ডিফেমেশানের ভাইরাস।।মাসকাওয়াথ আহসান

জুলাই ২৭, ২০১৬

maskawthপ্রয়াত বাংলাদেশী বংশোদ্ভুত যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক অভিজিত রায়ের হত্যাকান্ডটির তদন্ত হয়েছে। দেশীয় তদন্ত কতৃপক্ষের পাশাপাশি মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা ঘটনাটির তদন্ত করেছে। এই মুহূর্তে অনুমানের ওপর ভিত্তি করে অনলাইনে দোষারোপকরণের অযৌক্তিক প্রবণতা বন্ধ রেখে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে কাজ করতে দেয়া জরুরী। তারা এ বিষয়ে কাজ করছে; ক্রমশঃ সন্ত্রাসবাদের মাকড়সা সুড়ঙ্গটি ধরে এগুতে সফল হয়েছে তারা।

হত্যাকান্ডের তদন্ত একটি পেশাদার বিষয়; ব্লগের প্রাইভেট গোয়েন্দাগিরি একটি অপেশাদার অনুশীলন। এখন অভিজিত রায়ের হত্যাকান্ডে এলোপাথাড়ি নানান মানুষের প্রতি সন্দেহের তীর ছুঁড়ে দিয়ে ভার্চুয়াল জিজ্ঞাসাবাদ এই তদন্তে কোন ভূমিকা রাখবে না। সিসিটিভির ফুটেজ,খুনীদের ফেলে যাওয়া জিনিসপত্রে তাদের আঙ্গুলের ছাপ,প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান, তাকে যারা হত্যার হুমকি দিয়েছিলো তাদের জিজ্ঞাসাবাদ, হত্যার দিন সন্ধ্যায় অভিজিতের সঙ্গে যাদের দেখা হয়েছে তাদের দেয়া বর্ণনা ইত্যাদি পাজল মিলিয়ে গোয়েন্দারা খুনীদের চিহ্নিত করেছে; কারণ তারা এর চেয়ে জটিল হত্যা প্রক্রিয়ার তদন্ত করে অনেক অপরাধীদের ধরে থাকে। যাদের কাজ তারাই করুক। আমরা অপেক্ষা করতে পারি।

অভিজিত যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক।দেশটি তার নিজের দেশের যে কোন নাগরিকের হত্যাকান্ডে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে। আর এলোপাথাড়ি অভিজিতের ঢাকার বন্ধুদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে তাদের হেয় প্রতিপন্নের চেষ্টা করলে; এরপর কোন অনলাইনে পরিচিত অনাবাসী লেখক একুশে বইমেলায় এলে ঢাকার বন্ধুরা তাকে এড়িয়ে চলবে। কারণ নিজের দেশে সমস্যা তাদের কম নেই। বিরাট কোন দেশের নাগরিকের সঙ্গে মিশতে গিয়ে বিরাট দেশের নাগরিক অনাবাসীদের এই ঝুঁকিপূর্ণ দোষারোপকরণের হ্যাপা আর কে নেবে!

“নিজেও জীবনে কিছু হইতে পারলাম না; ঢাকায়ও কাউরে কিছু হইতে দিমুনা”

আমাদের দেশে ডিফেমেশান বা মানহানিমুলক বিষয়ে আইনের আশ্রয় নেয়ার অনুশীলন বাড়ানো উচিত। আমরা অনেকেই নিজেদের শিক্ষিত,সংস্কৃতিবান ও সমসাময়িক বিশ্বের জন্য মানানসই দাবী করি। ধর্ম-অধর্ম-আদিম আচরণ ইত্যাদি নিয়ে বিরাট বিরাট বক্তৃতা করি। কিন্তু অন্যের মানহানি করার সময় ‘তালেবানদের’ মত আদিম আচরণ করি। আমরা অনেকেই দাবী করি আমরা পশ্চিমা দেশে থেকেছি বা থাকি; বিস্তর আধুনিকতা অর্জন করেছি; এখন দেশের মানুষকে আপ-টু-ডেট করার গুরু দায়িত্ব কাঁধে; কিন্তু এটুকু শিখিনি যে পাবলিকলি অনুমানের ওপর ভিত্তি করে কারো বিরুদ্ধে কোন বিষয়ে অভিযোগ উত্থাপন ডিফেমেশান বা মানহানিকর।

