রামের অগ্নিপরীক্ষা || মাসকাওয়াথ আহসান

অক্টোবর ১৪, ২০১৬

Maskawath Ahsanমাসকাওয়াথ আহসান : রামের জীবনটা বেশ নির্ঝঞ্ঝাট। ছোটবেলায় মা বলেছিলেন, তোমাকে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে না; যে কাজ করে আনন্দ পাবে; তাই কোরো। ফলে রাম বেশ আরামে আয়েশে মিডিয়ার কাজ করতে করতে ছোট-খাট মিডিয়া উদ্যোক্তা হয়ে পড়ে। উপার্জন ভালো। কিন্তু টাকা-পয়সা দেখতে কেন যেন অসহ্য লাগে তার। তাই স্ত্রী সীতাকে চিফ ফাইনান্সিয়াল অফিসার (সিএফও) নিযুক্ত করে। সীতাও মিডিয়ায় কাজ করে। তবে বাড়তি দায়িত্ব হিসেবে সিএফও-র কাজটা বাধ্য হয়ে নেয় সে। কারণ রামের খোলামকুচির মতো টাকা উড়ানোর অভ্যাস আছে।

ভালোই যাচ্ছিলো রাম-সীতার জীবন। কিন্তু হঠাতই সীতা নারী অধিকার আন্দোলনে যোগ দিয়ে নারীবাদী হয়ে পড়ে। বাসাটাকে সে ক্রমশঃ শাহবাগে পরিণত করে। তার বন্ধুরা মাঝে মাঝে আসে। পুরুষতন্ত্রের যুগ যুগ ধরে চলে আসা নিপীড়নের বিরুদ্ধে সীতার বসার ঘরটি ফুঁসে ওঠে।

রাম স্টাডিরুমে বসে মাঝে মাঝে তাদের বক্তৃতার ঝাঁঝ শোনে। বাধ্য হয়ে কানে হেডফোন গুঁজে রবীন্দ্র সংগীতে মনোযোগ দেয়। সীতার বন্ধুরা দেখে সীতা কিছুক্ষণ পরপর রামের স্টাডিরুমে চা দিয়ে আসে। জেসি অবাক হয়ে যায়।

–সীতা তুমি কী রামের বাসার কাজের বুয়া। তুমি চা দিবা কেন! সে নিজে চা বানাইতে পারে না! তার মা কী তাকে কিছুই শেখায় নাই।

সীতা বলে, রাম বিদেশে সেটল না করে দেশে ফিরেছে মূলতঃ এই কারণে। সে সেলফ ম্যানেজমেন্টে দুর্বল।

–এই জায়গাটাতেই তুমি বিরাট ভুল করতেছো। বাসাতেই তুমি যদি পুরুষতন্ত্রকে প্রশ্রয় দাও তাহলে নারী মুক্তি আন্দোলন করবা কীভাবে! রামের এইসব আজাইরা ঢং একদম পাত্তা দিওনা।

বন্ধুরা ফিরে গেলে সীতা বেশ কিছুক্ষণ লনে পায়চারী করে। মাকে ফোন করে।

–হ্যালো মা! রাম তো চা বানাতেও শিখলো না! কী করি তাকে নিয়ে।
–এটা কোন বড় সমস্যা নয়। আমি ওকে একটা ইলেকট্রিক কেটল গিফট করবো।

স্টাডিরুমের কোণায় ইলেকট্রিক কেটল রাখা হয়। সীতা রামকে দেখিয়ে দেয় কীভাবে চা বানাতে হবে।

পরদিন রাম কেটলে পানি চড়িয়ে ল্যাপটপে কাজ করছিলো। হঠাত কিছু একটা পোড়ার গন্ধ শুনে সীতা ছুটে আসে। যথারীতি সীতা এসে আবিষ্কার করে ইলেকট্রিক কেটলের সঙ্গে লাগানো তার পুড়ে গন্ধ বেরিয়েছে। তড়াক করে ক্ষেপে যায়। সে রামকে বলে, এক কাপ চা বানাতে শেখোনি। কী শিখলে জীবনে!

