প্রস্তাবিত বন আইন: প্রয়োজন কয়েকটি ধারা সংশোধন

এপ্রিল ৬, ২০১৩

তকতকঢাকা জার্নাল: মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, বিভিন্ন অঞ্চলে বিশেষ করে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নদীর পানির লবণাক্ততা বৃদ্ধি, হিমালয়ের বরফ গলার কারণে নদীর দিক বদলে যাচ্ছে। বন্যা, ঝড়, জলোচ্ছ্বাসসহ স্থায়ী জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে।

দেশে প্রায়শ: এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের আঘাতে প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্যের পাশাপাশি জনজীবনও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে এইসব মানদন্ডে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকার শীর্ষেই অবস্থান করছে। কিন্তু জাতীয় সংসদে উত্থাপিত বন আইন (সংশোধন) বিলে তার প্রতিফলন ঘটেনি। বরং কয়েকটি ধারায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইন ও চুক্তির লংঘন হয়েছে।

জাতীয় সংসদে উত্থাপিত বিলটি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এই বিলে বিগত আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে সম্পাদিত পার্বত্য শান্তিচুক্তিকে আমলে নেওয়া হয়নি। বিলের ৬ ধারায় সংরক্ষিত বন ঘোষণার প্রক্রিয়ায় অধিকার প্রতিষ্ঠার সুযোগ রহিত করা হয়েছে।

এতে মানুষের ভূমির অধিকার বিলুপ্তি ঘোষণার প্রক্রিয়ায় আপত্তি দাখিলের সুযোগ বন্ধ হবে। ফলে আদিবাসী, বনবাসী ও বননির্ভর জনগোষ্ঠি তাদের প্রথাগত ও প্রচলিত ভূমির অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে। একই সঙ্গে তারা তাদের জুম চাষ, আবাস ভূমি, গ্রাম, বন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শ্মশান ও পবিত্র ভূমি হারাবে।

একইভাবে বিলের ১০ধারা অনুযায়ী, রক্ষিত বনে বিশেষ বৃক্ষের শ্রেনী সংরক্ষণের বিধান কার্যকর হলে উল্লিখিত জনগোষ্ঠি তাদের প্রথাগত অধিকার হারাবে। পার্বত্য শান্তি চুক্তিতে এসকল প্রথাগত অধিকার রক্ষার অঙ্গীকার করা হয়েছে।

আইনের ৩(গ), ১২ ও ১৩ ধারায় ‘আদার ফরেষ্ট’ নামে নতুন বন ঘোষণার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এতে ঘোষিত বনাঞ্চলে বসবাসকারী জনগোষ্ঠির ভূমির অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশংকা রয়েছে। আর ১৪ ধারায় উল্লিখিত বেসরকারী বন পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার বিধান কার্যকর হলে তা বন সংরক্ষণের উপর নেতিবাচক প্রস্তাব ফেলবে।

সংশ্লিষ্টদের মতো, পুরনো আইন সংস্কারের কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি প্রস্তাবিত আইনে কোন গুরুত্ব পাইনি। শুধুমাত্র আইন সংশোধনের উদ্দেশ্যে “ভূ-মন্ডলের তাপ বৃদ্ধি মরুকরণ” এই কয়টি শব্দ যোগ করা হয়েছে। অথচ জলবায়ুর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষায় বনাঞ্চল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এমনকি দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত সুন্দরবন বুক পেতে দিয়ে মাত্র কয়েক বছর আগে আঘাত হানা প্রলংকারী ঘূর্ণিঝড় সিডর এবং আইলার কবল থেকে রক্ষা করেছে দক্ষিণাঞ্চলের জনপদকে। সংশোধনী বিল সেই বিষয়টি আমলে নেওয়া হয়নি।

এ বিষয়ে ফরেষ্ট পলিসি অ্যাডভোকেসী ফোরামের সংশোধনী প্রস্তাবে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবেলায় বনাঞ্চল অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে। তাই বন বিভাগের সকল উন্নয়ন কাজে জলবায়ু পরিবর্তনের ইস্যুটি গুরুত্ব দেওয়ার বিধান রাখতে হবে। বন রক্ষার পাশাপাশি বাস্তব সম্মতভাবে নতুন বনাঞ্চল সৃষ্টির উদ্যোগ নিতে হবে। সেক্ষেত্রে আইনে উপকূলীয় এলাকায় গ্রীণ বেল্ট তৈরিসহ চল এলাকা ও পার্বত্য অঞ্চলে সরকারী ভূমিতে বনায়নকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।

