নূরলদীনের সঙ্গে কিছুটা সময়

সেপ্টেম্বর ২৯, ২০১৬

masmaskawathমাসকাওয়াথ আহসান : পায়ে শেকল বাঁধা এক নূরলদীনকে জ্যোৎস্না রাতে ঢাকার রাস্তায় রিক্সা চালাতে দেখেছিলাম একবার। রাজধানীর পথ ঘাট সম্পূর্ণ নতুন তার কাছে। সে অনুরোধ করেছিলো পথটা চিনিয়ে দিতে তাকে। তার বাড়ী কোথায় জিজ্ঞেস করতেই সে জানিয়েছিলো, রংপুরে। মনে পড়ে যায় সৈয়দ শামসুল হকের নূরলদীনের কথা।
“রংপুরে নূরলদীন একদিন ডাক দিয়েছিল
১১৮৯ সনে।“

সে অনেক আগের কথা। কিন্তু আমরা বাংলাদেশ আমলে নূর হোসেন নামের এক নূরলদীনকে দেখেছিলাম বুকে পিঠে “স্বৈরাচার নীপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক” লিখে ডাক দিতে। ১১৮৯ সনের নূরলদীনের মতো এই নূর হোসেনকেও হত্যা করেছিলো শাসকের খুনে বাহিনী। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে ঘাতক পাকিস্তানী খুনে বাহিনী খুন করেছিলো আরেক নূরলদীনকে। এই রিক্সাচালকটি যেন চতুর্থ নূরলদীন। মঙ্গার দেশ থেকে ভাতের জন্য সে রাজধানীতে এসেছিলো। সারাদিনের ক্লান্ত পায়ে সে এমন করে রিক্সার প্যাডেল ঘুরাচ্ছিলো জ্যোৎস্না রাতে, সেগুলোকে শেকল বাঁধা পা বলেই ভ্রম হয়। তারমানে নূরলদীন মারা যায়; আবার জন্মায়; আবার মারা যায়। প্রতিটি জনমে ক্ষুধা-দারিদ্র্য-নির্যাতন-নিপীড়ন তার নিয়তি হয়। খুব স্বাভাবিকভাবেই মনে প্রশ্ন জাগে সেই যে ১১৮৯ সন থেকে নূরলদীন বাঁচার লড়াই করছে; এ লড়াই কী অন্তহীন!

“নষ্ট খেত, নষ্ট মাঠ, নদী নষ্ট, বীজ নষ্ট, বড় নষ্ট যখন সংসার”

শত শত বছর ধরে শাসকেরা লুন্ঠন করছে নূরলদীনের জীবন। রাজা যায়, রাজা আসে। প্রতিটি রাজনৈতিক পরিবর্তনকে ঘিরে তৈরী হয় এক একটি নতুন শাসকগোষ্ঠী। কিন্তু নূরলদীনের ভাগ্যের পরিবর্তন হয় না। আন্দোলন সংগ্রামে নূরলদীন ব্যবহৃত হয় শাসকের ফাঁসিতে জীবন দেবার জন্য; কিংবা বুলেটের সামনে বুক পেতে দেবার জন্য। কারণ নূরলদীনের পিঠ যখন দেয়ালে ঠেকে যায়; সে তখন ঘুরে দাঁড়ায়,
গোল হয়ে আসুন সকলে,
ঘন হয়ে আসুন সকলে,
আমার মিনতি আজ স্থির হয়ে বসুন সকলে।
অতীত হঠাৎ হাতে হানা দেয় মরা আঙিনায়।

যে নূরলদীন বৃটিশের বিরুদ্ধে তীর ধনুক নিয়ে লড়াই করে প্রাণ দিয়েছিলো, সেই নূরলদীনই পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে রাইফেল নিয়ে লড়াই করে প্রাণ দিয়েছিলো। নূরলদীনের ঘাড়ে পা দিয়ে এক একটি নতুন স্বাধীনতার সুফল কুড়ায় এক একটি সুবিধাবাদী শকুনী গোষ্ঠী।
আবার বাংলার বুঝি পড়ে যায় মনে,
নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়
যখন শকুন নেমে আসে এই সোনার বাংলায়;
নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়।

শকুনেরা কী তবে পিছু ছাড়বে না নূরলদীনের। ঠিক আরো কতজন নূরলদীন জীবন দিলে “দ্রোহে”-র মাঝ দিয়ে নূরলদীনের জন্য একটি নতুন জীবন রচিত হবে। বেশী কিছু কোনদিনই চায় নি নূরলদীন। সামান্য ভাত-কাপড়-আশ্রয়। শুধু এইটুকু পেতে নিজভূমে পরবাসী নূরলদীনের এতো লড়াই। অথচ শাসকেরা সব সময়ই হৃষ্টপুষ্ট। তারা একইভাবে হেলিকপ্টার থেকে নামে, ফুলের মালা গলায় দিয়ে মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে আশ্বাস দেয়। বর্গীরা যেমন রাজার বেশে আসতো হানা দিতে; ঠিক তেমনি করে প্রতিটি রাজা আকারের শাসকই আসে নূরলদীনের কুঁড়ে ঘরে হানা দিতে।
“যখন আমার দেশ ছেয়ে যায় দালালেরই আলখাল্লায়;
নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়
যখন আমার স্বপ্ন লুট হয়ে যায়;
নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়
যখন আমার কণ্ঠ বাজেয়াপ্ত করে নিয়ে যায়;
নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়
যখন আমারই দেশে এ আমার দেহ থেকে রক্ত ঝরে যায়
ইতিহাসে, প্রতিটি পৃষ্ঠায়।“

