আনন্দময়ী দুর্গার বোধন

অক্টোবর ৭, ২০১৬

durgaঢাকা জার্নাল : ষষ্ঠী তিথিতে বেলতলায় দেবীর ঘুম ভাঙানোর বন্দনার মধ্য দিয়ে শুক্রবার (০৭ অক্টোবর) শুরু হল বাঙালি সনাতন ধর্মবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গা পূজা। ‘আনন্দময়ী’ দেবী দুর্গার আগমনী গানে চারদিক মুখরিত এখন।

বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর সারাদেশে ২৯ হাজার ৩৯৫টি মণ্ডপে দুর্গাপূজা হচ্ছে। এর মধ‌্যে রাজধানীতেই রয়েছে ২২৯টি মণ্ডপ।

হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী, দশভূজা দেবী দুর্গা অসুর বধ করে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রতি শরতে কৈলাস ছেড়ে কন্যারূপে মর্ত্যলোকে আসেন। সন্তানদের নিয়ে পক্ষকাল পিতার গৃহে কাটিয়ে আবার ফিরে যান দেবালয়ে। আশ্বিন শুক্লপক্ষের এই ১৫টি দিন দেবীপক্ষ, মর্ত‌্যলোকে উৎসব।

বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা মতে মঙ্গলবার বিজয়া দশমীতে প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হবে এবারের দুর্গোৎসবের। একটি বছরের জন্য ‘দুর্গতিনাশিনী’ দেবী ফিরে যাবেন কৈলাসে দেবালয়ে।

ঢাকেশ্বরী মন্দিরের প্রধান পুরোহিত রঞ্জিত চক্রবর্তী বলেন, “শুক্রবার প্রাতঃকালে ষোড়শ উপচারে দেবীর আবাহন করেছি আমরা। সকাল ৮টা ২৩ মিনিটে শুরু হয়েছে দুর্গোৎসবের আনুষ্ঠানিকতা।”

সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস, ত্রেতাযুগে ভগবান রাম তার স্ত্রী সীতাকে উদ্ধার করতে দেবী দুর্গার অকালবোধন করেন। ব্রহ্মার নির্দেশ অনুযায়ী দুর্গার সাহায্যে রাবণ বধ করে সীতাকে উদ্ধার করেন তিনি। দেবির সেই আগমণের সময়ই দুর্গোৎসব।

রাম শরৎকালে দেবীকে আহ্বান করেছিলেন বলে এ পূজা শারদীয় দুর্গা পূজা নামেও পরিচিত। আর মর্ত‌্যলোকে আসতে দেবীর সেই ঘুম ভাঙানোকে বলা বলা হয় অকাল বোধন।

অকাল বোধন কেন? পুরোহিতরা বলছেন, দুর্গা দেবীর প্রকৃত আগমনের সময় চৈত্র মাস। অর্থাৎ বসন্ত কাল। চৈত্র মাসে যে দুর্গা পূজা হয় তাকে বলা হয় বাসন্তী পূজা। তবে বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলে শারদীয় পূজাই সবচেয়ে বড় উৎসব।

সকালে সারা দেশে মণ্ডপে মণ্ডপে হয়েছে বোধন, বা দেবীর ঘুম ভাঙানোর বন্দনা পূজা। ষষ্ঠী তিথিতে বিহিতপূজার পর দেবীর আমন্ত্রণ ও অধিবাসের মধ্য দিয়ে মূল দুর্গোৎসবের সূচনা।

ঢাকেশ্বরীর পুরোহিত রঞ্জিত চক্রবর্তী বলেন, “বিল্ববৃক্ষ (বেলগাছ) মহাদেবের ভীষণ প্রিয়, পদ্মযোনী ব্রহ্মাও বিল্ববৃক্ষে দেবীকে প্রথম দর্শন করেন। তাই আমরা দেবীকে বিল্ববৃক্ষ তলেই আবাহন করছি। আজ বিল্ববৃক্ষ তলে দেবী আবাহনের মধ্যে সংকল্প করেছি, দশমী পর্বন্ত যথাবিধ উপায়ে আমরা মায়ের পূজা করব।”

দেবীপক্ষের সূচনা হয় আশ্বিন শুক্লপক্ষের অমাবস্যার দিন; সেদিন মহালয়া। আর দেবীপক্ষের সমাপ্তি পঞ্চদশ দিনে কোজাগরী পূর্ণিমায়, লক্ষ্মীপূজার মধ‌্য দিয়ে। এর মাঝে ষষ্ঠ দিন, অর্থাৎ ষষ্ঠীতে বোধন। আর দশম দিন, অর্থাৎ দশমীতে বিসর্জন। দুর্গা পূজার মূল আনুষ্ঠানিকতা এই পাঁচদিনই চলে।