রাম বিরক্ত হয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়।

রামের এই ইলেকট্রিক কেটল পুড়িয়ে ফেলার ব্রেকিং নিউজে সীতার নারীবাদী বন্ধুরা দ্রুত ওর বাসায় চলে আসে।

“ইলেকট্রিক কেটল পুড়িয়ে ফেলা এবং পুরুষতন্ত্রের দূরভিসন্ধি” বিষয়ক সেমিনার শুরু হয়।

পিনাকি দেবী বলে, রামের এই ইলেকট্রিক কেটল পুড়িয়ে ফেলার মাঝ দিয়ে সে এই ঔদাসীন্য আগামীর পুরুষদের মাঝে ছড়িয়ে দেবে। এরকম শত্রুকে ঘরে ঘরে চিহ্নিত করতে হবে। নইলে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে না।

ফয়জুন্নেসা হুংকার দেয়, কীসের এতো অন্যমনষ্কতা! এইসব সৃজনশীলতার এক পয়সা দাম নাই। এখন নারী পাল্লা দিয়ে কাজ করছে পুরুষের সঙ্গে। যোগ্যতার লড়াইয়ে পুরুষেরা হেরে যাচ্ছে।

সীতার কাছে অবশ্য সৃজনশীলতার কয়েক পয়সা দাম আছে। কারণ সে নিজে অনেক ভালো ছাত্রী ছিলো। কিন্তু রাম ভালো ছাত্রও ছিলো; সঙ্গে সৃজনশীলতার গুনও আছে। তবু ফয়জুন্নেসার মন রাখতে সে চুপ করে থাকে।

জেসি সীতাকে বুদ্ধি দেয়, রামকে দিয়ে কাল ব্রেকফাস্টে ডিমভাজার জন্য পেয়াজ কাটালেই অন্যমনষ্কতা ছুটে যাবে।

রাম একটা কফি শপে বসে একা একা কফি খাচ্ছিলো। এমন সময় তার মিডিয়া হাউজের আনাহিতা এসে সামনে বসে বলে, ভাইয়া একা একা বসে কফি খাচ্ছেন যে।

–একটু মেন্টাল হলিডেতে আছি। একা একা মাঝে মাঝে মনের ছুটি নিতে হয়।

–আপনি কিন্তু ভীষণ এন্টি সোশ্যাল হয়ে যাচ্ছেন। বাই দ্য ওয়ে প্রাইম টাইম শো’টা সামিয়াকে দিয়ে না করিয়ে আমাকে দিয়ে করালে এত্তো এত্তো রেটিং এনে দেবো। ফেসবুকে সামিয়ার চেয়ে আমার লাইক-ফ্যান-ফলোয়ার অনেক বেশী।

রাম বিরক্তি লুকিয়ে বলে, আনাহিতা তুমি যে ভাষায় কথা বলো এটাকে বেংলিশ বলে; আর সামিয়া বাংলায় কথা বলে। ওর কনটেন্ট ভালো। তুমি তো কিছু পড়ো না। শো’তে ইনফরমেটিভ কিছুই থাকে না। এগুলো ঠিকঠাক করো আগে।

আনাহিতার ইচ্ছা করে একটা কফির কাপ তুলে আছাড় দিতে। কিন্তু নিজেকে সামলে “আসি ভাইয়া বাই” বলে বেরিয়ে যায়।
গাড়ীতে বসেই “হাইট অফ আজাইরা মেল শভিনিজম” বলে একটা রাগান্বিত টুইট করে আনাহিতা।

ওদিকে সীতা তার শাশুড়িকে ফোন করে, আন্টি আপনি আপনার ছেলেকে এক কাপ চা বানাতেও শেখাননি।

রামের মা বলেন, চেষ্টা করেছি, কিন্তু শিখতে পারেনি। অসুবিধা হলে আমি আরেকজন ডোমেস্টিক হেলপ পাঠাই। এই লিমিটেশানের কারণেই তো ও পশ্চিমে থাকতে পারেনি। তা আর কোন অভিযোগ কী তোমার আছে!

সীতা কোন অভিযোগ খুঁজে পায়না। বলে, রাখছি আন্টি; পরে মনে পড়লে জানাবো। টেক কেয়ার।

সীতার নারীবাদী বন্ধুরা বাসায় ফিরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্টেটাস দেয়। সঙ্গে সীতার লিভিং রুমের সেমিনারের সেলফি।
“পুরুষকে মুখ দিয়ে মাথায় তুলবেন না। তাকে দিয়ে বাসন মাজান, রান্না-বান্না করান। তাকে রান্না করে খাওয়ানো মানে পুরুষতন্ত্রের ক্রীড়নক হয়ে পড়া। কেউ যদি স্বামীকে রান্না করে খাওয়ায়; সেইসব নারী আসলে নারী জাতির বড় শত্রু”

এইসব জ্বালাময়ী স্টেটাস দেখে অনেক পুরুষই কেকা আপার রান্না শেখানোর টিভি শো দেখতে শুরু করে।

