ব্যাংকে পথশিশুদের ২২ লাখ টাকা

অক্টোবর ৬, ২০১৬

%e2%80%8dshishuঢাকা জার্নাল : তার নাম মিলি শরিফ মনি। বিশেষ কোনো পরিচয় নেই তার, সে একজন পথশিশু। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে শৈশবেই বাবা-মা থেকে বিচ্ছিন্ন সে। খেয়ে না খেয়ে দিনাতিপাত করা এই শিশুর দু’চোখে সোনালী ভবিষ্যতের স্বপ্ন। বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি পদক্ষেপ তাকে এই স্বপ্ন দেখার সুযোগ করে দিয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমানের উদ্যোগে ২০১৪ সালের মে মাস থেকে মাত্র ১০ টাকায় ব্যাংক হিসাব খোলার সুযোগ পায় পথশিশুরা। বেসরকারি একটি এনজিও প্রতিষ্ঠানের সহয়তায় এ সুযোগ গ্রহণ করে মিলি শরিফ মনি। একটু একটু করে সে ব্যাংকে জমা করেছে প্রায় ১০ হাজার টাকা।

ব্যাংক হিসাবে জমা রাখা এই টাকার বিপরীতে নিয়মিত মুনাফা পাচ্ছে সে। হিসাব সচল রাখতে কোনো চার্জও দিতে হচ্ছে না তাকে। মুনাফার পাশাপাশি এ ব্যাংক হিসাবের বিপরীতে ব্যবসা করার জন্য জামানতবিহীন ঋণ পাওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে। বয়স ১৮ বছর পূর্ণ হলেই এ ঋণ সুবিধা নিয়ে ব্যবসা করার স্বপ্ন দেখছে মিলি।

মিলির মতো ৩ হাজার ৪৬৭ কর্মজীবীশিশু ও পথশিশু মাত্র ১০ টাকায় ব্যাংক হিসাব খুলেছে। তাদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয়ে সম্মেলিতভাবে ব্যাংকে জমা হয়েছে ২২ লাখ ৮ হাজার ৮৪৮ টাকা। দেশের ১৭টি বাণিজ্যিক ব্যাংকে তাদের এ টাকা জমা রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইনক্লুশন বিভাগের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

ওই প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) ২৭৮ জন কর্মজীবী ও পথশিশু নতুন করে ব্যাংক হিসাব খুলেছে। এই তিন মাসে কর্মজীবী ও পথশিশুরা ব্যাংকে জমা করেছে ৪ লাখ ৩৪ হাজার ৮২ টাকা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন স্থানে (যেমন-বস্তি, রাস্তাঘাট, রেলস্টেশন, বাসস্ট্যান্ড, লঞ্চঘাট ও ফুটপাতে) বসবাসরত পথশিশু এবং কর্মজীবী শিশু-কিশোরদের ব্যাংকিং সেবায় আনার মাধ্যমে তাদের মধ্যে সঞ্চয়প্রবণতা তৈরি, কষ্টোপার্জিত অর্থের সুরক্ষা, পথভ্রষ্ট হওয়ার প্রবণতা হ্রাস করাসহ তাদের বৃহত্তর কল্যাণে ব্যাংক হিসাব খোলার মহতী উদ্যোগ নেন সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান।

এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৪ সালের ৯ মার্চ এক নির্দেশনার মাধ্যমে মাত্র ১০ টাকা দিয়ে পথশিশুদের ব্যাংক হিসাব খোলার সুযোগ করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এ নির্দেশনার পর ব্যাংকগুলো বিভিন্ন এনজিও প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় কর্মজীবী ও পথশিশুদের হিসাব খোলার উদ্যোগ নেয়। আনুষ্ঠানিকভাবে এ ব্যাংক হিসাব খোলার কার্যক্রম শুরু হয় ওই বছরের ৩১ মে।

সূত্রটি জানায়, প্রাথমিকভাবে ১০টি ব্যাংক কর্মজীবি ও পথশিশুদের ব্যাংক হিসাব খোলার দায়িত্ব নেয়। পরে আরও ৭টি ব্যাংক এ মহতী উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত হয়। ব্যাংকগুলো হলো-সোনালী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া, মার্কেন্টাইল ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, এনসিসি ব্যাংক, ওয়ান ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, দ্য সিটি ব্যাংক, ট্রাস্ট ব্যাংক, উত্তরা ব্যাংক, আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংক।

যোগাযোগ করা হলে পথশিশুদের ব্যাংক হিসাব খোলার রূপকার ও সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, ‘যারা জীবনে কোনো দিন ব্যাংকে ঢুকতে পারেনি, তাদের ব্যাংক সেবার আওতায় আনায় আমার লক্ষ্য ছিল। এই পথশিশুরা তাদের টাকা মাথার নীচে ইট চাপা দিয়ে রাখে। বিভিন্ন সময় তাদের টাকা হারিয়ে যায়। ব্যাংক হিসাব খোলার সুযোগ পাওয়ায় তাদের টাকা নিরাপদে থাকবে।’

তিনি আরো বলেন, ‘একটি কঠিন সময়ে উদ্যোগটি নেওয়া হয়েছিল। প্রথমে পথশিশুদের অবিভাবক না থাকায় ব্যাংকগুলো এ হিসাব খুলতে রাজি হচ্ছিল না। সে কারণে আমরা এনজিও প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে হিসাব খুলার ব্যবস্থা করি। হিসাব খোলার সময় সংশ্লিষ্ট পথশিশু এবং এনজিও প্রতিনিধি উভয়ের সই নেওয়া হয়।’

