আকতার জাহানের ‘সুইসাইড নোট ।। কাবেরী গায়েনের বিশ্লেষণ

সেপ্টেম্বর ১৪, ২০১৬

akter-jahanড. কাবেরী গায়েন ।। আকতার জাহানের সাথে পরিচয় অন্তত ২৫ বছর। প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, একই বিভাগের শিক্ষার্থী হিসেবে। পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকর্মী হিসেবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে আকতার জাহান আমাদের তিন বছরের জুনিয়র ছিলেন। আমরা তখন তাকে চিনতাম জলি নামে।

আমাদের বিভাগের এক বছরের সিনিয়র ভাই তানভীর আহমদকেও চিনতাম প্রবাল ভাই হিসেবে। শিক্ষার্থী জীবনে কথা হয়নি বললেই চলে। তাঁর সাথেও আলাপচারিতা বলতে করিডোরে মুখোমুখি হলে মৃদু হাসি বিনিময়। তিনি মৃদুভাষী।জলির ব্যাচের অনেকের কথাই এখন হয়তো মনে নেই, কিন্তু জলির কথা মনে থাকতো, এমনকি বিভাগীয় সহকর্মী হিসেবে পরে না পেলেও। প্রতিবছর নতুন শিক্ষার্থীরা এলে বিভাগে একটা সাড়া পড়ে। বিশেষ করে আগের সব ব্যাচের ‘বড় ভাইদের ভেতরে। সেই সাড়া বিভাগের বড় বোনদের কানেও পৌঁছে যায়। আমার ব্যাচমেটদের কারো কারো আলোড়ন থেকে একটু বিশেষভাবেই জলিকে চিনেছিলাম। জলির চেহারার বিশেষত্ব ছিলো তার গভীর চোখ, যা এড়ানো যায় না। গভীর বাদামী চোখের এই ‘কালো’ মেয়েটির সপ্রতিভ চলাফেরা অনেকেরই নজর কাড়তো। আর্মি অফিসারের মেয়ে, বেশভূষায় পরিপাটি স্বচ্ছলতার চিহ্ন ষ্পষ্ট। শিক্ষার্থী অবস্থায় মুখোমুখি হয়ে গেলে মৃদু হেসে সালাম দিতেন। সেইভাবে কথা হয়নি তখন।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ বিভাগে যোগ দিয়েছিলাম পাশ করার পরপরই। আমি যে বছর যোগ দেই তার এক-আধ বছরের মধ্যে তানভীর আহমদ যোগ দেন। তখনই প্রথম জানতে পারি জলির সাথে তানভীর ভাইয়ের বিয়ের কথা। এবং কিছুদিনের মধ্যে জলিও যোগ দেন। তাঁদের সম্পর্ক চমৎকার বলেই জানতাম বরাবর।

akhter২০০৭ সালে আমার বাবা মারা যাবার পরে যখন বিধ্বস্ত অবস্থায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যাই, তখন একদিন জলি তার বাসায় নিয়ে যত্ন করে খাইয়েছিলেন। সেই তাঁদের বাসায় আমার প্রথম এবং শেষ যাওয়া। অত্যন্ত পরিপাটি গোছানো সংসার। সেই সংসারে কোন মলিনতা চোখে পড়েনি। এছাড়াও, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অলস নিস্তরঙ্গ জীবনে জুবেরীতে, শ্রেণীকক্ষে পরীক্ষার হলে, বিভাগ-ভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষা শুরু হলে ঘন্টার পর ঘন্টা একত্রে খাতা দেখা-এসবের মধ্য দিয়ে নিজেদের ভেতর যে বন্ধন আমাদের মধ্যে গড়ে উঠেছিলো, সেই জীবনে তানভীর ভাই এবং জলি দুজনের সাথেই আমার সম্পর্ক ছিলো মমতাময়, বন্ধুত্বপূর্ণ। এমনকি, ২০১৫ সালের মে মাসে যখন আনসারউল্লাহ বাংলা টিমের পাঠানো হত্যার হুমকি প্রকাশিত হলো, তখন ফেসবুকে তানভীর ভাইয়ের মমতাময় উৎকন্ঠার কথা আমি এখনো মনে করি।