একজন নির্দোষ ব্যক্তিকে চাপাতি দিয়ে খুন করা এবং ঘৃণ্য মানহানিকর অভিযোগে অভিযুক্ত করা একই জিনিস। মিথ্যা মানহানিকর অভিযোগ উত্থাপন মানেই মনস্তাত্বিকভাবে কাউকে হত্যা করা;মন বেঁচে না থাকলে শরীর জীবন্মৃত হতে বাধ্য। এটা বোঝার মতো বোধ-বুদ্ধি-আলোকায়ন ঠিক কতজনের আছে আমার জানা নেই।সেকারণেই দেশের তরুণ আইনজীবীদের উচিত স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে ডিফেমেশান সংক্রান্ত আইন-এর প্রয়োগ-প্রয়োজন এসব বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সচেতনতা গড়ে তোলা। পশ্চিমের নানা দেশে তরুণ আইনজীবীরা দলবদ্ধভাবে বিভিন্ন “মানহানির” মামলা লড়ে। এতে সমাজে হুট করে ডিফেমেশান করার অশ্লীল প্রবণতা কমে। যার মানহানি হয় তিনি ক্ষতিপূরণ হিসেবে বড় অংকের টাকা পান; সেখান থেকে মামলা জেতা তরুণ আইনজীবীরা একটা কমিশন নিয়ে নেয়।

অনাবাসে জীবনের চাওয়া-না চাওয়ার হিসাব মেলাতে না পারার আত্মপরিচয়ের সংকট থেকে কিছু ব্যর্থ চিন্তকের সৃষ্টি হয়েছে; যারা ওয়েটিং ফর গোডোর নিশ্চল মঞ্চে বসে বাংলাদেশের বৈচিত্র্যময় জীবন দেখে আত্মপীড়ায় ভোগে; আহারে শাহবাগ-বইমেলা-মায়ের হাতের শীতের পিঠা-সৃজনশীল জগতের বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা। অথচ সেলফিতে তুলে ধরতে হয়, ভালো আছি; ভালো আছি। এটা নিঃসন্দেহে বেদনার বিষয়। কিন্তু ফেসবুকে ঢাকার লেখক-আঁকিয়ে-কবি-চিন্তকদের ছিমছাম বৈঠকের ছবি, পহেলা বৈশাখ উদযাপনের রঙের বাড়ই; স্ব স্ব ক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়া তরুণদের ছবি দেখে তাদের ভেতরে হনন আকাংক্ষা জাগে; এরা লাইক্যানথ্রপিক রোগে আক্রান্ত হয়।উঠতি লেখকের বইপ্রকাশের অনুষ্ঠানের ছবি; বা কোন চিন্তকের কোথাও বক্তৃতা দেবার ছবি দেখে ভেতরে ভেতরে এক হিংস্র তালেবান ইচ্ছা জন্ম নেয় তাদের অবচেতনে। ঐ যে মানহানি দিয়ে পুড়িয়ে মারা; সেই এশিয়াটিক মোড অফ প্রোডাকশানের আন্ধার গ্রাম থেকে ঐটুকু আমরা সবাই আহরণ করেছি জীনগতভাবে।

তো এসব কতিপয় অনাবাসী সাইকোদের ডিফেমেশানের প্রবণতা বাড়ছেই; ভাবখানা এমন; নিজেও কিছু হইতে পারলাম না; ঢাকায়ও কাউরে কিছু হতে দিমুনা। শুরু হয়ে যায় চুলকানি; মানহানিকর অনলাইন প্রচারণা। আমাদের দেশের মানুষ এই গালি আবার কোলাকুলি এই প্রাচীন পদ্ধতিতে মিলে ঝুলে থাকে; মিল মহব্বত করিয়ে দেয়া থার্ড ফোর্সের অভাব নেই; তাই কোন মানহানির অপরাধের অভিযোগ আদালত পর্যন্ত গড়ায় না।

কিন্তু ডিফেমেশান সংক্রান্ত আইনের প্রয়োগ জরুরী। পশ্চিমা সমাজে কেউ মিডিয়ায় কারো প্রতি সন্দেহ প্রকাশ করে অভিযোগ করতে পারেনা। অভিযোগ লেখাতে হয় গোপনীয়তার সঙ্গে; কিন্তু অভিযোগ ভুল প্রমাণ হলে অভিযোগ কারীর শাস্তি হয়। আর মিডিয়ার সামনে মানহানি তো আরো ভয়ংকর অপরাধ। তো আইন আমাদের দেশেও একই কিন্তু এর প্রয়োগ নেই। আমাদের এইসব বিকৃত চুলকানির একমাত্র মহৌষধ হতে পারে ‘মানহানি মামলা’র প্রচলন এবং কুতসা ও অপবাদ রটনা কারীর কঠোর শাস্তি।একটা দুটো দৃষ্টান্ত তৈরী হয়ে গেলে; অনাবাসে জমা হওয়া বাড়তি স্মার্টনেসের মেদটুকু ঝরে যাবে দুদিনেই।অনাবাসী সম্পর্কে এটি কোন ঢালাও অভিযোগ নয়। কিছু অনাবাসীর গত কয়েক বছরের সাইবার বুলি ও ডিফেমেশানের কেসস্টাডিগুলো পর্যবেক্ষণ করে পাওয়া এটি একটি অনুসিদ্ধান্ত।

ঢাকা জার্নাল, ২৭ জুলাই, ২০১৬।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.