বাংলাদেশেও কার্যক্রম গড়ে তুলছে আইএস!

আগস্ট ৫, ২০১৬

IS_Jewelনিউইয়র্ক টাইমসকে জেলবন্দি জঙ্গি সারফো 
ইসলামিক স্টেট বা আইসিস, আইএস বা দায়েস। যে নামেই ডাকুন, মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক এই আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠীটি একের পর এক নৃশংস লোমহর্ষক হামলার ঘটনা ঘটিয়ে গোটা দুনিয়ার পিলে চমকে দিয়েছে। ফ্রান্স, জার্মানি, বেলজিয়াম, সিরিয়া, ইরাক, তিউনিয়াসহ দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে দেশে এরা বইয়ে চলেছে রক্তগঙ্গা। এসব হামলার শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ। নিরাপরাধ নারী-পুরুষ-শিশুরা। আত্মপ্রকাশের পর বছর দু’এক না যেতেই আইএস নামের এই বর্বর ধর্মান্ধ গোষ্ঠী যেসব লক্ষ্য অর্জন করেছে সেটাও বিশ্ববাসীর জন্য বড় মাথাব্যথার কারণ।

সারা দুনিয়ার তরুণ যুবকদের মগজ ধোলাই করার কাজে এরা যে সফলতা দেখিয়েছে তা-ও রূপকথার গল্পের মতোই বিস্ময়কর। শুধু তরুণরাই নয়, বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফল–শিক্ষিত পেশাজীবীরাও বাদ যাচ্ছেন না। তারাও চাকরি-সংসারের মায়া ছেড়ে আইএসে যোগ দিতে ঘর ছাড়ছেন। কেউ কেউ আবার সহায়-সম্পদ সব ফেলে পুরো পরিবার নিয়ে আইএস-এ যোগ দিতে উড়াল দিচ্ছেন তুরস্ক হয়ে সিরিয়া-ইরাকের পথে।

তরুণদের মতো তরুণীরাও কম যায় না। এরাও নাম লেখাচ্ছে দলে দলে। এদের অনেকেই আবার স্রেফ জিহাদীদের শয্যাসঙ্গী হবার ব্রত নিয়ে নাম লিখিয়েছে আইএস-এ। এরা পৃথিবীর মায়া ভুলে, পরিবারের ভালোবাসা ভুলে হয়ে যাচ্ছে জঙ্গি ও খুনী ও আত্মঘাতী হামলাকারী। এরা সবাই উচ্চ শিক্ষিত, মেধাবী।

IS-Jewel-inner20160805023451নিউইয়র্ক টাইমস গত ৩ আগস্ট জার্মানির ব্রেমেন শহরের কারাগারে বন্দি হ্যারি সারফো (Harry Sarfo) নামের এক আইএস জঙ্গির সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে এক দীর্ঘ প্রতিবেদন ছেপেছে। প্রতিবেদনটি লিখেছেন রুক্ষ্মিনী কাল্লিমাচি(Rukmini Callimachi)। সেই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে লিখেছেন কনসালট্যান্ট এডিটর জুয়েল মাজহার।

সারফো তাঁর আইএসে যোগ দেওয়া থেকে শুরু করে আইএস-এর প্রশিক্ষণ শিবিরের ভেতরের অনেক তথ্য জানিয়েছে। জেলবন্দি কোনো আইএস জঙ্গির এটাই প্রথম ও বিস্তারিত সাক্ষাৎকার। জার্মানির একটি মসজিদে নিয়মিত যাওয়া আসার সুবাদে মগজধোলাই হয় সে। এরপর গত বছর হ্যারি সারফো সিরিয়া থেকে আইএস—এর ফোনকল পায়। সে তার এক জার্মান বন্ধুকে নিয়ে সিরিয়ায় আইএস শিবিরে পৌঁছে। তার অভিজ্ঞতা সংক্ষেপে এরকম:

সেখানে পৌঁছার পরপরই ইসলামিক স্টেটের গোয়েন্দা সার্ভিসের মুখোশধারী সদস্যরা তাকে জানায়, ইউরোপীয়দের সিরিয়া বা ইরাকে অপারেশন চালানোর দরকার নেই। তারা বরং প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজেদের দেশে ফিরে গিয়ে হামলার এজেন্ডা বাস্তবায়ন করুক। জার্মানি, ফ্রান্স ও ব্রিটেনে হামলার জন্য আরো লোক দরকার: ‘‘They want to have loads of attacks at the same time in England and Germany and France.”

