প্রত্যেকের মনে একজন সন্ত্রাসীর বসবাস

জুলাই ১৮, ২০১৬

maskawatমাসকাওয়াথ আহসান : প্রত্যেকের মনে একজন সন্ত্রাসীর বসবাস সমাজের মাঝে দৃশ্যমান চিন্তার অস্থিরতা; সন্ত্রাসবাদের মতো গুরুতর সমস্যাটি সমাধানের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। যে সমস্যাটা পরিবারে; তার সমাধানটা সেখানেই খুঁজতে হবে।

সন্ত্রাসবাদকে বিছানার নীচে; সোফার পিছে খুঁজে কোন লাভ নেই; যেটা মস্তিষ্কের মাঝে আছে তাকে কেন মস্তিষ্কে খুঁজে পাচ্ছে না সমাজ।

আমাদের শিশুদের বড় করার ক্ষেত্রে পরিবারগুলোর কোন পরিকল্পনা থাকেনা। এটা সব বিত্তের পরিবারের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। শিশুদের বেশ কিছুকাল ধরে আর কেউ বলে না, মানুষের মতো মানুষ হও।

জীবনের লক্ষ্য যদি ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, পুলিশ ইত্যাদি নানা পেশাজীবী হওয়া হয়; তাহলে সে ঠিকই ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, পুলিশ ইত্যাদি হয়। কিন্তু তাকে যেহেতু মানুষ হতে বলা হয়না; তাই সে মানুষ হতে পারেনা। আর ব্যক্তিত্বের আদল গড়ে না ওঠা মানে শেষ পর্যন্ত পেশাতেও ব্যর্থ হওয়া; মানুষ হিসেবে তো অবশ্যই।

অথচ সভ্য সমাজে শিশুদের পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত সততার শিক্ষা দেয়া হয়, নৈতিকতা শিক্ষা দেয়া হয়, নিসর্গ এবং মানুষকে ভালোবাসতে শেখানো হয়। পরিবারে-সমাজে কেউ তাকে জিজ্ঞেস করে না, ডাক্তার হইবা না এমবিএ হইবা, নাকি কম্পুটার ইঞ্জিনিয়ার হইবা। সেগুলো খুব বড় ব্যাপার নয়। সভ্য সমাজ প্রথমে মানুষ তৈরী করে; মানুষ তার আগ্রহের সঙ্গে মিলিয়ে পেশা খুঁজে নেয়। ফলে পেশাগত কাজগুলোও হয়ে পড়ে আনন্দের অংশ।

ব্যক্তিগত হতাশা বলে আর কিছু থাকে না। আমরা ছেলে বড় হয়ে কেমন উপার্জন করবে তা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ায়; ছেলের জ্ঞানার্জনও হয়না; সৃজনশীলতার বিকাশও ঘটে না। সে কলুর বলদের মতো উপার্জন করে; তার ভেতরে লুকানো সম্ভাবনাগুলোর মৃত্যু ঘটে। সম্ভাবনার মৃত্যু মানেই আত্মপরিচয়ের সংকট।

কে আমি, মেলেনা উত্তর… শিশুদের নৈতিকতা শিক্ষা বলতে আমরা বুঝি সে হুজুরের কাছে আমসিপারা পড়বে; যার মানে হুজুর এক-আধটু বোঝেন, শিশুকে বোঝানোর জন্য যা যথেষ্ট নয়। পরিবারের পক্ষ থেকে যদি শেখানো যায়, সব সময় সত্যি বলবে, সুন্দর চিন্তা করবে, মঙ্গল বা কল্যাণের জন্য কাজ করবে, মানুষ-প্রাণী-নিসর্গ সবাইকে ভালোবাসবে; তাহলে কিন্তু পৃথিবীর সমস্ত ধর্ম-বিশ্বাস-অবিশ্বাস বিষয়ক আলোচনার মূল লক্ষ্যটি শিশুরা খুঁজে নিতে পারে। এরকম সহজিয়া নৈতিকতা শিক্ষা আবহমান গ্রাম বাংলায় প্রচলিত ছিলো; এখনো নেই তা বলা যাবে না। ফলে সভ্যতা থেকে গ্রামবাংলা পিছিয়ে ছিলো তা বলা যাবে না।

