রামপালের কালো ধোঁয়া || মুহম্মদ জাফর ইকবাল

আগস্ট ১২, ২০১৬

zafor iqbalকয়লা নিয়ে আমার স্মৃতি ভাল নয়। শৈশবে আমাদের দেশে গ্যাস ছিল না, রান্নাবান্না হতো কেরোসিনের চুলায় কিংবা কাঠের লাকড়ি দিয়ে এবং কোথাও কোথাও কয়লা দিয়ে। বাজারে দুই রকম কয়লা পাওয়া যেত একটা পাথুরে কয়লা অন্যটা কাঠ কয়লা। কাঠ কয়লা দিয়ে সহজেই আগুন ধরানো যেত কিন্তু পাথুরে কয়লা জ্বালাতে সবার জান বের হয়ে যেত। রেস্টুরেন্টগুলোতে পাথুরে কয়লা জ্বালাতে গিয়ে কর্মচারীরা গলদঘর্ম হয়ে যাচ্ছে এবং গল গল করে কুচকুচে কালো ধোঁয়া বের হয়ে আকাশ কালো করে ফেলছে এরকম একটা দৃশ্য মনের মাঝে গেঁথে আছে। যেদিন থেকে খবর পেয়েছি রামপালে কয়লা ব্যবহার করে একটা বিদ্যুত কেন্দ্র তৈরি হবে সেদিন থেকে শৈশবের সেই স্মৃতিটা ফিরে এসেছে এবং চোখ বন্ধ করলেই চোখের সামনে বড় বড় চিমনি এবং সেখান থেকে কুচকুচে কালো ধোঁয়া বের হচ্ছে এরকম একটা দৃশ্য দেখতে পাই। শুধু যে কল্পনায় দেখতে পাই তা নয় ঢাকা-সিলেট যাতায়াত করার সময় রাস্তার পাশে অসংখ্য ইটের ভাঁটিতে সত্যি সত্যি কুচকুচে কালো ধোঁয়া গলগল করে বের হচ্ছে সেই দৃশ্য দেখতে হয়। পৃথিবীতে ইটের ভাঁটি থেকে অসুন্দর কোন দৃশ্য হতে পারে বলে আমার জানা নেই। বর্ষাকাল আমার সবচেয়ে প্রিয় ঋতু এবং তার অনেক কারণের সঙ্গে নতুন এই কারণটি যোগ হয়েছে যে, এই সময়ে ইটের ভাঁটিগুলো বন্ধ থাকে, চিমনি দিয়ে কুচকুচে কালো ধোঁয়া বের হতে পারে না। ইটের ভাঁটিতে ইট তৈরি হয় সেই ইট দিয়ে দেশের দালানকোঠা তৈরি হয় তাই ইটের ভাঁটির ওপর আমার যত আক্রোশই থাকুক তার বিরুদ্ধে বিষোদগার করে কখনও কিছু লিখিনি (আমার কিশোর উপন্যাসে ইটের ভাঁটির মালিকদের ভিলেন হিসেবে দেখিয়েই আমার ক্ষোভটুকু মেটাতে হয়েছে)।

দেশের জন্য ইলেকট্রিসিটি দরকার; কাজেই দেশে কয়লা দিয়ে বিদ্যুত কেন্দ্র তৈরি করতে হবে তাই চিমনি দিয়ে কুচকুচে কালো ধোঁয়া বের হলেও সেটা মেনে নিতে হবে এরকম একটা যুক্তি দেখানো যায়। কিশোর উপন্যাসে বিদ্যুত কেন্দ্রের মালিকদের ভিলেন এবং যে সব আমলা এর চুক্তি তৈরি করে দিয়েছেন তাদের সুপার ভিলেন হিসেবে দেখিয়ে আমার ক্ষোভটুকু প্রকাশ করার জন্যও কেউ কেউ আমাকে বুদ্ধি দিতে পারেন।

