটা মুদি দোকানে আশ্রয় নেই। দোকানদারও প্রথমে আমাকে ঢুকতে বাধা দেন। কিন্তু তার আগেই হামলাকারীরা আমাকে আবার ধরে এলোপাথাড়ি কিলঘুষি মারতে থাকে। চারদিক থেকে ঘিরে ধরে মারছিল। এক পর্যায়ে দোকানের সামনে থাকা কেরোসিনের টিন তুলে আমার শরীরে ঢালতে থাকে।

এরপর জব্বার-রহিম ম্যাচ খুঁজতে থাকে। বলে, ম্যাচটা দে একেবারে পোড়ায়্যা দেই। আমার তখন মাথা কাজ করছিল না। কোথা থেকে দু’জন লোক এসে আমাকে ছাড়িয়ে নিয়ে গেল। মনে হলো যেন নতুন জীবন পেলাম।’

রোববার (০৬ নভেম্বর) বিকেলে চকবাজার থানায় দাঁড়িয়ে এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলছিলেন বেসরকারি টিভি চ্যানেল যমুনার সিনিয়র রিপোর্টার শাকিল হাসান। তখনও শরীর থেকে কেরোসিনের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। গায়ে সাদা একটি গেঞ্জি। শার্টটি আলামত হিসেবে জব্দ করেছে পুলিশ।

সকালে পুরান ঢাকার চকবাজার থানাধীন দেবীদাস ঘাট এলাকায় পলিথিনের অবৈধ কারখানা নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করতে গিয়ে কারখানা মালিক ও তাদের সহযোগীদের হাতে মারধরের শিকার হন শাকিল হাসান ও ক্যামেরা পারসন শাহীন আলম। হামলাকারীরা এক পর্যায়ে শাকিলের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিতে উদ্যত হয়। পরে স্থানীয়রা তাকে হামলাকারীদের হাত থেকে বাঁচায়। খবর পেয়ে পুলিশ তাদের উদ্ধার করে নিয়ে যায়।

ঢাকা মেট্রোপলিনট পুলিশের লালবাগ বিভাগের উপ-কমিশনার মোহাম্মদ ইব্রাহীম খান বলেন, ‘এ ঘটনায় একটি মামলা দায়ের হয়েছে। পুলিশ হামলাকারীদের গ্রেফতারে অভিযান চালাচ্ছে।’

ঘটনার বর্ণনা দিয়ে শাকিল বলেন, ‘আমি আর শাহীন (ক্যামেরা পারসন) ফ্যাক্টরির সামনে থেকে ছবি নিচ্ছিলাম। এ সময় পেছন থেকে এবং ফ্যাক্টরির ভেতর থেকে জব্বার-রহিম বের হয়ে এসে প্রথমে তর্ক শুরু করে দেয়। এক পর্যায়ে ক্যামেরায় রেকর্ড হচ্ছে দেখে ধাক্কাধাক্কি শুরু করে।’ শাকিল বলেন, ‘আমরা দু’জনই তখন গলি থেকে বের হয়ে আসি। গলির মুখে আসামাত্রই পেছন থেকে কয়েকজন যুবক এসে এলোপাথাড়ি মারধর শুরু করে। একইসঙ্গে হামলা চালায় শাহীনের ওপর।’

ক্যামেরা পারসন শাহীন আলম জানান, ‘শুরু থেকেই আমার ক্যামেরা অন করা ছিল। ধাক্কাধাক্কি ও প্রথম মারধরের ঘটনাটি আমি রেকর্ড করেছি। এই বিষয়টি টের পেয়ে তারা আমার ক্যামেরা কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। ক্যামেরা আর বুম ভাঙচুর করে। তার ছিঁড়ে ফেলে। আমাকে মারধরের এক পর্যায়ে আমিও মাটিতে পড়ে যাই। তারপর কেউ একজন আমাকে টেনে তুলে পালাতে বলে। আমি দৌড়ে পাশের একটি গলিতে গিয়ে অফিসে বিষয়টি জানাই। আমি যখন পাশের গলিতে ছিলাম, তখন ওরা শাকিলকে পেটাচ্ছিল।’