তিনি জানান, ব্যাংক হিসাব খোলা পথশিশুদের বয়স ১৮ বছর হলে তারা ব্যাংক থেকে জামানতবিহীন ঋণ সুবিধা পাবে। যা দিয়ে তারা ছোটখাটো ব্যবসা করতে পারবে।

আতিউর রহমান বলেন, ‘সাড়ে ৭ লাখ পথশিশুর মধ্যে মধ্যে মাত্র সাড়ে ৩ হাজারের মতো ব্যাংক হিসাবের আওতায় এসেছে। বাকি শিশুদেরও ব্যাংক সেবার আওতায় আনতে হবে। সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে ব্যাংকগুলোর উচিত এসব শিশুদের ব্যাংক সেবার আওতায় এনে উন্নত ভবিষ্যত গড়ার সুযোগ করে দেওয়া।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, উদ্দীপন নামক এনজিও প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় সোনালী ব্যাংকে ৫ জন কর্মজীবী ও পথশিশুর ব্যাংক হিসাব রয়েছে। এ ব্যাংক হিসাবগুলোতে জমা আছে ৬ হাজার টাকা। জনতা ব্যাংকে আছে ১৫০ জন কর্মজীবী ও পথশিশুর ব্যাংক হিসাব। ইবিসিআর প্রকল্পের সহায়তায় এ হিসাবগুলোর সবকটি খোলা হয়েছে চলতি বছরের এপ্রিল-জুন সময়ে। হিসাবগুলোতে জমা আছে মোট ৭৫ হাজার টাকা।

পথশিশুদের জন্য সবচেয়ে বেশি হিসাব খুলেছে রূপালী ব্যাংক। মাসাস ও সাফ নামক দুইটি এনজিও প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় সরকারি মালিকানাধীন এ ব্যাংকটি ১ হাজার ৫৬ জন কর্মজীবী ও পথশিশুর ব্যাংক হিসাব খুলেছে। এর মধ্যে এপ্রিল-জুন সময়ে নতুন খোলা হয়েছে ৭১টি হিসাব। রূপালী ব্যাংকে কর্মজীবী ও পথশিশুদের জমা আছে ৯ লাখ ৬০ হাজার টাকা।

অগ্রণী ব্যাংকে আছে ৩৫৩ জন কর্মজীবী ও পথশিশুর ব্যাংক হিসাব। উদ্দীপন এনজিওর সহায়তায় খোলা এ হিসাবগুলোতে জমা আছে ৩১ হাজার টাকা। একই এনজিওর সহায়তায় বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকে হিসাব খুলেছে ১৬৩ জন কর্মজীবী ও পথশিশু। এ ব্যাংকটিতে তাদের জমা আছে ২৭ হাজার টাকা।

অপরাজেয় বাংলাদেশ, ব্র্যাক ও উদ্দীপনের সহায়তায় ব্যাংক এশিয়ায় খোলা হয়েছে ১৯১টি হিসাব। এর মধ্যে চলতি বছরের এপ্রিল-জুন সময়ে নতুন খোলা হয়েছে ২৯টি হিসাব। ব্যাংকটিতে কর্মজীবী ও পথশিশুরা জমা করেছে ২ লাখ ২৩ হাজার ৫৬২ টাকা।

অপরাজেয় বাংলাদেশ ও এইড বাংলাদেশের সহায়তায় মার্কেন্টাইল ব্যাংকে খেলা হয়েছে ২০১টি হিসাব। এর মধ্যে শেষ প্রান্তিকে নতুন খোলা হয়েছে ৫টি হিসাব। হিসাবগুলোতে জমা আছে ১ লাখ ২ হাজার ৬৭০ টাকা। এএসডির সহায়তায় মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকে খোলা ৩৪টি হিসাবে জমা আছে ১ হাজার টাকা। সিপিডির সহায়তায় ন্যাশনাল ব্যাংকে ১৯টি হিসাবে জমা আছে ১৩ হাজার টাকা।

এ ছাড়া এনসিসি ব্যাংকে ১৫টি হিসাবে ১ হাজার ২৫০ টাকা, ওয়ান ব্যাংকে ২৩২টি হিসাবে ১ লাখ ৫৯ হাজার ৩৪৯ টাকা, পূবালী ব্যাংকে ৫৪৬টি হিসাবে ৪ লাখ টাকা, সিটি ব্যাংকে ১৫০টি হিসাবে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা, ট্রাস্ট ব্যাংকে ২৮০টি হিসাবে ৭২ হাজার টাকা, উত্তরা ব্যাংকে ৩২টি হিসাবে ১ হাজার ১০০ টাকা, আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকে ৩৮টি হিসাবে ৮ হাজার ২০০ টাকা এবং ইউনিয়ন ব্যাংকে ২টি হিসাবে ৬ হাজার ১০ টাকা জমা রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক ও সহকারী মুখপাত্র এএফএম মোকাম্মেল হক বলেন, ‘পথশিশুদের অবিভাবক না থাকায় ব্যাংক হিসাব খুলতে এনজিও প্রতিনিধিদের এ কাজে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। এনজিও প্রতিনিধিদের মাধ্যমে যে কোনো পথশিশু ব্যাংকে হিসাব খুলতে পারবে।’

ঢাকা জার্নাল, অক্টোবর ০৫, ২০১৬।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.