সমস্যাটা তৈরী হয়েছে মেট্রোপলিটানে। দিকভ্রান্ত এই আধাগ্রাম্য-আধা মেট্রোপলিটান ইট-পাথরের “ব্যর্থ নগরীটি” গ্রামবাংলার পরিবার-সমাজের আত্মবিশ্বাস ভেঙ্গে দিয়েছে। গ্রাম বাংলা থেকে সত্য-সুন্দর-মঙ্গলের শিক্ষা দিয়ে একজন মানুষকে যখন শহরে পাঠানো হয়; তখন সে আবিষ্কার করে, এতোদিন সে ভুল শিখেছে। তাকে মেট্রো-রুরাল-নগরীর পিঁপড়া বিদ্যা শিখতে হবে।

পিঁপড়াবিদ্যা শেখার দুটো পথ; হয় ধর্ম ব্যবসায় যুক্ত হওয়া কিংবা সংস্কৃতি ব্যবসায় যুক্ত হওয়া। কারণ এদুটো দিয়ে রাজনীতি ব্যবসার অংশ হওয়া; অত্যন্ত দ্রুত আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হওয়া খুবই সহজ। মিডিয়াতেও ধর্ম ব্যবসায়ী ও সংস্কৃতি ব্যবসায়ীরা চেষ্টা করে পরস্পরের প্রতি ঘৃণা ছড়িয়ে ভোক্তা আকৃষ্ট করতে। কেউ বিক্রি করতে চায় হিজাব, কেউ বিক্রি করতে চায় ব্যাকলেস ব্লাউজ। ধর্ম ব্যবসায়ীরা পরিবারগুলোকে ক্রমাগত ‘গুণাহ’র ভয় দেখায়, সংস্কৃতি ব্যবসায়ীরা ক্রমাগত ‘ক্ষ্যাত’ হয়ে যাবার ভয় দেখায়। এই যে গুণাহ এবং ক্ষ্যাত হবার ভয়; তা সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে।

একদল মানুষ ধর্ম মোল্লাদের ধমক খেয়ে টেয়ে তাদের নৈকট্য অর্জন করতে চেষ্টা করে। আরেকদল মানুষ সংস্কৃতি মোল্লাদের ধমক খেয়ে টেয়ে তাদের নৈকট্য পাবার চেষ্টা করে। কেউ ফেসবুকে ছেলের নামাজ পড়ার ছবি দিয়ে বলে, সালাত আদায় করিতেছে আমার পুত্র ফয়জুল্লাহ, কয়টি লাইক হবে! আবার কেউ বা মেয়েকে কোন সংস্কৃতি মোল্লার কোলে চড়িয়ে ছবি দিয়ে বলে, বাতিঘরের সান্নিধ্যে আমার মেয়ে কাব্য। (মনে মনে লিখে কয়টি লাইক হবে) এইভাবে সমাজে একটি গাঢ় বিভাজন তৈরী হয়েছে; দুটো পক্ষই কট্টর। কারণ এ যে কুটিল ব্যবসা; তারপর গভীর আত্মপরিচয়ের সংকট। এই যে এতোগুলো ধর্মব্যবসায়ী এরা নিজেরা যখন প্রতিযোগিতায় কুলিয়ে উঠতে পারে না; তখন ভাড়া করে ভিনদেশী জাকির নায়েককে।