দুই।

মানুষের ব্যক্তিগত সম্পর্ক নিয়ে আলোচনায় আগ্রহ বরাবরই কম। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ছেড়েছি সেও তো বহু বছর হয়েছে। ২০১১ সালের দিকে বোধহয় শুনলাম এই চমৎকার দম্পতির সম্পর্কে ভাঙ্গনের কথা। শুনেছি জলি জুবেরীতে উঠেছেন। তাঁদের পরিপাটি সাজানো সংসার চোখের সামনে ভেসেছে। কিন্তু এ পর্যন্তই। দুজন পরিণত বয়স এবং সম্মানিত পেশার মানুষের সম্পর্ক নানা কারণেই ভেঙ্গে যেতে পারে। তাঁদের সচেতন সিদ্ধান্তের প্রতি সম্মান রেখে কোনদিন জিজ্ঞেস করিনি কেনো এমন হলো। তানভীর ভাইয়ের সাথে ফেসবুকে যোগাযোগ থাকার কারণে দেখতাম তাদের সন্তান সোয়াদকেও। বুঝতাম, সোয়াদ তানভীর ভাইয়ের কাছেই থাকে।

গত বছর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমার ওখানে চাকরি-অভিজ্ঞতার প্রত্যয়নপত্র আনার প্রয়োজন হয়েছিলো। তানভীর ভাই তখন বিভাগীয় প্রধান। একদিন ফোন করলাম এ বিষয়ে সাহায্যের অনুরোধ করে। তিনি বললেন, খানিক আগেই তিনি সোয়াদের সাথে আমার উপস্থাপনায় সময় টেলিভিশনে প্রচারিত ‘শুরু হোক কথা বলা অনুষ্ঠানটি দেখছেন। অনুষ্ঠানটি বয়ো:সন্ধিকালীন প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ক অনুষ্ঠান।

ru-teacherশুনে ভালো লাগলো, নিজের কিশোর ছেলেকে সাথে নিয়ে একজন পিতা এমন এক অনুষ্ঠান দেখেছেন, যেখানে বেশিরভাগ মা-বাবাই সন্তানদের সাথে এমন অনুষ্ঠান দেখতে বিব্রতবোধ করতে পারেন। ফের গত বছর যখন জানলাম, ফেসবুকেই, তানভীর ভাইয়ের নতুন বিয়ের কথা, ডিভোর্সের চার বছর পরে তাঁর ফের বিয়ে করায় কোন অস্বাভাবিকতা না পেলেও জলির প্রতি সম্মানবশত এই বিয়ের খবরে অভিনন্দন জানাতে পারিনি। চুপ থাকাই শ্রেয় বোধ করেছি।

এরই মধ্যে ৯ সেপ্টেম্বর আচমকা জলির আত্মহত্যার খবর পড়ে বিমূঢ় হয়ে যাই। আমার ব্যক্তিগত শোকের কোন কিনারা নেই। এতো চমৎকার, প্রতিষ্ঠিত একজন মানুষ এভাবে কেনো আত্মহত্যা করবেন? ইতিমধ্যে তাঁর প্রাক্তন স্বামীর সাথে তাঁর সম্পর্ক নিয়ে তুমুল আলোচনা শুরু হয়েছে সামাজিক মাধ্যমে। ক্ষেত্রবিশেষে নানা অন-লাইন পত্রিকাতেও এই মৃত্যুর জন্য তাঁর স্বামীকে নানা ধরনের দোষারোপ করা হচ্ছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আলোচিত হচ্ছে জলির প্রতি তাঁর নানা ধরনের অবহেলা আর অত্যাচারের কথা। সেসব কথার বেশিরভাগই জলির কাছের বন্ধুরা তাঁর মুখে শুনেছেন বলে জানিয়েছেন।

এমনকি তাঁদের কেউ কেউ জলির এইসব দু:খদিন যাপনের সাক্ষী বলেও দাবি করেছেন। আমি যে তানভীর ভাইকে চিনি বলে মনে করতাম, সেই ব্যক্তির সাথে এইসব অভিযোগ, সত্যি বলতে, মেলাতে পারি না। আবার অন্যদিকে, জলির আত্মহত্যার বিষয়টি একটি জ্বলন্ত সত্য। একজন মানুষ কতোটা বিপন্নবোধ করলে আত্মহত্যার মতো চরম সিদ্ধান্ত নিয়ে কার্যকর করে ফেলতে পারেন, সেটি ভাবছি গত দুদিন ধরে।