রামের মা সীতার মাকে ফোন করে সীতার অভিযোগের বিষয়টা জানান। সীতার মা বলেন, আপনি-আমি দুজনেই চাকরী করেছি, বাচ্চা পড়িয়েছি, রান্না করেছি; কোন অসুবিধা হয়নি। তা ছাড়া এতো ইউরোপ-এমেরিকা নয়। সব সময় কাজে সাহায্য করার মানুষ পাওয়া যায়। বুঝলাম না সীতার হঠাত রামকে দিয়ে রান্না করানোর বাতিক হলো কেন। হয়তো বিদেশের সিটকমগুলোতে হিরোদের বাসন মাজতে দেখে; সালাদ কাটতে দেখে ভাবছে রামকে দিয়ে এগুলো করানো ট্রেন্ডি। আপনি ভাববেন না; আমি দেখছি ব্যাপারটা।

রাম বাসায় ফিরতেই সীতা অগ্নিশর্মা হয়ে বলে, কোথায় গিয়েছিলে!

–এসব বাজে প্রশ্ন করা কোত্থেকে শিখলে! এরিয়া অফ প্রাইভেসিকে রেসপেক্ট করতে জানতে বলেই তো তোমার সঙ্গে এই সম্পর্কে আসা।

এরই মাঝে সীতার নারীবাদি এক পাপারাজ্জি বন্ধু কফি শপে আনাহিতার সঙ্গে রামের ছবি তুলে সীতার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে। সীতা সেটা দেখিয়ে বলে, তাহলে এটাই তোমার এরিয়া অফ প্রাইভেসি!

রাম খুবই বিরক্ত হয়ে বলে, গিভ মি আ ব্রেক; এখনো প্লায়োস্টোসিন যুগে বসবাস করো নাকি! কফিশপে কোন সহকর্মীর সঙ্গে কী দেখা হতে নেই! তোমাদের নারীবাদীদের আড্ডায় যে কতগুলো নাচের শিক্ষক টাইপের ভাইয়া লাল-হলুদ বিচিত্র রঙের পাঞ্জাবি পরে আসে; তা নিয়ে আমি কী কখনো কোন প্রশ্ন করেছি!

সীতা বলে, এতো রেগে যাচ্ছো কেন কোপাবে নাকি আমাকে! আজকাল হিংস্র-জংলি পুরুষেরা তো নারীদের চাপাতি দিয়ে কোপাচ্ছে।

–দেখো সীতা গ্রামাঞ্চলের বাস্তবতা আলাদা। অধিকার বঞ্চিত নারীরা প্রতিনিয়ত নির্যাতনের স্বীকার। কারণ তারা যে কাজ করে ডোমেস্টিক ইকোনমিতে কনট্রিবিউট করে তার মূল্যায়ন হয়না। পুরুষ উপার্জন করে বলে সবসময় নারীকে ইনফেরিয়র ভাবে। কথায় কথায় গায়ে হাত তোলে। কিন্তু তোমরা মেট্রোপলিটানের এই ফেমিনিস্ট আপারা এমপাওয়ারড। নিজেদের চট করে নির্যাতিত অধিকার বঞ্চিত নারীর কাতারে নিয়ে গিয়ে কুমিরের কান্না বন্ধ করো। পারলে প্রান্তিক নারীদের জন্য কাজ করো। আমাকে এসব ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে লাভ নেই।

সীতা রামের হাত ধরে কিচেনে নিয়ে যায়। বলে, আমি বুয়াকে ছুটি দিয়েছি; আজকে বাসন মাজবে তুমি।

রাম বলে, এ আর কঠিন কী! বিদেশে টুকটাক করেছি এ কাজ। তুমি যাও ফেসবুকে গিয়ে বিপ্লব করো।

সীতা বলে, এখানেই শেষ নয়, কাল সকালে ব্রেকফাস্টের অমলেটের জন্য পেয়াজ কাটবে তুমি। পুরুষতন্ত্রের দম্ভ ভেঙ্গে তোমার কনসেপশান ক্লিয়ার করতে হবে। এ ছাড়া আর কোন পথ নেই।

সকালে উঠে যথারীতি রাম পেয়াজ কাটতে শুরু করে। পেয়াজের ঝাঁঝে চোখ জ্বলতে থাকে। চোখ দুটোতে যেন কেউ পেট্রোল দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এ অগ্নি পরীক্ষায় তাকে যে উত্তীর্ণ হতেই হবে।

লেখক, সাংবাদিক।

ঢাকা জার্নাল, অক্টোবর ১৪, ২০১৬।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.