সারফোর ভাষায়, আইএস-এর গোয়েন্দা শাখাটির নাম ইমনি (Emni)। নিজস্ব পুলিশ বাহিনি এবং এক্সটারনাল ব্রাঞ্চের সমন্বয়ে গড়া এই ‘ইমনি’র মূল কাজ হচ্ছে, মধ্যপ্রাচ্যের বাইরে বিভিন্ন দেশে সন্ত্রাস ছড়িয়ে দেওয়া। গত দুবছর ধরে এরা এরই মধ্যে দেশে-দেশে ভয়ঙ্কর নারকীয় হামলা চালিয়েছে। এসবের মধ্যে ফ্রান্সে চালানো কয়েকটি হামলা সবাইকে হতবাক ও অপ্রস্তুত করে দিয়েছে।

আইএস-এর সর্বোচ্চ কর্তাব্যক্তিটির নাম আবু মোহাম্মদ আল-আদানি (Abu Muhammad al-Adnani)। আদানির পরেই আছে লেফটেন্যান্ট পদধারী বেশ ক’জন ঊর্ধ্বতন ব্যক্তি। এরা বিভিন্ন মহাদেশের জঙ্গি কার্যক্রমের দেখভাল করে থাকে। একেকটি মহাদেশীয় শাখার নাম হয় এরকম: “secret service for European affairs,”, “secret service for Asian affairs” এবং  “secret service for Arab affairs,” ।
পশ্চিমা দুনিয়ায় এরা এ পর্যন্ত খুব বড় ধরনের ১০টি সফল হামলা চালিয়েছে। এর মধ্যে অস্ত্র ও বোমাসহ ধরাও পড়েছে অন্তত ৩০ জন।

সর্বোচ্চ গোপনীয়তা ও পেশাদারিত্ব
আইএস-এর কার্যক্রম পরিচালিত হয় অত্যন্ত পেশাদারি পন্থায়।সর্বোচ্চ গোপনীয়তাও বজায় রাখা হয়। আইএস সদস্যদের কাজ মূলত তিনটি স্তরে বিন্যস্ত। একদল রণাঙ্গণে যুদ্ধ করে। আরেক দল হচ্ছে এলিট স্পেশাল ফোর্স ইউনিট বা এলিট কমান্ডো  ইউনিট। আর অন্য দল চালায় আত্মঘাতী হামলা। জাতীয়তা ও ভাষা অনুযায়ী এদের বিভিন্ন দলে বিভক্ত করা হয়। কিন্তু এরাও আবার একে অন্যকে চেনে না বা পরিচিত হবার সুযোগ পায় না। নির্দিষ্ট অপারেশনের আগেই কেবল এরা একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ করে উপর মহলের দিক নির্দেশনা অনুযায়ী —‘‘…only meet one another on the eve of their departure abroad.’’

যে কোনো বড় অপারেশনের আগে এদেরকে রণাঙ্গণের বা অতীত হামলার বিভিন্ন  ভিডিও দেখানো হয়। আর পুরো ব্যাপারটাই ঘটে থাকে আবু আদানির দূর নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধানে।

বাংলাদেশও বাদ নেই এদের কার্যক্রম থেকে
সারফোর মতে, বাংলাদেশের ওপরও পড়েছে আইএস-এর শ্যেন দৃষ্টি। হ্যারি সারফোর জবানি ও ইউরোপীয় গোয়েন্দাদের অনুসন্ধান থেকে আরো জানা যায়, এরই মধ্যে আইসিস বা আইএস বাংলাদেশ, অস্ট্রিয়া, জার্মানি, ফ্রান্স, স্পেন, লেবানন, তিউনিসিয়া, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় হামলা করার জন্য তাদের শতশত আত্মঘাতী হামলাকারী পাঠিয়েছে। সারফোর ভাষায় এরা হচ্ছে আইসিসের পদাতিক সেনা (‘foot soldiers’)। এরই মধ্যে হাজার হাজার আইএস জঙ্গি বিভিন্ন দেশে হামলার জন্য ছড়িয়ে পড়েছে। নাম প্রকাশ না করা শর্তে এক ঊর্ধ্বতন মার্কিন গোয়েন্দা কর্মকর্তাও নিউইয়র্ক টাইমস –এর কাছে সারফোবর্ণিত তথ্যের সত্যতা সমর্থন করেছেন।