বিকালে সরেজমিন পুরান ঢাকার চকবাজার থানাধীন দেবীদাস ঘাট এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, জব্বার-রহিমের মালিকানাধীন সেই অবৈধ পলিথিন কারখানাটি তালাবদ্ধ। স্থানীয়রা জানান, ঘটনার পরপরই জব্বার ও রহিম কারখানা বন্ধ করে পালিয়ে গেছে। পালিয়ে গেছে কারখানার কর্মচারীরাও। দেবীদাস ঘাটের ওই কারখানার ভবনের মালিকের নাম সুমন। তিনি পাশের এলাকায় থাকেন। খোঁজ করে তাকেও পাওয়া যায়নি। কারখানা ভবনের চতুর্থ তলার ভাড়াটিয়া হৃদয় নামে এক যুবক জানান, তিনি দুই বছর ধরে ওই বাসায় ভাড়া থাকেন। নিচতলার পলিথিন কারখানাটি ৬/৭ মাস আগে চালু করা হয়েছে। জব্বার ও রহিম নামে দুই ভাই এই কারখানার মালিক। তবে তাদের বিস্তারিত ঠিকানা জানাতে পারেননি তিনি।

সকালের ঘটনা সম্পর্কে আশেপাশের অন্তত ১০টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিকের কাছে জানতে চাইলে তারা কেউ দেখেননি বলে জানান। নান্নু ইলেক্ট্রনিক্স নামে এক প্রতিষ্ঠানের মালিক বিকাশ জানান, সকাল সাড়ে ১১টার দিকে তিনি একজনকে দৌড়ে যেতে এবং তার পেছনে বেশ কয়েকজন লোক ও ছেলেদের ধাওয়া করতে দেখেছেন। এ সময় ‘মার’ ‘মার’ বলে সবাই চিৎকার করছিল। কিন্তু তিনি দোকান ফেলে কাছে গিয়ে দেখেননি।

সাংবাদিক শাকিল দৌড়ে গিয়ে যে দোকানে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। যেখানে তাকে কেরোসিন ঢেলে পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল, সেই দোকানের নাম কর্ণফুলী জেনারেল স্টোর। দোকানের সামনে বেশ কিছু কেরোসিনের টিন একসঙ্গে রাখা। এরই একটি থেকে কেরোরিসন ঢেলে পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টা করা হয় শাকিলকে। ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে কর্ণপুলী স্টোরের মালিক কামরুল ইসলাম বলেন, ‘আমি ঘটনার সময় মার্কেটে গিয়েছিলাম। ওই সময় কর্মচারী নজরুল দোকানে ছিল।’ নজরুল কোথায় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বাসায় গেছে রেস্ট নিতে।’ বাসা কোথায় এবং মোবাইল নম্বর জানতে চাইলে তিনি বাসা দূরে, মোবাইল নম্বর নেই বলে জানান।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক যুবক এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আড়ালে গিয়ে বলেন, ‘এখানের সবাই দেখেছে। কিন্তু সবাই না দেখার ভান করে আছে। কারণ বললেই ঝামেলা। জব্বার ও রহিম ভাড়াটিয়া হলেও প্রভাবশালী। অবৈধ পলিথিনের কারখানা দিয়ে তারা কোটি-কোটি টাকা কামিয়েছে। স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা ও পুলিশকে সে নিয়মিত মাসোহারা দেয়। এ কারণে তাদের বিরুদ্ধে কেউ কিছু অভিযোগ করছে না।’

ওই যুবক বলেন, ‘মারধরের ঘটনা আমি নিজে দেখেছি। জব্বার ও রহিম তাদের সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে অনেক মারধর করেছে। প্রথমে কেউ ছাড়াতে যায়নি। পরে দু’জন গিয়েছিল। তবে ভীড়ের কারণে আমি কেরোসিন ঢালতে দেখেনি। যদিও হামলাকারীরা চলে যাওয়ার পর ওই সাংবাদিকের শরীর কেরোসিনে ভেজা দেখেছি।’

ঢাকা জার্নাল, নভেম্বর ০৬, ২০১৬।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.