জলির মুখ থেকে যেহেতু আমি কিছু শুনিনি, এবং শুনিনি তানভীর ভাইয়ের মুখ থেকেও এবং এসব কথার কোন সত্যাসত্য যাচাইয়ের আপাতত কোন উপায় নেই, আমি বরং মৃত্যু-মূহুর্তে জলির সুইসাইড নোটকেই একটু পাঠকের সাথে পাঠ করে ঘটনাটি বোঝার চেষ্টা করি। তারপর এই ঘটনার উপর প্রকাশিত দু‘একটি প্রতিনিধিত্বশীল লেখাও দেখবো।

একই বিভাগে কাজ করার সূত্রে, নোটের এই হাতের লেখা জলির বলেই মনে হয়। অবশ্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থী দাবি করেছেন, এই নোটের উপরের অংশের সাথে নীচের অংশ না কি জুড়ে দেয়া। অর্থাৎ কিছু অংশ বাদ দেয়া হয়ে থাকতে পারে। এই দাবি সত্য হলে ঘটনা যা উপর থেকে দেখা যাচ্ছে, সেটিই সব নয়। সেক্ষেত্রে ভিন্ন তদন্ত প্রয়োজন। আমি এই লেখায় ইতিমধ্যে পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত সুইসাইড নোটটিকেই বিবেচনা করছি। যদিও নোটটির উপরের দুই স্তবকের পরে একটি পরিস্কার দাগ দেখা যাচ্ছে।

তিন।

‘আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। শারীরিক, মানসিক চাপের কারণে আত্মহত্যা করলাম।’

তিনি শারীরিক-মানসিক চাপের কারণে আত্মহত্যা করেছেন। এটি প্রায় একটি মান-বাক্য। বেশিরভাগ সুইসাইড নোটের শুরুতে এই বাক্যটি আমরা দেখি। কিন্তু জলির ক্ষেত্রে এই বাক্যটির বিশেষ তাৎপর্য আছে, যা আমরা আলোচনা করবো অন্যদের লেখার সাপেক্ষে।

‘সোয়াদকে যেনো ওর বাবা কোনভাবেই নিজের হেফাজতে নিতে না পারে। যে বাবা সন্তানের গলায় ছুরি ধরতে পারে- সে যে কোন সময় সন্তানকে মেরেও ফেরতে পারে বা মরতে বাধ্য করতে পারে।

এই অভিযোগটি ভয়ঙ্কর। যে বাবার হেফাজতে ছেলেটি ২০১১ সাল থেকে বড় হয়েছে, ছেলের সেই বাবাকে জলি আর বিশ্বাস করতে পারছেন না। কারণ বাবা তাঁর সন্তানের গলায় ছুরি ধরেছেন বলে পরিস্কার অভিযোগ। তিনি ভয় পেয়েছেন যে বাবা সন্তানকে মেরে ফেলতে বা মরতে বাধ্য করতে পারেন।

‘আমার মৃতদেহ ঢাকায় না নিয়ে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে দেয়ার অনুরোধ করছি।

আমি যে জলিকে চিনি, সেই জলি ধর্মপ্রাণ। সমাজের প্রচলিত রীতিনীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাকে আর যাই হোক, র‌্যাডিক্যাল হিসেবে দাবি করার কোন সুযোগ নেই। তিনি কেনো ধর্মীয় পথে সমাহিত হবার পরিবর্তে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালকে দেহ দান করার শেষ ইচ্ছা প্রকাশ করে গেলেন? ঢাকায় স্বজনদের কাছে, এমনকি যেখানে তাঁর একমাত্র সন্তান এখন বসবাস করছে, সেখানে ফিরে না গিয়ে তিনি রাজশাহীর মেডিক্যাল কলেজে নিজেকে দান করার যে ইচ্ছা ব্যক্ত করে গেলেন সেটি কি কোন অভিমান থেকে নিজের পরিবারের প্রতি? কিংবা যে সমাজের রীতিনীতির প্রতি ছিলো তাঁর অগাধ আনুগত্য, সেইসব রীতির প্রতি কি তিনি  প্রতিবাদ জানিয়ে গেলেন এই ইচ্ছা প্রকাশের মধ্য দিয়ে?