শাস্ত্র বলছে, সপ্তমী, অর্থাৎ দেবীর আগমনের দিন শনি এবং ফেরার দিন মঙ্গলবার হওয়ায় এবার তার আসা-যাওয়া দুটোই হবে ঘোটকে, অর্থাৎ ঘোড়ায় চেপে। এর ফল হবে ‘ছত্রভঙ্গস্তুরঙ্গমে’। অর্থাৎ, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংসারিক ক্ষেত্রে ঘটবে অস্থিরতা। রাজনৈতিক উত্থান-পতন, সামাজিক স্তরে বিশৃঙ্খলা, অরাজকতা, গৃহযুদ্ধ, দুর্ঘটনা, অপমৃত্যু বাড়বে।

রঞ্জিত চক্রবর্তী বলেন, “এবার আমরা আশঙ্কা করছি ভূমিকম্পের। তবে আমরা প্রার্থনা করছি, মা দুর্গা যেন সমস্ত প্রকোপ থেকে আমাদের বসুন্ধরাকে রক্ষা করেন।”

মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটির সাধারণ সম্পাদক শ্যামল কুমার রায় বলেন, “সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকে মানুষ অসুর শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে বিজয় অর্জন করছে। শারদীয় দুর্গোৎসবের মধ‌্য দিয়ে মানবজাতির এই শাশ্বত সংগ্রামের বার্তাই ঘোষিত হয়। দেবী দুর্গা মাতৃস্বরূপা, শক্তিরূপিনী। অসুর নিধন করে তিনি শুভবুদ্ধির পথ দেখান।

তার ভাষায়, “অসুর নিধনের এই বার্তা কোনো বিশেষ ধর্ম, সম্প্রদায়, কাল কিংবা ভূখণ্ডে আবদ্ধ নয়। বিভেদ, বৈষম্য ও সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি স্বার্থান্বেষী মানুষের তৈরি, যারা মূলত ধ্বংসের শক্তি।”

শ্যামল জানান, শুক্রবার আবাহনের মাধ্যমে মূল মণ্ডপে দেবী আসীন হওয়ার পর সন্ধ‌্যায় দেবীর অধিবাস। শনিবার সকাল ৮টা ৫৭ মিনিটে দেবীর নবপত্রিকা প্রবেশ ও স্থাপনের মাধ্যমে মহাসপ্তমী পূজা হবে।

রোববার (০৯ অক্টোবর) মহাঅষ্টমী পূজার পর হবে কুমারী পূজা। সেদিন সন্ধ্যায় সন্ধিপূজা। এরপর সোমবার মহানবমী। মঙ্গলবার সকালে দশমী বিহিত পূজা ও দর্পণ বিসর্জনে শেষ হবে দুর্গোৎসব।

ঢাকায় মঙ্গলবার বিকাল ৪টায় হবে বিজয়া শোভাযাত্রা। পুরান ঢাকার ওয়াইজঘাটে হবে প্রতিমা বিসর্জন। বিকাল ৪টার মধ্যে সব মণ্ডপ থেকে প্রতিমা নিয়ে শোভাযাত্রায় যোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটি।

পূজার সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্পর্কে শ্যামল কুমার রায় বলেন, “স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি কঠোরভাবে মনিটর করছে। পুলিশ ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি পূজা কমিটির স্বেচ্ছাসেবকরা প্রতিটি মণ্ডপে নিয়োজিত রয়েছেন।”

তবে শুধু কঠোর নিরাপত্তা দিয়ে ধর্মীয় উৎসব নিরাপদ করা যাবে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, “সমাজ ও রাজনীতি থেকে সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মান্ধতা নির্মূল করতে হবে। এ ব্যাপারে সরকারের পাশাপাশি সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে একযোগে কাজ করতে হবে।”

দুর্গোৎসব চলাকালে পূজা মণ্ডপগুলোতে প্রতিদিনই অঞ্জলি, প্রসাদ বিতরণ ও ভোগ-আরতি হবে। এছাড়া আলোকসজ্জা, আরতি প্রতিযোগিতা, স্বেচ্ছায় রক্তদান, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, আলোচনা সভাসহ বিভিন্ন কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে।

শারদীয় দুর্গাপূজা উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আলাদা বাণীতে দেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। এবার পূজার সরকারি ছুটি ১১ অক্টোবর।

ঢাকা জার্নাল, অক্টোবর ০৭, ২০১৬।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.