গুলতেকিনের কবিতার আনন্দময় ভ্রমণ প্রত্যাশা মাসকাওয়াথ আহসানের।

জুলাই ২১, ২০১৬

gultakinমাসকাওয়াথ আহসান: একটি ওয়েবপোর্টালে কবি গুলতেকিন খানের একটি সাক্ষাতকার পড়লাম; যেখানে কবি গুলতেকিনের বয়ানে হুমায়ূন আহমেদ সম্পর্কে বেশ কিছু নেতিবাচক কথা উঠে এসেছে।

কবি গুলতেকিন খান একটি এনলাইটেনড পরিবার থেকে আসা মানুষ; এমন একটি ন্যারেটিভ সম্পর্কে আমরা অবহিত।

অন্যদিকে একজন মানুষ নেহাত হিটলার-বুশ-নেতানিয়াহু-এরদোয়ান নাহলে মৃত্যুর পর তার শব ব্যবচ্ছেদ অন্তর্গত আলোকায়নসম্পন্ন মানুষ করেন না বলেই জানি। গুলতেকিন এবং হুমায়ূনকে আলোচনার ক্ষেত্রে তাদের মাঝে কে নারী বা কে পুরুষ তা বিবেচনা না করে; পারসন হিসেবেই দেখতে চাই। গুলতেকিন নামটি এতো সুন্দর যে পৃথিবীতে কয়েক হাজার গুলতেকিন তো রয়েছেনই।

আমরা আলোচ্য গুলতেকিনকে চিনি হুমায়ূনের কারণে এটি নির্জলা বাস্তবতা। এবং হুমায়ূন-গুলতেকিনের মাঝে যে সম্পর্কটি গড়ে উঠেছিলো; তা দ্বি-পাক্ষিক ভালোলাগার প্রেক্ষিতে। সুতরাং এটি দু’জন ব্যক্তির মাঝে বোঝাপড়ার বিষয়। এখানে তৃতীয় কোন ব্যক্তির নাক গলানোর কোন অধিকার নেই। পৃথিবীতে দু’জন ভালো মানুষের মাঝেও সম্পর্কচ্যুতি ঘটতে পারে। সেটা তাদের একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়।

এরকম ব্যক্তিগত বিষয়কে কেউ যদি মিডিয়ার কলপাড়ে নিয়ে আসতে চায়; সেটা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের সোনালী আচরণবিধির স্পষ্ট লংঘন। শুধু কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী নয় সামগ্রিকভাবে প্রতিটি মানুষের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য আচরণবিধির এই সোনালীসূত্র। কবি গুলতেকিন খান ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী হওয়ায় উনার অগ্রসর সমাজের আচরণবিধি সম্পর্কে জানার কথা।

উনি আর পাঁচটা মানুষের চেয়ে অগ্রসর ভাষায় কথা বলবেন; সেটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু একটি ওয়েবপোর্টালে দেয়া সাক্ষাতকারে গুলতেকিন হুমায়ূনকে একজন খলনায়ক হিসেবে তুলে ধরলেন; তা-ও উনার মৃত্যুর চারবছর পর যখন কোন প্রশ্নের উত্তর দেয়া হুমায়ূনের পক্ষে সম্ভব নয়। হুমায়ূন আসলে এমন একটি পরিবার থেকে এসেছেন যেখানে শৈশবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো; উনি জাদু দেখাতেন; সৃজনশীলতার আনন্দযজ্ঞ যাকে বলে। সেই আনন্দগৃহ থেকে হুমায়ূন আহমেদ, জাফর ইকবাল, আহসান হাবীব তিনজন সৃজনশীল মানুষ পেয়েছি। তাদের স্বর্ণগর্ভা মায়েরও লেখালেখির চর্চা ছিলো।

আমি গুলতেকিন খানের বেড়ে ওঠার পরিবেশ সম্পর্কে জানিনা। উনি অধ্যক্ষ ইবরাহীম খাঁর নাতনী। নিঃসন্দেহে অনেক আগের শিক্ষিত পরিবার। তবে গুলতেকিন খানের সাম্প্রতিক সাক্ষাতকার পড়ে শব্দচয়নে সেই এনলাইটেনমেন্টের ঘাটতি চোখে পড়েছে। উনি অভিযোগ করছেন, হুমায়ূন তাঁকে আন্ডার এস্টিমেইট করতেন। পড়াশুনায় উতসাহিত করেননি। বড়জোর সমাজবিজ্ঞান পড়তে বলেছিলেন।

দুজনের মাঝের ব্যাপার, এতো ডিটেইলে যাওয়া আমাদের অনুচিত। তবে হুমায়ূনের কথা অনুযায়ী গুলতেকিন যদি সমাজবিজ্ঞান পড়তেন; তাহলে আজ অপভ্রংশ-পরচর্চাজীবী বুভুক্ষু সমাজের সামনে এসে একান্ত ব্যক্তিগত ক্ষোভ ঢেলে দিতেন না। সমাজবিজ্ঞান পড়লে গুলতেকিন বুঝতে পারতেন; দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের কথা তৃতীয় পক্ষকে বলে অনগ্রসর সমাজের মানুষ। সেটা ওখানে প্রয়োজন রয়েছে। অনগ্রসর মানুষের ক্ষোভ প্রকাশের কর্কশতার মাঝে সাবলীল সৌন্দর্য্য থাকে। কিন্তু যখনই পরিবার ও সমাজ কাউকে চিন্তার জগতে অগ্রসর হবার সুযোগ দিচ্ছে; তখন সেই এনলাইটেনড মানুষের কাছ থেকে সমাজ আলোকিত চিন্তার উদ্ভাস দেখতে চায়।

এই আলোচনায় গুলতেকিনের জায়গায় হুমায়ূন; হুমায়ূনের জায়গায় গুলতেকিন থাকলেও অন্তর্গত আলোকায়নের দায়িত্বশীলতার কথা একইভাবে উত্থাপিত হতো। প্রেম-বিয়ে-বন্ধুতা যে কোন ক্ষেত্রেই সম্পর্কচ্ছেদ ঘটতে পারে; এটাকে অগ্রসর পৃথিবী স্বাভাবিকভাবে নিতে ও দেখতে শিখেছে। আপোষের ঘানি টেনে চল্লিশ বছরের সশ্রম কারাদন্ড ভোগের মত তিক্ত সম্পর্ককে একটি শবদেহের মতো টেনে নিয়ে না গিয়ে; তিক্ততার আশংকা ঘটলে শিষ্ট মনোভঙ্গির মাঝ দিয়ে সম্পর্কের সুষমা থাকতে থাকতেই বিদায় নিতে হয় পৃথিবীর যে কোন সম্পর্ক থেকে। সেটিই একটি স্বাস্থ্যপ্রদ অনুশীলন হিসেবে সচেতন সমাজে প্রত্যাশিত।

আর পৃথিবীতে কোন মানুষের জীবনই রূপকথা হয়না। অনেক জমানো ব্যথা বেদনা রয়ে যায়। এক্ষেত্রে একজন সৃজনশীল মানুষের সুবিধা হচ্ছে, তিনি তার কবিতায়-প্রতীকে-রূপকে সে বেদনার কথা নিশ্চয়ই বলতে পারেন। কবি গুলতেকিনের কবিতার দীর্ঘ এক আনন্দময় ভ্রমণ প্রত্যাশা করছি।

ঢাকা জার্নাল, ২১ জুলাই, ২০১৬।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.