সমস্যা অন্য জায়গায় আমি যখন কল্পনায় রামপাল বিদ্যুত কেন্দ্রটি দেখার চেষ্টা করি তখনই শুধু যে কয়েকটি উঁচু চিমনি দিয়ে গলগল করে কালো ধোঁয়া বের হতে দেখি তা নয়, আমি কল্পনায় দেখতে পাই সেই চিমনি আমার অতিপ্রিয় সুন্দরবনের ঘন সবুজ বনের সারি সারি গাছকে আড়াল করে রেখেছে। দৃশ্যটি আমি কোনমতে মানতে পারি না। সুন্দরবনের ভেতর থেকে উপরের দিকে তাকালে আমি দেখব উঁচু চিমনি থেকে গলগল করে কালো ধোঁয়া বের হচ্ছে আমি সেই দৃশ্য চোখের সামনে থেকে সরাতে পারি না!

আমি জানি অভিজ্ঞ ও বিশেষজ্ঞরা রীতিমতো হা হা করে আমার কাছে ছুটে এসে আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করবেন যে, অত্যন্ত আধুনিক প্রযুক্তির এই বিদ্যুত কেন্দ্র থেকে মোটেই গলগল করে কালো ধোঁয়া বের হবে না। স্টকিয়োমেট্রিক এয়ার ফুয়েল, স্বল্পমাত্রার কম্বাশন, ফ্লু গ্যাস ডিসালফারাইজেশন ওয়েট লাইমস্টোন ট্রিটমেন্ট, কুলিং ওয়াটার রিসারকুলেশন, পি এইচ সেভেন এই ধরনের কঠিন কঠিন শব্দ ব্যবহার করে আমাদের বোঝানোর চেষ্টা করবেন সুন্দরবন থেকে দশ কিলোমিটারেরও কম দূরত্বে থেকেও এটা সুন্দরবনের বিন্দুমাত্র ক্ষতি করবে না।

এই গালভরা শব্দচয়ন এবং বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড তাদের ওয়েবসাইটে পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়নের রিপোর্ট জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে রেখেছে এই তথ্য জানার পরও দেশের কোন মানুষের রামপাল বিদ্যুত কেন্দ্রের জন্য বিন্দুমাত্র ভালবাসা জন্ম নেয়নি। তার প্রধান কারণ, ভারত তাদের নিজের দেশে এরকম কয়লানির্ভর বিদ্যুত কেন্দ্র তৈরি করার অনুমতি দেয়নি। সেই ভারত বাংলাদেশে সুন্দরবনের এত কাছে এরকম একটি বিদ্যুত কেন্দ্র তৈরি করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে সেটি কার কাছে মহা উদ্যোগ বলে মনে হবে? কোম্পানিটির নামে ‘বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ’ কথাটি থাকলেও খুবই সঙ্গত কারণে এই বিদ্যুত কেন্দ্রের বিষয়ে এ দেশের মানুষ এখানে কোন ফ্রেন্ডশিপ খুঁজে পাচ্ছে না বরং এটাকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভারতের ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখতে শুরু করেছে। সাধারণ মানুষকে দোষ দেওয়া যায় না। একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান তাদের রিপোর্টে লিখেছে, ‘ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিক্স অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল এনালিস্ট সন্দেহ করছে এই প্রজেক্টটিকে দাঁড় করানো হয়েছে বাংলাদেশে ভারতের কয়লা বিক্রি করার জন্য…’ ইত্যাদি ইত্যাদি।

আমি জ্বালানি বিশেষজ্ঞ নই, অর্থনীতির মানুষ নই, পরিবেশ সম্পর্কে আমার জ্ঞান কমনসেন্সের একটু বেশি। কাজেই রামপালের এই বিদ্যুত কেন্দ্র নিয়ে আমার মতামতের কোন বিশেষজ্ঞ মূল্য নেই, আমি নিজেও সেটা খুব ভাল করে জানি। কিন্তু রামপালের বিদ্যুত কেন্দ্র নিয়ে সাধারণ মানুষ কী ভাবছে আমার মনে হয় সরকারের সেটা জানার দরকার আছে।

