এ মৃত্যুর দায়ভার কার?

সেপ্টেম্বর ১২, ২০১৬

tangiমাসকাওয়াথ আহসান ।। কিছু দিন পরপরই বিভিন্ন শিল্প কারখানায় অগ্নিকান্ড-ভবন ধসের মত ঘটনা ঘটে শ্রমিক মারা যায়। প্রতিবারই প্রতিটি মৃত্যুর পর সরকারের পক্ষ থেকে মন্ত্রী বলেন এ ধরণের ঘটনা যেন আর না ঘটে সেজন্য তারা উদ্যোগ নেবেন। প্রতিবারই একাধিক তদন্ত কমিটি হয় এবং যথারীতি সে তদন্ত কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন আলোর অন্তরালে থেকে যায়। তাজরীন ফ্যাশনস এর অগ্নিকান্ড এবং রানাপ্লাজা ধসে পড়ার মত এতবড় দুর্ঘটনা ঘটে যাবার পরও তার উপযুক্ত বিধান না হওয়া এবং দোষীদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ না করাই কী আজকের গাজপুরের অগ্নিকান্ডের অন্যতম কারণ নয়?

রানা প্লাজায় সহস্রাধিক মানুষ নিহত হবার পরে বাংলাদেশের শিল্প-কারখানার কাজের পরিবেশকে উন্নত করতে সরকার কারখানা পরিদর্শন দপ্তরকে অধিদপ্তরে রুপান্তর করে এবং নতুন করে প্রায় ১৫০ জন পরিদর্শক নিয়োগ করা হয়। আরও প্রায় শতাধিক পরিদর্শক যোগদানের অপেক্ষায়। কিন্তু এর ফলাফলটি কাংক্ষিত মাত্রায় আসতে পেরেছে কী? যদি না পেরে থাকে তাহলে সে দায় কার?

গাজীপুরের যে ফয়েল কারখানাটিতে অগ্নিকান্ড ঘটলো সেটি কারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তরের লাইসেন্স ছাড়া চালু থাকার কথা নয়। প্রতিবছরের মত এবছরও নিশ্চয়ই কারখানাটির লাইসেন্স নবায়ন করা হয়েছে। লাইসেন্স নবায়নকারী কর্মকর্তা, কী কারখানাটির নিরাপত্তা ব্যবস্থা যাচাই করে লাইসেন্স নবায়ন করেছিলেন? যিনি বা যারা ওই এলাকায় দায়িত্বপ্রাপ্ত শ্রম পরিদর্শক তারা কী কারখানাটি যথাযথভাবে পরিদর্শন করেছিলেন? যদি না করে থাকেন তাহলে কেন করেননি?

অভিযোগ আছে, কারখানার পরিবেশ যাই হোক না কেন স্পিডমানি একটু বাড়িয়ে দিলেই লাইসেন্স পাওয়া যায় গাজীপুর কার্যালয় থেকে। পরিদর্শকরাও পরিদর্শনের সময় কারখানার পরিবেশের চেয়ে উপরি পাওনাতেই বেশি নজর দেন। যে কারণে কারখানাগুলোর পরিদর্শন গৌণ হয়ে যায়। আবার আরেকটি অভিযোগ আছে- সব কারখানায় পরিদর্শকদের যাবার অনুমতি নেই। কারণ ওই অফিসের প্রধান নিজেই সে কারখানাগুলোর সাথে যোগাযোগ রাখেন, সোজা কথায় লেনদেন করেন, ফলে অনেক কারখানার সাথেই কেবল লেনদেন হয়, পরিদর্শন আর হয় না। টঙ্গীর ট্যাম্পাকো নামের পয়েল কারখানাটি আসলে কোন ক্যাটাগরীতে পড়েছে তা ওই সব কর্মকর্তাই বলতে পারবেন।

তবে, সরকার নতুন পরিদর্শক নিয়োগ করলেও তাদেরকে আসলে যথাযথভাবে কাজে লাগানো যাচ্ছে না, কারণ পূর্বে নিম্নপর্যায়ের বিভিন্ন পদে চাকরিপ্রাপ্তরা পদোন্নতি পেয়ে কর্মকর্তার দায়িত্ব পেয়েছেন, যাদের কারো কারো শিক্ষাগত যোগ্যতাও অত্যন্ত কম। অথচ ৩৩ তম বিসিএস ননক্যাডার হতে নিয়োগপ্রাপ্ত প্রথম ও ২য় শ্রেণীর পরিদর্শকদের কে কাজ করতে হচ্ছে পদোন্নতিপ্রাপ্তদের অধীনে। পুরনোদের কেউ কেউ রানা প্লাজা ধসের মামলায় সিআইডির চার্জশিটে অভিযুক্ত আছেন এবং জামিনে মুক্ত আছেন, কিন্তু সংশিষ্ট মন্ত্রণালয় তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা না নেয়ায় গাজীপুরে আজ এমন একটি অগ্নিকান্ডে এতজন শ্রমিককে প্রাণ দিতে হলো।

maskawatকারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তরের গাজীপুর কার্যালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত যে উপমহাপরিদর্শক, তিনি বুয়েটের শিক্ষার্থী থাকাকালীন ছাত্রদলের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। পরবর্তীতে বিএনপির পৃষ্ঠপোষকতায় চাকুরী পাওয়া এই কর্মকর্তা কয়েকমাস আগে মোটা অংকের টাকা মন্ত্রীকে দিয়ে গাজীপুর কার্যালয়ে আসেন বলে অভিযোগ আছে। এসেই তিনি বিভিন্ন কারখানায় মাসিক/ত্রৈমাসিক/ষান্মাসিক/বার্ষিক চাঁদা নির্ধারণ করে দেন বলে অভিযোগ রয়েছে। লাইসেন্স প্রদান এবং নবায়নে মোটা অংকের টাকা নেন, তার কাছে টাকাটাই মূখ্য, কারখানার নিরাপত্তা নয় ইত্যাদি অভিযোগও রয়েছে। তাদের এ ধরণের আচরণের জন্য আজও যে ২৪ জন মানুষ পুড়ে গেল- এ দায়ভার এড়িয়ে যাওয়া অসম্ভব। ব্যবস্থাপনায় এরকম নরঘাতী দুষ্টচক্র জিইয়ে রেখে এ মৃত্যুর মিছিল কিছুতেই থামানো যাবে না।

লেখক- সাংবাদিক, শিক্ষক।

ঢাকা জার্নাল, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৬।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.