এইসব প্রশ্নের সরাসরি কোন উত্তর পাওয়ার উপায় নেই আর। কিন্তু তাঁর বন্ধু-স্বজনদের লেখা থেকে তাঁর এই সুইসাইড নোটের খানিকটা ব্যাখ্যা বোধহয় করা যায়।

চার।

প্রসঙ্গ: শারীরিক-মানসিক চাপ।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শাওলী মাহবুব ‘আকতার জাহান যা বলেছিলেন আমাকে’ (উইমেন চ্যাপ্টার, ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৬) শীর্ষক লেখায় এক দীর্ঘ বর্ণনা দিয়েছেন এই মানসিক-শারীরিক চাপের। তিনি জানাচ্ছেন, নিজের উপার্জনের উপর ব্যক্তিগত অধিকার জলির ছিলো না। স্বামীর অনুমতি ছাড়া তিনি ব্যয় করতে পারতেন না। একাডেমিক কোন কাজে স্বামীর অনুমতি ছাড়া অংশ নিতে পারতেন না। স্বামীর অনুমতি ছাড়া বাসায় কাজের সাহায্যকারী রাখতে পারতেন না। রান্নাবান্নাসহ বড় হাঁড়িতে পানি ফুটানো এবং টানতে টানতে তাঁর পিঠে ব্যথা হয়ে গিয়েছিলো যা ভারত থেকে চিকিৎসা করে এসেও আরোগ্য হয়নি। প্রেমের বিয়ে হওয়া সত্ত্বেও স্বামী যৌতুক নিয়েছেন বিয়েতে যা বিচ্ছেদের পরে ফেরত পাননি। দীর্ঘ বিবাহিত জীবনে স্বামীর কাছ থেকে তিনি কোন উপহার পাননি। উপরন্তু তাঁর প্রাক্তন স্বামী বিভিন্ন নারীর সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলতেন। শাশুড়ির কাছে গঞ্জনা পেয়েছেন ‘কালো বৌ’ হবার জন্য। এবং এতো কিছুর পরেও তিনি বাড়ি থেকে বিয়ে বিচ্ছেদের অনুমতি পাননি।

এসবিডি২৪ডটকম-এর সাবেক নির্বাহী সম্পাদক রিফাত ফাতিমা ‘মহারাজা, তোমারে সেলাম’ (উইমেন চ্যাপ্টার, ১২সেপ্টেম্বর ২০১৬) শিরোনামের লেখায় জানাচ্ছেন, জলির প্রাক্তন স্বামী এমনকি তাঁর চেহারা নিয়েও কটাক্ষ করতেন।

বর্ষা জোহিন তাঁর ফেসবুক নোটে (১০ সেপ্টেম্বর ২০১৬) একই ধরনের মানসিক-শারীরিক নির্যাতনের কথা লিখেছেন। তিনি লিখেছেন, এমনকি গর্ভাবস্থায় কিছু খেতে চাইলেও তাঁর প্রাক্তন স্বামী কিছু এনে দেয়নি কোনদিন। জলির প্রাক্তন স্বামীর চরিত্র-বিকৃতির ইঙ্গিত করে লিখেছেন, ‘কার রুচি কাজের বুয়া অব্দি পৌঁছেও বড় বড় কথা বলায়’। এমনকি তিনি লিখেছেন, জলিকে ছুরি নিয়ে তাড়া করার পরেই কেবল জলি সেই সংসার ছেড়েছেন।

এইসব বর্ণনা পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিলো সতেরো-আঠারো শতকের কোন প্রত্যন্ত গ্রামের দাসীসম কোন নারীর জীবন-আখ্যান পড়ছি।

প্রসঙ্গ: সন্তানের হেফাজত।

শাওলী মাহবুব, রিফাত ফাতিমা এবং বর্ষা জোহিনের লেখা থেকে স্পষ্ট যে সোয়াদকে তার মায়ের সাথে দেখা করতে দেয়া হতো না। এমনকি লুকিয়ে মায়ের সাথে ফোনে কথা বলার জন্য সোয়াদের গলায় ছুরি ধরা হয়েছিলো। এই প্রসঙ্গটিই সুইসাইড নোটেও পাওয়া যায়।