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের মতো সমমনা বেশ কয়েকজন শিক্ষক অনেক বছর থেকে সপ্তাহের একটি দিন বসে কোন একটা বিষয় নিয়ে আলোচনা করি। এই সপ্তাহে আমাদের আলোচনার বিষয় ছিল ‘বিদ্যুত নাকি সুন্দরবন? নাকি দুটোই?’ নানা বিষয়ের নানা বয়সের অনেক শিক্ষকের মাঝে আমি একজন শিক্ষককেও খুঁজে পাইনি যিনি রামপালের এই বিদ্যুত কেন্দ্রটিকে মেনে নিতে রাজি আছেন। এই শিক্ষকরা আবেগনির্ভর যুক্তিহীন মানুষ নয়। দেশের জন্য তাদের ভালবাসা আছে, সরকারের জন্য মমতা আছে; তারপরও তাদের কারও কাছে রামপাল বিদ্যুত কেন্দ্র একটি গহণযোগ্য প্রজেক্ট নয়। পত্রপত্রিকায় অনেক লেখালেখি হয়েছে তার মাঝে কাউকে কিছু লিখতে দেখিনি। শুনেছি টেলিভিশনের টক শোতে সরকারের পক্ষের কিছু মানুষ এই বিদ্যুত কেন্দ্রের পক্ষে কথা বলে যাচ্ছেন কিন্তু কয়লানির্ভর বিদ্যুত কেন্দ্রের পক্ষে কাউকে নরম করতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। পৃথিবীর সামনে গর্ব করার মতো আমাদের খুব বেশি কিছু নেই, সুন্দরবন এর মাঝে ব্যতিক্রম। যারা সুন্দরবন দেখেছে তারা এটাকে নিজের সন্তানের মতো ভালবাসে, সেই সুন্দরবনের ক্ষতি হয়ে যাবে সেটি এই দেশের কেউ মেনে নেবে না। দেশের একেবারে সাধারণ মানুষও এত দিনে জেনে গেছে প্রস্তাবিত ১৩২০ মেগাওয়াটের অর্ধেকও পাওয়া সম্ভব নয়, প্রায় দ্বিগুণ দামে এই ইলেকট্রিসিটি কিনতে হবে, লাভের টাকা চলে যাবে ভারতে, পরিবেশ নষ্ট হবে বলে দুই দুটি ব্যাংক এই প্রজেক্ট থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছে। আমার মনে হয় এরপরও জোর করে রামপাল বিদ্যুত কেন্দ্র তৈরি করার চেষ্টা করলে সরকার তার অর্জনের অনেকটুকুই ম্লান করে ফেলবে।

আমি বারবার বলেছি আমি এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নই, কমনসেন্স দিয়ে বুঝতে পারি এই দেশের জন্য আমাদের ইলেকট্রিসিটি দরকার; শুধু ঘরের আলো জ্বালানোর জন্য কিংবা গরমে ফ্যানের বাতাস খাবার জন্য নয়, এই দেশটাকে এগিয়ে নেবার জন্য। আমার ধারণা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্রও এই দেশের মানুষ গ্রহণ করতে রাজি হয়ে যাবে যদি এটিকে আরও দশ থেকে পনেরো কিলোমিটার উত্তরে সরিয়ে নেওয়া হয়।

একটি দেশের জন্য সেটি কি এতই দুঃসাধ্য কাজ? আমাদের প্রিয় সুন্দরবনটাকে অক্ষত রেখে একটি বিদ্যুত কেন্দ্র তৈরি করা হবে সেই ঘোষণা দিলে দেশের সব মানুষের বুকের ভেতর থেকে চাপা নিঃশ্বাসটি বের হয়ে সবার মুখে যে হাসি ফুটে উঠবে সরকার সেটি কি একবারও দেখতে পায় না?

লেখক : অধ্যাপক, শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক

ঢাকা জার্নাল, আগস্ট ১২, ২০১৬।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.