স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উপস্থিতিতে বগুড়ায় দুই জঙ্গির আত্মসমর্পণ

অক্টোবর ৬, ২০১৬
  • bogra-home-minister-1ঢাকা জার্নাল : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের উপস্থিতিতে বগুড়ায় দুই জঙ্গি র‌্যাবের নিকট আত্মসমর্পণ করেছেন। এরা হলেন- শাজাহানপুর উপজেলার কামারপাড়া গ্রামের আব্দুর রহমানের পুত্র আব্দুল হাকিম (২২) ও গাইবান্ধার শাঘাটা উপজেলার হাটভরতখালী গ্রামের সিকেন্দার আলীর পুত্র মাহমুদুল হাসান বিজয়(২৩)। আত্মসমর্পণের পর তাদের হাতে ৫ লাখ টাকা করে ১০ লাখ টাকার চেক তুলে দেন মন্ত্রী।

বুধবার (৫ অক্টোবর) দুপুরে বগুড়া শহরের শহীদ টিটু মিলনায়তনে বিরোধী সমাবেশ অনুষ্ঠানে দুই জঙ্গি আত্মসমর্পণ করেন। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। বিশেষ অতিথি ছিলেন র‌্যাবের মহা পরিচালক বেনজীর আহম্মেদ, বগুড়া সদরের সংসদ সদস্য নূরুল ইসলাম ওমর, জেলা আ’লীগ সভাপতি আলহাজ্জ মমতাজ উদ্দিন, বগুড়া জেলা প্রশাসক মো. আশরাফ উদ্দিন, পুলিশ সুপার আসাদুজ্জামান, র‌্যাব-১২ অধিনায়ক মো. শাহাবুদ্দিন খান প্রমুখ।

আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে দুই জঙ্গি আব্দুল হাকিম ও বিজয় উপস্থিত সকলের উদ্দেশে বলেন, আমরা যে পথে ছিলাম সে পথ অন্ধকারের। সে পথে যেন কেউ না আসে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ঘোষণায় সকল জঙ্গির সাড়া দেওয়া উচিত। আমরা ভুল পথে যাওয়ার জন্য সকলের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী এবং অনুতপ্ত। আমাদের ক্ষমা করবেন। আমরা যেন দেশের জন্য ভাল কাজ করতে পারি।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত বিজয়ের মা আকতার জাহান কাঁদতে কাঁদতে ছেলের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং সকল জঙ্গিকে সঠিক পথে ফিরে আসার আহ্বান জানান। হাকিমের বড় ভাই আব্দুল হালিম তার ভাইয়ের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন।

সকাল ১০ অনুষ্ঠান টায় শুরু হওয়ার কথা থাকলেও অনুষ্ঠানস্থলে প্রধান অতিথি উপস্থিত হন বেলা ১২টার দিকে।

র‌্যারের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে আত্মসমর্পণকারী দুই জঙ্গির বিষয়ে তথ্য প্রদান করা হয়েছে। তথ্যানুযায়ী, আব্দুল হাকিম (২২) ছোট বেলায় ব্র্যাক স্কুলে পড়াশোনা করেন। এরপর কামারপাড়া সরকারি প্রাইমারি স্কুলে ৩য় শ্রেণিতে পড়ার পর কুষ্টিয়া হাফেজিয়া মাদ্রাসায় ১ম শ্রেণীতে ভর্তি হন। সেখানে ২ বছর পড়াশোনার পর তিনি ভিহি এডিইউ সেন্ট্রাল ফাজিল মাদ্রাসায় ৫ম শ্রেণীতে ভর্তি হয়ে ২০১৩ সালে দাখিল পাশ করেন। পরবর্তীতে এই মাদ্রাসা হতে ২০১৫ সালে আলিম পাশ করেন। হলি আর্টিজান হামলার জঙ্গি খায়রুল ইসলাম পায়েলের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সহচর ছিলেন। উল্লেখ্য, খায়রুল হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে নিহত ৫ জঙ্গির মধ্যে একজন। খায়রুল ও হাকিম ৫ম শ্রেণি হতে দাখিল পর্যন্ত ভিহি গ্রাম এডিইউ সেন্ট্রাল ফাজিল মাদ্রাসায় একই সাথে অধ্যায়ন করেছেন। খায়রুলের প্ররোচণায় আব্দুল হাকিম জঙ্গি কর্মকাণ্ডের সাথে সম্পৃক্ত হন। জঙ্গি প্রশিক্ষণের দিক থেকে খায়রুল হাকিমের চেয়ে এগিয়ে ছিল। ফলে খায়রুল জঙ্গি হামলায় অংগ্রহণ করে অন্যদিকে হাকিম জঙ্গি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছিল। হাকিমকে মিরপুরে একটি জঙ্গি আস্তানায় প্রশিক্ষণের জন্য খায়রুল ঢাকায় নিয়ে আসেন। সেখানে হাকিমের নিয়মিত ধর্মীয় উগ্রবাদের পুথিগত শিক্ষার পাশাপাশি অস্ত্র চালনা ও শারীরিক কসরতের প্রশিক্ষণ চলতে থাকে। জঙ্গি সংশ্লিষ্ট কাজে খায়রুলকে সে আর্থিকভাবে সাহায্য করেন। ঐ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের নিয়মকানুন সম্পর্কে হাকিম জানান যে, তাদের প্রতি নির্দেশ ছিল জানালা দিয়ে বাহিরে কোন কাগজ ফেলবেনা, জানালার কাছে কখনও কেহ দাঁড়াবেন না এবং দরজা নক করলে কেহ খুলবেন না, নির্দিষ্ট ব্যক্তিরা দরজা খুলে দিবে। তাদের প্রশিক্ষকদের রুমে প্রবেশ করা নিষেধ ছিল। কিন্তু হাকিম কৌশলে কোন একদিন প্রশিক্ষকদের রুমে উঁকি দিয়ে দেখেন যে, সেখানে রানাসহ আরো ৮/৯ জঙ্গি অবস্থান করছে। সেখানে রয়েছে ল্যাপটপ, প্রিন্টার, ফটোমেশিন ও নানা প্রকারের বই এবং নানাবিধ কেমিক্যাল ও অন্যান্য সরঞ্জমাদি। প্রত্যেকদিন তিন বেলায় তিনজন প্রশিক্ষক বিভিন্ন দোয়া দরুদ শিখানোসহ ইসলামের বিভিন্ন জিহাদ ও যুদ্ধের ব্যাপারে ক্লাশ নিতো। তার প্রশিক্ষণ গ্রহণকালে হলি আর্টিজান শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলা হয়। সেই সময়কার হলি আর্টিজানে জঙ্গিদের হামলার নৃশংস ও বিভৎস দৃশ্য তিনি মেনে নিতে পারেননি। এছাড়া হলি আর্টিজান ও শোলাকিয়া হামলার নেতিবাচক সমালোচনায় অনুশোচনাবোধ করেন এবং পাশাপাশি বিভিন্ন মিডিয়াতে ব্যাপক জঙ্গিবাদ বিরোধী এবং আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় তখন থেকে দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভুগতে থাকেন তিনি। তিনি বুঝতে পারেন যে, তিনি ভুল পথে রয়েছেন। তখন আবদুল হাকিম সুযোগ বুঝে জঙ্গি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হতে পলায়ন করে বাড়ি চলে আসেন এবং পরিবারের সাথে খোলাখুলি আলাপ করেন। তখন পরিবার তাকে আত্মসমর্পণে উৎসাহী করে র‌্যাবের কাছে নিয়ে আসে।