প্রসঙ্গ: মৃতদেহ ঢাকায় নয়, রাজশাহী মেডিক্যালকে দেয়ার ইচ্ছা।

কেনো এ ইচ্ছা, সে বিষয়ের খানিক ইঙ্গিত বুঝি পাওয়া যায় শাওলী মাহবুবের লেখায়। এতো অপমানজনক সম্পর্ক থেকে বের হয়ে আসার অনুমতি তাঁর পরিবার তাকে দেয়নি পারিবারিক মর্যাদার কথা ভেবে। হয়তো সেই বিষয়ে ক্ষোভ কাজ করেছে।

পাঁচ।

তবু তুমি আরেক মৃত্যুকে রোধ কর। শারীরিক-মানসিক নিপীড়নের যে ভয়াবহ বর্ণনা জলির ঘনিষ্ঠজনরা দিয়েছেন, সেসব সত্য হলে জলির জন্য আমি শোকাহত, কিন্তু তাঁকে সমর্থন করতে পারছি না। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের যদি স্বাধীনভাবে একাডেমিক কাজে অংশগ্রহণের স্বাধীনতা না থাকে, যদি নিজের ইচ্ছা-পছন্দে নিজের অর্জিত অর্থ ব্যয় করার স্বাধীনতা না থাকে, যদি অসুস্থ হয়ে যাবার মতো শারীরিক পরিশ্রম করে জীবন চালাতে হয়, যদি স্বামীর ‘অন্য নারীতে আসক্তি’ মেনে নিতে হয় যা ক্ষেত্রবিশেষে ‘কাজের বুয়া অব্দি’ পৌঁছে, যদি ‘কালো’ রঙের খোঁটা শুনে জীবন পার করতে হয়, যদি যৌতুক নিয়ে বিয়ে করা স্বামীর সাথে ঘর করতে হয় এবং তারপরও সেই সংসার থেকে বের হয়ে আসার জন্য স্বামী তার গলায় ছুরি ধরেছেন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়- তবে, আমি দু:খিত, তাঁকে সমর্থন করা যাচ্ছে না এই জীবনযাপনের জন্য।

তিনি শিক্ষক, তাঁর কাছ থেকে অন্য মেয়েরা কী শিখবে, এসব অন্যায় মেনে নেয়া ছাড়াĪ রিফাত ফাতিমা লিখেছেন এসব নিয়ে কথা বলতে তাঁর ‘রুচিতে বাঁধতো’। রিফাত ফাতিমা আরো লিখেছেন, ‘ছোট ছোট বাক্যে ফিসফিস করে বলেছিলেন’ খুব নিকটজনের কাছে এসব কথা এক-আধবার। রিফাত, শাওলী, বর্ষা- এঁরা সবাই আমার অনুজপ্রতীম-স্নেহভাজন। কিন্তু, তাঁদের বেদনার প্রতি সম্মান জানিয়েই, এই অ্যাপ্রোচকে, অর্থাৎ নিপীড়ণের এই ঘোর কাটাতে না পারার অক্ষমতাকে মহিমান্বিত করার আবেগকে খুব একটা সমর্থন করতে পারছি না।

ড. কাবেরী গায়েন

এসব ঘটনায় বহু আগেই সংসার ছেড়ে আসা প্রয়োজন ছিলো। জলিকে যে ছুরি নিয়ে তাড়া করা হলো, জলি কি কখনো সেজন্য পুলিশ কেস করেছেন? এটা না করাটা আসলে উঁচু-রুচির পরিচয় না, ‘হত্যাচেষ্টাকে’ আইনের দ্বারস্থ করাই একজন দায়িত্বশীল নাগরিকের কাজ। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কাজটি না করতে পারলে আর কার কাছে আশা করা যাবে?

