বাংলা চলচ্চিত্রের উজ্বল নক্ষত্র জহির রায়হান

আগস্ট ১৯, ২০১৬

Jahir Raihanঢাকা জার্নাল : বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতে জীবনস্পর্শী এবং কিংবদন্তী একজন নির্মাতা জহির রায়হান। বাংলা চলচ্চিত্রের উজ্বল এক নক্ষত্র। প্রতিবাদী ও সাহসী ধারায় তিনি অনন্য এক বিশিষ্ট শিল্পী। চলচ্চিত্র প্রতিভার পরবর্তী আশ্রয়স্থল হলেও তার আবির্ভাব ঘটেছিল কথাসাহিত্যে। সাংবাদিক, কথাসাহিত্যিক, রাজনৈতিক কর্মী, চিত্রপরিচালক- নানা পরিচয়ে তার কর্মক্ষেত্রের পরিধি স্পষ্ট ছিল। বাহান্নর ভাষা আন্দোলন ও একাত্তরের মুক্তিসংগ্রামে অংশগ্রহণের দ্বারা এদেশে সৎ শিল্পীর ভূমিকা কী রকম হবে, জহির রায়হান তার প্রকৃত উদাহরণ হয়ে আছেন।

১৯৩৫ সালের ১৯ আগষ্ট তৎকালীন নোয়াখালি জেলার ফেনীর অর্ন্তগত মজুপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। আজ (১৯ আগস্ট) তার ৮১তম জন্মদিন। স্কুল জীবনের অধিকাংশ সময় কেটেছে কলকাতায়। ১৯৫৩ সালে ঢাকা কলেজ থেকে আইএসসি পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হলেও পরের বছর অর্থনীতি ছেড়ে বাংলায় ভর্তি হন এবং ১৯৫৮ সালে বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। যদিও তাঁর পুঁথিগত বিদ্যার চেয়ে চলচ্চিত্রের প্রতি বেশি ঝোঁক ছিলো।

ভাষা আন্দোলন তার ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল, যার ছাপ দেখতে পাওয়া যায় তার ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিতে। তিনি ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি কলকাতায় চলে যান এবং সেখানে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে প্রচারাভিযান ও তথ্যচিত্র নির্মাণ শুরু করেন। কলকাতায় তার নির্মিত চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেয়া’র বেশ কয়েকটি প্রদর্শনী হয় এবং চলচ্চিত্রটি দেখে সত্যজিত রায়, মৃণাল সেন এবং ঋত্বিক ঘটকসহ প্রমুখ পরিচালক ভূয়সী প্রশংসা করেন।

এদিকে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে ‘লেট দেয়ার বি লাইট’ নামে একটি ইংরেজি চলচ্চিত্রের নির্মাণও শুরু করেছিলেন জহির রায়হান। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ায় এটি আর শেষ করতে পারেননি। একজন নির্মাতা হিসেবে ক্যামেরা হাতেই ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। কলকাতায় গিয়ে শুরু করেন ‘স্টপ জেনোসাইড’-এর শুটিং। এ চলচ্চিত্র সারা বিশ্বকে স্তম্ভিত করেছিল। ছবিটি মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্বরতা ও ভারতে বাংলাদেশি শরণার্থীদের মানবিক বিপর্যয়ের চিত্র তুলে ধরেছিল।নিঁপুন দক্ষতার সহিত চলচিত্র নির্মাণ শিল্পেও তিনি খুব অল্পসময়ে নিজেকে বিকশিত করেন। তার নির্মিত মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক প্রামান্য চিত্রগুলো যুদ্ধকালীন সময়ে বিশ্বমানবতার টনক নাড়িয়ে দেয়।

ভাষা আন্দোলনের পটভুমিতে জহির রায়হানের লেখা ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ ও ‘আরেক ফাল্গুন’ নামক উপন্যাস দুটি তার অনবদ্য রচনা। এছাড়াও উল্লেখযোগ্য গ্রন্থাবলীর মধ্যে রয়েছে: সূর্যগ্রহণ, শেষ বিলেকের মেয়ে, হাজার বছর ধরে, আর কতদিন, কয়েকটি মৃত্যু, বরফ গলা নদী, তৃষ্ণা প্রভৃতি।

জহির রায়হানের নির্মিত চলচিত্রগুলো হলো: কখনো আসেনি (১৯৬১), সোনার কাজল (১৯৬২), কাঁচের দেয়াল(১৯৬৩), সংগ্রাম (১৯৬৪ ততকালীন পাকিস্তানের সর্বপ্রথম রঙিন চলচিত্র), বাহানা (১৯৬৫), বেহুলা (১৯৬৬), আনোয়ারা (১৯৬৬), দুইভাই (১৯৬৮), জীবন থেকে নেয়া (১৯৬৯) ও ইংরেজী ভাষায় খবঃ ঞযবৎব ইব খরমযঃ। চলচ্চিত্র পরিচালনার পাশাপাশি জহির রায়হান অনেকগুলো ছবি প্রযোজনা করেন। সেগুলো হলো, ‘জুলেখা (১৯৬৭)’, ‘দুই ভাই’ (১৯৬৮)’, ‘সংসার’ (১৯৬৮), ‘সুয়োরাণী-দুয়োরাণী’ (১৯৬৮), ‘কুচবরণ কন্যা’ (১৯৬৮), ‘মনের মত বউ’ (১৯৬৯), ‘শেষ পর্যন-’ (১৯৬৯) এবং ‘প্রতিশোধ’ (১৯৭২)।