আরেক জঙ্গি মাহমুদুল হাসান বিজয়ের বিষয়ে র‌্যাবের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, মাহমুদুল হাসান গ্রামের একটি সাধারণ পরিবারের সদস্য। শিক্ষা জীবনের শুরুতে খণ্ড খণ্ডভাবে মূলধারা এবং মাদ্রাসা উভয়ে পড়াশুনা করেন তিনি। ২০১১ সালে ৮ম শ্রেণীতে ভর্তি হয়ে পুনরায় মূলধারার শিক্ষা ব্যবস্থায় অন্তর্ভূক্ত হন এবং উচ্চ মাধ্যমিকে অধ্যায়ন অবস্থায় প্রথমে ছাত্রশিবিরে অন্তর্ভূক্ত হন। পরবর্তীতে তিনি মুফতি জসীম উদ্দিন রাহমানির ওয়াজ ও লিখিত বই অধ্যায়ন করে ধর্মীয় উগ্রবাদীতায় আকৃষ্ট হয়ে জঙ্গিদের সহচার্যে এসে জেএমবিতে যোগদান করেন। তিনি বোনারপাড়া, মহিমাগঞ্জ, সারিয়াকান্দি, বগুড়ায় জেএমবিদের বিভিন্ন সভায় যোগদান ও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন এবং এছাড়া সংগঠনের অস্ত্র ক্রয়ের জন্য অর্থ সংগ্রহ করতেন। প্রশিক্ষণে ব্রেন ওয়াশ করে তাকে বুঝানো হয়েছে যে, এই জিহাদের মাধ্যমে সরাসরি জান্নাত লাভ করা সম্ভব। প্রশিক্ষণের বিভিন্ন পর্যায়ে শিয়া মুসলিম, খ্রীষ্টান নাগরিক ও হিন্দু পুরোহিতকে টার্গেট করে হত্যা বা হত্যায় সহযোগিতা করার উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। তাকে ‘থ্রিমা’ ও ‘ভিপিএন’ এ্যাপসের মাধ্যমে যোগাযোগ করার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে তিনি অস্ত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য উত্তীর্ণ হয়েছেন। অস্ত্র প্রশিক্ষণে যোগদানের জন্য ১০ হাজার টাকা নিয়ে প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছিল। কয়েকবার প্রশিক্ষণের জন্য ঢাকায় আসতে বলা হয়েছিল। কিন্তু কখনও পরীক্ষা, অর্থাভাব ও পারিবারিক কারণে আসতে পারেন নাই। সারাদেশে জঙ্গিবাদ বিরোধী নেতিবাচক প্রচারণা ও দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন জায়গায় জঙ্গি বিরোধী সাঁড়াশি অভিযানে তিনি ভীত সন্ত্রস্ত্র হয়ে পড়েন। তিনি বুঝতে পারেন আত্মগোপন কোন সমাধান নয়। এক পর্যায়ে তিনি কৃতকর্মের বিষয়টি পরিবারকে অবগত করলে পরিবার তাকে র‌্যাবের কাছে নিয়ে আসে।

ঢাকা জার্নাল, অক্টোবর ০৫, ২০১৬।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.