সারফোকে নির্জন হাজতখানা থেকে এখন সাধারণ কারাকক্ষে স্থানান্তর করা হয়েছে। হ্যারি সারফোর বর্ণনামতে, বাংলাদেশে জঙ্গি অবকাঠামো গড়ে তোলার জন্য আইসিস কাজ করে চলেছে—He described what he had been told about the group’s work to build an infrastructure in Bangladesh.’
এ প্রসঙ্গে নিউইয়র্ক টাইমস গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলার বিষয়টির উল্লেখ করে বলেছে : ‘‘ There, a siege by a team of Islamic State gunmen left at least 20 hostages dead at a cafe last month, almost all of them foreigners.’’। যদিও বাংলাদেশ বলছে এটা স্রেফ দেশীয় জঙ্গিদের কুকর্ম।

সিরিয়ার গহীন মরুভূমিতে প্রশিক্ষণ শিবির

সিরিয়ায় তুরস্ক-সীমান্ত ঘেঁষে গড়ে উঠেছে আইএস জঙ্গিদের অসংখ্য ডরমিটরি। নতুন আসা সদস্যদের এসব ডরমিটরি থেকে চোখ বেঁধে গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় মরুভূমির গভীরে। সেখানে মাটির নিচে অসংখ্য গুহা বা গর্তে এদের থাকতে দেওয়া হয়। গুহাগুলির ভেতরটা ডালপালা ও লতাপাতা দিয়ে ছাওয়া। প্রতিদিন সেখানে ঘন্টার পর ঘন্টা প্রচণ্ড গরমে চলে জঙ্গি প্রশিক্ষণ। টানা ছয়মাস প্রশিক্ষণ শেষে সবাইকে অপারেশনের জন্য মনোনীত করা হয়।

রিক্রুট করার সময় যা করা হয়
সিরিয়ার ডরমিটরিগুলোতে পৌঁছার পর জঙ্গি হতে ইচ্ছুকদের বেশ কিছু রুটিন কার্যক্রমের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। তাদেরকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ল্যাপটপ সামনে নিয়ে আইএস-এর একজন আইটি বিশেষজ্ঞ নতুনদের বিভিন্ন প্রশ্ন করে সেসব প্রশ্নের উত্তর ল্যাপটপে লিখে সংরক্ষণ করে। সারফো সেসব জিজ্ঞাসাবাদের নমুনা দিয়েছে সাক্ষাৎকারে। যেমন,– ‘What’s your name? What’s your second name? Who’s your mom? Where’s your mom originally from? What did you study? What degree do you have? What’s your ambition? What do you want to become?’’
এছাড়া নতুনদের আঙ্গুলের ছাপ নেওয়া হয়। এরপর একজন চিকিৎসক এসে সবার রক্তের নমুনা সংগ্রহ করে। এরপর নেওয়া হয় বিভিন্ন শারীরিক পরীক্ষাসহ ফিটনেসের পরীক্ষা।

হ্যারি সারফো যেভাবে জঙ্গি
হ্যারি সারফো নামের কৃষ্ণাঙ্গ এই জার্মান আইএস-এ যোগ দেবার আগে তার নিজে শহর ব্রেমেনের একটি মসজিদে নিয়মিত যাতায়াত করতো। উগ্রবাদ ছড়ানোর কারখানা হিসেবে এই মসজিদটিকে চিহ্নিত করেছে জার্মান গোয়েন্দারা। এভাবেই সে একদিন হয়ে ওঠে জঙ্গি। এই মসজিদ কর্তৃপক্ষ হ্যারি সারফোর মতো অন্তত ২০ জার্মান তরুণকে আইসিসের সদস্য করে সিরিয়া পাঠায়। এদের মধ্যে কমপক্ষে চারজন অপারেশনকালে মারা পড়ে।

সারফো আরো জানায়, আইসিস তাদেরকেই সদস্য করতে বেশি আগ্রহী যাদের অতীত ক্রিমিনাল রেকর্ড রয়েছে। তারও ছিল। একটি সুপার মার্কেট থেকে ২৩ হাজার ইউরো চুরি করে ধরা পড়ে যায় সে। এক বছর সাজাও খাটে।সারফোর ভাষায়, আইএস সবচে বেশি জঙ্গি পাঠিয়েছে ফ্রান্সে। সেখানে এখন দরকারের চেয়ে বেশি লোক আছে তাদের। আইএস এখন চায় সারা পৃথিবীতে তাদের জঙ্গি কার্যক্রম ছড়িয়ে দিতে।

দেখা যাক, আইএসকে পৃথিবী কিভাবে সামাল দেয়।

বাংলাদেশ সময় ০১৩৭ ঘণ্টা, আগস্ট ০৫, ২০১৬

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.