১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর তিনি তার পরিবারের সাথে কলকাতা হতে বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) স্থানান্তরিত হন। তিনি ব্যক্তিগত জীবনে দু’বার বিয়ে করেন। ১৯৬১ সালে সুমিতা দেবীকে এবং ১৯৬৬ সালে তিনি সুচন্দাকে বিয়ে করেন, দুজনেই ছিলেন সে সময়কার বিখ্যাত চলচ্চিত্র অভিনেত্রী। সুমিতা দেবীর দু’সন্তান বিপুল রায়হান ও অনল রায়হান। সুচন্দার পরিবারেও তার দু সন্তান–অপু রায়হান ও তপু রায়হান। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর ঢাকায় আসেন জহির রায়হান। তার নিখোঁজ ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারকে খুঁজতে ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি মিরপুরে যান। কিন্তু সেখান থেকে তিনি আর ফিরে আসেননি।

পাঁচ ভাই ও তিন বোনের পরিবারের একজন জহির রায়হান। ১৯৫০ সালে তিনি যুগের আলো পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে কাজ করা শুরু করেন। পরবর্তীতে তিনি প্রবাহ (সম্পাদক), এক্সপ্রেস (কার্যকরী সম্পাদক), খাপছাড়া, যাত্রিক (সহকারী সম্পাদক), সিনেমা, সমকাল, চিত্রালী, সচিত্র সন্ধানী ইত্যাদি পত্রিকাতেও কাজ করেন। ১৯৫৬ সালে তিনি সম্পাদক হিসেবে ‘প্রবাহ’ পত্রিকায় যোগ দেন।

জহির রায়হানের ‘হাজার বছর ধরে’ উপন্যাস ১৯৬৪ সালে ‘আদমজী পুরস্কার’ লাভ করে। ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে বাংলা উপন্যাসের ক্ষেত্রে বিশিষ্ট অবদানের জন্য তাকে বাংলা একাডেমী পুরস্কারে (মরণোত্তর) ভূষিত করা হয়। তৎকালীন পাকিস্তানে ১৯৬৫ সালে জহির রায়হান পরিচালিত ‘কাঁচের দেয়াল’ ছবিটি ‘নিগার পুরস্কার’ লাভ করে। এই ছবিটি ৭টি শাখায় পুরষ্কার জিতে নেয়। এছাড়া তিনি শ্রেষ্ঠ পরিচালকের সম্মান লাভ করেন। ১৯৭২ সালে তাসখন্দ চলচ্চিত্র উৎসবে তার ‘জীবন থেকে নেয়া’ এবং ‘স্টপ জেনোসাইড’ ছবি দুটিকে বিশেষ পুরস্কার দেওয়া হয়।

জহির রায়হান স্মরণে চলচ্চিত্র উৎসব

কাল সারা দিন জুড়ে চলবে জহির রায়হান চলচ্চিত্র উৎসব। কেন্দ্রীয় গণগ্রন্থাগারের শওকত ওসমান স্মৃতি মিলনায়তনে উৎসব শুরু হবে সকাল ১০টায়। জহির রায়হানের ৮১তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে উৎসবের আয়োজন করেছে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর ঢাকা মহানগর সংসদ।

উৎসবে দেখানো হবে জহির রায়হান নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র ‘স্টপ জেনোসাইড’, ভারতীয় নির্মাতা সৌমিত্র দস্তিদার নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র ‘এ লেটার টু মাই ডটার’, তারেক মাসুদ নির্মিত চলচ্চিত্র ‘রানওয়ে’, সেন্টু রায় নির্মিত জহির রায়হানের জীবনীভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘জহির রায়হান’, কামার আহমাদ সাইমন নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র ‘শুনতে কি পাও?’ ও প্রদীপ ঘোষ নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র ‘ক্ষতচিহ্ন’।

উৎসব উদ্বোধন করবেন চলচ্চিত্র নির্মাতা মানজারেহাসীন মুরাদ। দিনব্যাপী এ উৎসবে অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি কামাল লোহানী, সহসভাপতি শংকর সাওজাল, জহির রায়হানের ছেলে অনল রায়হান, জহির রায়হানের বড় ভাই শহীদুল্লা কায়সারের কন্যা অভিনেত্রী শমী কায়সার ও ভারতীয় প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা সৌমিত্র দস্তিদার। রাত ৮টা পর্যন্ত চলবে এ উৎসব।

ঢাকা জার্নাল, আগস্ট ১৯, ২০১৬।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.