বৃটিশ আমলে যে পুলিশ বিদ্রোহী নূরলদীনকে ধরে নিয়ে গিয়েছিলো ফাঁসি দিতে, পাকিস্তান আমলের যে মিলিটারীর বুলেট মুক্তিযোদ্ধা নূরলদীনের বুক ঝাঁঝরা করে দিয়েছিলো; এরপর বাংলাদেশ কালে একই রকম পুলিশ-মিলিটারীর ওঁচানো অস্ত্র, বুটের শব্দ; কিংবা রাত-বিরেতে রিক্সাচালানোর সময় নূরলদীনের পথ রোধ করে তারা যেভাবে “ধমক” দেয়, যত্রতত্র লাঠির বাড়ি দেয়, কিংবা কোন একটি মামলার আসামী সাজিয়ে নিয়ে যায়; পুলিশের ঘুষিতে ঠোঁট ফেটে যেভাবে রক্ত গড়িয়ে পড়ে; এ যেন একই দৃশ্য ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখা জন্ম-জন্মান্তরে। নূরলদীনের মাঝে বার বার দ্রোহের আগুন জ্বলে। সে যেন বিড় বিড় করে ডাকে ভাগ্যহত লাখো নূরলদীনকে।
“আসুন, আসুন তবে, আজ এই প্রশস্ত প্রান্তরে;
যখন স্মৃতির দুধ জ্যোৎস্নার সাথে ঝরে পড়ে,
তখন কে থাকে ঘুমে? কে থাকে ভেতরে?
কে একা নিঃসঙ্গ বসে অশ্রুপাত করে?
সমস্ত নদীর অশ্রু অবশেষে ব্রহ্মপূত্রে মেশে।“

সেই জ্যোৎস্না রাতে রিক্সাচালক নূরলদীনের ফেলে আসা গ্রামের স্মৃতিচারণের ক্ষণে তার চোখে অশ্রু দেখেছিলাম। প্রতিদিনই এরকম অসংখ্য নূরলদীনের অশ্রুজল এসে অবশেষে নদীতে মেশে; অথবা তৈরী করে অশ্রু নদী। আমার মনে হয়েছিলো নূরলদীনেরা পরাজিত মেঘদল; সেখান থেকে কান্নার বৃষ্টি ঝরে, অন্য নূরলদীনেরা তখন ঘুমিয়ে থাকে কিংবা থাকে ঘরের ভেতরে। কেউ এসে নূরলদীনের অশ্রুপাতের সঙ্গী হয় না।
আমি শুধু বলেছিলাম, নূরলদীন আপনাকে পথঘাট নিজেই চিনে নিতে হবে; কতদিন আর যাত্রীকে পথ চিনিয়ে দিতে বলবেন। কেউ কাউকে পথ চিনিয়ে দিতে পারে না। নিজের মুক্তির পথ নিজেকেই খুঁজতে হবে।
হঠাতই রিক্সাচালক নূরলদীনের চেহারা বদলে যায়। উলটো হাতে চোখের পানি মুছে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলে, ঠিকই চিনে নিবো। এইতো আর কয়টাদিন।

অকস্মাতই মনে হলো, এই নূরলদীন সৈয়দ শামসুল হকের স্বপ্নের নায়ক নূরলদীন; সে এতো সহজে হেরে যাবার মানুষ নয়। রিক্সাচালক নূরলদীন তার ছেলেটিকে লেখাপড়া শেখানোর স্বপ্নের কথা বলে। স্পষ্ট বোঝা যায় নূরলদীনের স্বপ্ন চুরি করা এতো সহজ নয়। নূরলদীন যে অপরাজেয়,তার জেগে ওঠার আহবান যে অনিবার্য।

“নূরলদীনের কথা যেন সারা দেশে
পাহাড়ী ঢলের মতো নেমে এসে সমস্ত ভাসায়,
অভাগা মানুষ যেন জেগে ওঠে আবার এ আশায়
যে, আবার নূরলদীন একদিন আসিবে বাংলায়,
আবার নূরলদীন একদিন কাল পূর্ণিমায়
দিবে ডাক,”জাগো, বাহে, কোনঠে সবায়?”

ঢাকা জার্নাল, সেপ্টেম্বর ২৯, ২০১৬।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.