তারপর আত্মহত্যা। সন্তানের গলায় ছুরি ধরেছেন পিতা-এ হেনো নাজুক অবস্থা যে সন্তানের, সেই সন্তানের পাশে না দাঁড়িয়ে তিনি কেনো আত্মহত্যা করলেন? এই সন্তানকে এখন তাহলে কে দেখবে? তিনি কার হাতে সন্তানের দায়িত্ব দিয়ে গেলেন? নিজের গলায় ছুরি ধরায় তিনি হয়তো পুলিশ কেস করেননি সন্তানের নিরাপত্তার কথা ভেবে, কিন্তু সন্তানের গলায় ছুরি ধরার পরে সেই পিতার বিরুদ্ধে কি কোন পুলিশ কেস করেছেন? না করলে, কেনো করেননি? এই না করাটাকে পৃষ্ঠপোষকতা দেবার কিছু নেই। বিষয়টি কেবল হা-হুতাশের নয়।

সবচেয়ে বড় কথা, জলি তো সেই অসম্মান আর পীড়নমূলক সম্পর্ক থেকে বের হয়ে এসেছিলেন। তাদের আনুষ্ঠানিক বিচ্ছেদ হয়ে গেছে চার বছর হলো। ফেসবুকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের অন্যান্য সহকর্মীদের ফেসবুক পোস্টে বিভাগের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের ছবিতে তানভীর ভাই, তাঁর নতুন স্ত্রী বিভাগীয় শিক্ষক সোমা দেব এবং জলিকে অন্যান্যদের সাথে একত্রেই দেখা গেছে। একই বিভাগে কাজ করলে এমনই হবার কথা। যে মানুষের মনে এতো জোর, তিনি কেনো হঠাৎ আত্মহত্যা করলেন সেই সময়ে যখন তাঁর ছেলের হেফাজত তিনি পেয়েছেন অবশেষে!

যখন তাঁর সন্তানের পাশে তাঁরই দাঁড়ানো প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি! আমার মনে হয়, শুধু অতীতের অপমানমূলক সম্পর্কের মধ্যে এই আত্মহত্যার কারণ খুঁজে সত্যে পৌঁছানো যাবে না। বরং হতে পারে, জলি অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন, যে ক্লান্তিতে আশ্রয় নেবার মতো কোন ঘর আর তাঁর ছিলো না। কেনো আশ্রয় নেবার ঘর মেয়েদের থাকে না, সে বিষয়েই আলোচনাটা হওয়া দরকার।

জলির তিন ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সাক্ষ্য থেকে পরিস্কার, জলি শারীরিক-মানসিক অত্যাচারের শিকার হয়েছেন একদিন ভালোবেসে বিয়ে করা স্বামীর কাছে। কিন্তু তিনি ‘ভালোমেয়ে’র ইমেজ ধরে রাখতে চেয়েছেন। তাই একেবারে ‘ছুরি নিয়ে’ তাড়া না করা পর্যন্ত স্বামীর সাথে গড়ে তোলা ঘর ছাড়েননি। তাঁর পরিবার তাঁকে বিয়ে বিচ্ছেদের অনুমতি দেয়নি ‘পারিবারিক মর্যদা’র কথা ভেবে। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপকের কি সত্যিই পারিবারিক অনুমতির দরকার হয় নিজের জীবনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার জন্য? হয়, যদি তিনি পরিবারের কাছে ‘ভালোমেয়ে’ ইমেজ ধরে রাখতে চান। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই বিয়েবিচ্ছেদের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই তাঁকে যেতে হয়েছে। যুক্ত হয়েছে মুখরোচক পরকীয়ার ‘গুজব’। দীর্ঘদিন পর্যন্ত। এমনকি কিছু শুনতে না পাওয়া আমার কানেও এসেছে সেই গুজব বহুদিন আগেই। অর্থাৎ ‘ভালোমেয়ে’-র ইমেজ তিনি পরিবারে বা সমাজে ধরে রাখতে পারেননি এতো চেষ্টা সত্ত্বেও। সেজন্যই কি তিনি সন্তানের হেফাজত পাননি? বিয়ে বিচ্ছেদ হলেও সন্তানের হেফাজত কেনো তিনি পেলেন না জানি না। তিনি কি আইনী লড়াইটা করেছিলেন? অন্ততপক্ষে সন্তানের সাথে দেখা হওয়াটা তো কেউ আটকে দিতে পারে না। বা কেউ আটকে দিতে চাইলে আইনের দ্বারস্থ তো হওয়াই যায়।

যাঁরা তাঁর ঘনিষ্ঠজন, তাঁরা এই পরামর্শ কি তাঁকে দেননি?