এই যে এতোগুলো সংস্কৃতি ব্যবসায়ী এরা যখন প্রতিযোগিতায় কুলিয়ে উঠতে পারে না; তখন ভাড়া করে আনতে হয় বিদেশী শিল্পী। খুবই স্বাভাবিক। কেউ নিজের কাজটা ঠিকমতো না শিখে সারাক্ষণ দুই জাতীয় “পীর” হয়ে ঘুরলে ধর্ম-সংস্কৃতি সব জায়গাতেই ধার করে চলতে হয়। এরফলে অদ্ভুত একটি হাসজারু প্রজন্ম তৈরী হয়েছে। একদল সৌদীবাঙ্গালী হয়ে ঘুরছে; আরেকদল হয়েছে এংলো বাঙ্গালী। এতো বড় আত্মপরিচয়ের সংকট যেখানে; সেখানে দুটি সাংঘর্ষিক জনগোষ্ঠী মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যাবে সেটাই স্বাভাবিক।

গ্রামবাংলায় আগে মেয়ের বিয়ে দেবার সময় অভিভাবকেরা সৎ পাত্র খুঁজতো। এখন গ্রাম-শহরে আজানুলম্বিত দাড়িওয়ালা অভিভাবকেরা পাত্রের চাকরিতে উপরির সুযোগ কেমন তা ঠারে ঠুরে জেনে নেয়। সংস্কৃতি মোল্লারাও মুখে বিরাট বিরাট চেতনার গপ্পো চাঁড়লেও মেয়ের জন্য বড় লোক জামাই খোঁজে; হোক সে নরপশু কিংবা রাজাকার। ফলে সমাজের ভিত্তিতে সততা শব্দটি অচল; এ যখন প্রমাণ হয়েই গেছে; তখন নানামুখি অপরাধ আর সন্ত্রাসবাদে সমাজের নিমজ্জন তো সময়ের ব্যাপার।

কূপমণ্ডুক মেট্রোপলিটানে ধর্ম ব্যবসায়ীদের মাঝে দৃঢ় ঐক্য। এরা মসজিদের প্রতিটি জমায়েতকে ব্যবহার করে মানুষকে কথিত খিলাফতের যুদ্ধে উদ্দীপ্ত করতে। সারাদেশে সেই একই মডেলে মসজিদে দিনে পাঁচবার মানুষকে বোঝানো হয় “শারিয়াহ” আইনেই মুক্তি। আর চলে অবিরাম হেইট স্পিচ। অথচ সংস্কৃতি ব্যবসায়ীদের মাঝে শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই; মাতস্যন্যায়; পনেরো মিনিটের খ্যাতির জন্য উন্মুখ প্রতিটি সংস্কৃতি পীর। তাদের মিডিয়ার বিনোদন দর্শক টানে না। বাধ্য হয়ে দর্শক বিদেশী টিভি দেখে। অথচ বিটিভির স্বর্ণযুগের নাটক-সংগীত-বিনোদন অনুষ্ঠান দেখতে বিদেশী দর্শকরা একসময় তাদের ছাদের এন্টেনাটি যথাসম্ভব উঁচু করে দিতো। এরপর একে একে নিভিল দেউটি।

১৯৭১-এর বুদ্ধিজীবী হত্যার ধারাবাহিকতায় স্বাধীন বাংলাদেশে জাত-শিল্পীদের মিসফিট প্রমাণ করে মানসিকভাবে হত্যা করলো সংস্কৃতি জগতের পিঁপড়াবিদ্যার ফড়িয়ারা। বাঙ্গালী সংস্কৃতির অমিত সম্ভাবনার বাতিগুলো একে একে নিভে যাওয়ায়; জাতিগত সাংস্কৃতিক মেরুদন্ড একটি ভঙ্গুর অবস্থায় পৌঁছে গেলে; সমাজ ভেঙ্গে পড়বে এ আর নতুন কী! এই সাংস্কৃতিক বিশৃংখলার মাঝে বিভাজিত অতি-ধার্মিক “ফয়জুল্লাহ” এবং অতি-প্রগতিশীল “কাব্য” সমাজ এখন মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেছে। ফয়জুল্লাহ কাব্যের মাথায় চাপাতি ঠেকিয়ে জিজ্ঞেস করছে, কলেমা শাহাদত জানস! আবার এ এমন এক বিচিত্র বেয়াই সমাজ এখানে ফয়জুল্লাহ আর কাব্যের বিয়েও হয়ে যাচ্ছে। ফয়জুল্লাহ কাব্যকে চাপ দিচ্ছে পর্দা করতে; কাব্য আশা করছে ফয়জুল্লাহ তার সাংস্কৃতিক বৃত্তের ক্রাশ ভাইয়ার মতো একটু স্মার্ট হোক। এরকম অনেক গৃহদাহ আমাদের সমাজে জারী আছে। গৃহেই যে সন্ত্রাস আছে তা সমাজে ছড়িয়ে যাবে এতো একেবারে দুই যোগ দুই চারের অংক।