আর বন ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা প্রণয়নকালে বনসংলগ্ন প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদে স্থানীয় মানুষের সঙ্গে ফোকাস গ্রুপ আলোচনার বিধান যুক্ত করতে হবে। এছাড়া বননির্ভর জনগোষ্ঠির ঐতিহ্যগত অধিকার রক্ষার বিষয়টি আইনে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।
এদিকে প্রস্তাবিত বন আইন বাতিল করে নতুন আইন প্রণয়নের দাবি জানিয়েছেন পার্বত্য চট্টগ্রাম বন ও ভূমি অধিকার সংরক্ষণ আন্দোলন।

তাদের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, খসড়া আইনটি বাংলাদেশের সংবিধানের ১৮ (ক), ২৩ (ক), ২৭ ও ২৮সহ বেশ কয়েকটি অনুচ্ছেদ, পার্বত্য শান্তি চুক্তি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক একাধিক আইন, জীববৈচিত্র্য চুক্তি ও আইএলও কনভেনশনসহ একাধিক রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক চুক্তির পরিপন্থি। তাই এই আইন বাতিল করে নতুন আইন প্রণয়ন করাই ভালো। আরো বলা হয়েছে, প্রস্তাবিত আইনে আদিবাসী ও অন্যান্য বননির্ভর জনগোষ্ঠির জীবিকা, কৃষ্টি ও অধিকার সংক্রান্ত উদ্দেশ্য পুরণ হবে না। তাই বন আইনে পরিবেশ ও প্রতিবেশ রক্ষা এবং প্রাণ বৈচিত্র্য সংরক্ষণের বিষয়টি নিশ্চিত করার পদক্ষেপ নিতে হবে।

উল্লেখ্য, ১৯২৭ সালের বন আইনকে সংশোধন করে ‘ফরেষ্ট (অ্যামেন্ডমেন্ট) এ্যাক্ট-২০১২’ নামে একটি বিল গত বছর ২৯ ফেব্রুয়ারী জাতীয় সংসদে উত্থাপন করা হয়। বিলটি অধিকতর পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও যুগোপযোগী করতে সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট সোহরাব আলী সানাকে আহ্বায়ক করে একটি সাব-কমিটি গঠন করেছে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি। এই সাব-কমিটির কাছে ইতোমধ্যে বিলটি নিয়ে নানা আপত্তি ও পরামর্শ জমা পড়েছে। বিলটি চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে তা বিবেচনায় নেওয়া হবে বলে সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন।

এবিষয়ে সংসদীয় সাব-কমিটির আহ্বায়ক সোহরাব আলী সানা বলেন, প্রস্তাবিত আইনে যাই থাকুক না কেন, বন আইনকে যুগোপযোগী ও গ্রহণযোগ্য করতে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা হবে। এক্ষেত্রে জনগণের মতামতকে প্রধান্য দেওয়া হবে। সংসদে আগামী অধিবেশনে বিলটি পাস হতে পারে বলে তিনি জানিয়েছেন।

অভ্যন্তরীণ জলবায়ু পরিবর্তন কমিটি (আইপিসিসি, ১৯৯০) এর দেওয়া তথ্যে বলা হয়েছে, সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা যদি ৪৫ সেন্টিমিটার বাড়ে তাহলে সুন্দরবনের গাছপালাসহ ৭৫ শতাংশ ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ মাটির লবনাক্ততা বৃদ্ধির জন্য ধ্বংস হয়ে যাবে। ইতোমধ্যে লাওয়াছড়া দ্বীপ, নিউমুরী দ্বীপ, দক্ষিণ তালপট্রি দ্বীপ সাগর গর্ভে বিলীন হয়েছে। ভোলার চর কুকরী, চর জহির, ঘোরামারা দ্বীপ আংশিক নিমজ্জিত।

বৈশ্বিক উষ্ণায়ন কখনও কখনও নিরক্ষীয় ঝড় ও সাইক্লোনকে প্ররোচিত করে। সাইক্লোন সিডর ও আইলা ৮ থেকে ১০ শতাংশ বন সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিয়েছে এবং সেগুলো আর জন্মাবে না, আর ১৫ শতাংশ বন আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে যার একাংশ পুনরায় জন্মাবে। এই অবস্থায় বনাঞ্চল রক্ষায় যুগোপযোগী আইন প্রণয়ন জরুরী।

ঢাকা জার্নাল, মার্চ ৫, ২০১৩। 

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.