শাওলী মাহবুব লিখেছেন, জলি শেষদিনগুলোতে মেলামাইনের প্লেটে ভাত খেতেন। কাম অন, জলি সহযোগী অধ্যাপক, থাকতেন জুবেরীতে, বাস করতেন রাজশাহীতে। তাঁর মেলামাইনের প্লেটে ভাত খাবার মতো অর্থনৈতিক দারিদ্র ছিলো না। কিন্তু যে সমাজকে তিনি ট্যাক্স দিয়ে চলেছেন, সেই সমাজের অদৃশ্য চাহিদামাফিক বিয়ে-বিচ্ছেদ হয়ে যাওয়া নারীর যে গরীব চেহারাটা কাম্য, তিনি সেই চেহারাটার প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে চেয়েছেন। অজান্তেই।

কারণ, সমাজের চাহিদা হলো, স্বামীহীন নারীর কোন জৌলুষ থাকবে না। সমাজ আর পিতৃতন্ত্রের চাহিদামাফিক স্বামীহীন নারীর সবক’টি চিহ্নের প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে গিয়ে ক্রমাগত তিনি নিজেকে বঞ্চিত করেছেন এবং সেই বঞ্চনা তাঁর শক্তি আর লড়াই করার ক্ষমতাকে তিলে তিলে শেষ করে শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা পর্যন্ত ঠেলে দিয়েছে।

এই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়ায়, আসলে অনেক প্রপঞ্চই জড়িত। একজন পূর্ণ-বয়স্ক, স্বাবলম্বী মানুষের জীবনে সম্পর্কের ভাঙ্গা-গড়া হতেই পারে। বরং যে ধরনের নিপীড়নের বিবরণ পাওয়া গেছে নানাজনের লেখায়, সেই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে পারাটাই হওয়ার কথা ছিলো তাঁর মুক্তি। অথচ সেভাবে ভাবতে তাঁকে কেউ সাহায্য করেনি- প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বা কর্মক্ষেত্রে তো নয়ই, তাঁর স্বজন বা বন্ধুরাও নয়। এবং, শেষ পর্যন্ত সেই মুক্তি পেয়েও তিনি উদযাপন করতে পারলেন না।

যে প্রফেশনাল মানসিক চিকিৎসা তাঁর পাবার কথা ছিলো, সেই ব্যবস্থাও নেই, সেই সঠিক দিকনির্দেশনা দেবার মানুষজনও নেই। জলি নিজে এবং তার কাছের মানুষরা এসব ঘটনা চেপে রাখতেই সব শক্তি নিয়োগ করেছেন। বিচ্ছেদপ্রাপ্ত নারীর যে সর্বস্বহীন অবয়ব নির্মিত হয়ে আছে আমাদের চারিপাশে, সেই অবয়ব ধরে রাখার অবিরত লড়াইয়ে একধরনের ‘শ্রদ্ধা’ কুড়িয়ে তিনি আত্মহননের পথেই মুক্তি খুঁজলেন। এই ‘ফাঁপা শ্রদ্ধা’র ফাঁদ থেকে বেরিয়ে না আসা পর্যন্ত মেয়েদের মুক্তি নেই।

জলির স্মৃতির প্রতি অশেষ ভালোবাসা আর বেদনা।

তবে, বেঁচে থাকা মেয়েদের প্রতি অনুরোধ, সমাজে ‘ভালোমেয়ে’ হওয়ার চাহিদার ফাঁদে পড়া অনেকটা যীশুর মতোই নিজেকে বিদ্ধ করার ক্রুশকাঠ নিজের কাঁধে চাপিয়ে বধ্যভূমির দিকে হেঁটে যাবার সামিল। এই ক্রুশকাঠ ফেলে না দিতে পারলে মুক্তি নেই।

কখনো সুতপা, কখনো ফাহমিদা, কখনো রুমানা মঞ্জুর, কখনোবা আকতার জাহান হয়ে সংবাদ-শিরোনাম হওয়া শুধু। ভাগ্য ভালো থাকলে এই ভালোমেয়েত্ব অর্জনের কিছু পুরস্কার পেতেও পারো, কিন্তু বিপন্নতায় কেউ নেই কাছে। এখন সিদ্ধান্ত তোমার।

অনুরোধ, তুমি শুধু আরেকটি মৃত্যুকে রোধ করো।

kaberi-gayen-1ড. কাবেরী গায়েন, লেখক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক।

 

 

 

ঢাকা জার্নাল, সেপ্টেম্বর ১৩, ২০১৬।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.