আবার চল্লিশের পর মিডল এজ ক্রাইসিস; তারো কিছু পরে মৃত্যুভয়ে অধিকাংশ নারী-পুরুষই ধর্মকে প্রয়োজনের চেয়ে বেশী আঁকড়ে ধরে। সন্তানদের খুব দ্বিধা দ্বন্দ্বে ফেলে দেয় আব্বা-আম্মার বা যে কোন একজনের এই অদ্ভুত রুপান্তর।

যে মা পয়লা বৈশাখে লাল টিপ পরে রমনার বটমূলে যেতো; সে হঠাত হিজাব পরে ঘুরলে ছেলে তখন হিজাব না পরা নারীকে হত্যার জন্য প্রস্তুত হবে। কেননা “গুণাহ” আর “কবর”-এর আজাব এর ভয়ে তার মা যেহেতু নাইলনের ওড়না পরার উড়ুক্কু দিনগুলো পিছে ফেলে সৌদী তাঁবু পরে ঘুরছে; সুতরাং কেউ তাঁবু না পরলেই তাকে হত্যা করা যেন ওয়াজিব হয়ে পড়ে।

এসব সর্বনাশা ভ্রান্তি পরিবার থেকেই তৈরী হয়। মাদ্রাসা শিক্ষা-সাধারণ শিক্ষা-ইংলিশ মিডিয়ামের শিক্ষার্থীদের মাঝেও শ্রেষ্ঠত্বের দ্বন্দ্ব আছে; কেউ ধর্ম করা দিয়ে, কেউ দেশপ্রেম করা দিয়ে, কেউ ইংলিশ করা নিয়ে একরকমের স্নায়ুযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। সেই সংঘর্ষ বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই বাক-সন্ত্রাস হলেও; এতে মানসিক গণহত্যা চলছে ব্যাপক।

বৈশ্বিক সমসাময়িক সন্ত্রাসবাদের ফ্যাশানটাকে গ্রহণ করে সংঘর্ষটা এখন শারীরিক হত্যায় পৌঁছে গেছে। আমাদের পরিবার ও সমাজ তারুণ্যকে একটি চাকরি যোগাড়ের ইঁদুর দৌড় আর স্টেটাস অর্জনের ভোঁদড়দৌড়ে নামিয়ে দিয়ে; এখন গ্যালারিতে বসে বুক চাপড়াচ্ছে।

রাজনীতি ব্যবসায়ীরা নীতিনির্ধারণের চেয়ারগুলোতে বসে নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী সংকটগুলোকে ব্যাখ্যা করছে। অথচ কেউ বুঝতে চাইলো না এই তারুণ্যের সৃজনশীলতা বিকশিত হতে দিলে; বিভাজিত সমাজ-রাজনীতির অচলায়তন থেকে মুক্তি দিলে তারা কেউ খুনী হোতো না ; কারো জীবন কেড়ে নিতো না; প্রত্যেকে হয়ে উঠতো এক এক জন জীবনদায়ী মানুষ। লেখক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

ঢাকা জার্নাল, ১৮ জুলাই, ২০১৬।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.