একটি গুলিতেই সব আয়োজন কান্নায়…

জুলাই ৮, ২০১৬

Solakiaঢাকা জার্নাল: ঝর্ণা রানী ভৌমিক প্রতিদিনের মতই ভোরে উঠে স্নান সেরে পুজোর কাজ শেষ করে রান্নাঘরে ব্যস্ত ছিলেন। অনেকদিন পর ছেলে বাড়িতে ফিরেছে। মনে মনে অনেক আয়োজন করে রেখেছিলেন। কিন্তু সে আয়োজন কান্নায় পরিণত হলো, একটি গুলির আঘাতে।

ভৌমিক বাড়ির কর্ত্রী ঝর্ণা রানী ভৌমিক (৪০) সেমাই রেধেছেন। রুটি বানানোর জন্য ময়দা মাখাচ্ছিলেন। এমন সময় চারদিকে গোলাগুলি। বাড়ির সবাই ততক্ষণে বুঝতে পেরেছেন ঘরের বাইরে কিছু একটা হচ্ছে। প্রাণ রক্ষায় সবাই যার যার ঘরে মাটিতে শুয়ে পড়েন। ঠিক সে মুহূর্তে বড় ছেলে স্নানের ঘর থেকে মাকে লুঙ্গি দিতে বলে।

সব ভুলে গিয়ে রান্নাঘর থেকে শোয়ার ঘরে যান ঝর্ণা। তখনই জানালা ভেদ করে একটি গুলি এসে ঠিক মাথায় লাগে তার। ঘরের ভেতরেই লুটিয়ে পড়েন তিনি। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মেঝে ভেসে যায় রক্তে। পরিবারের সদস্যদের তাকিয়ে তাকিয়ে তার চলে যাওয়া দেখা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না। বাইরে চলছিল দুপক্ষের গোলাগুলি, হাসপাতাল নিয়ে যাবার সময়টুকু দেননি ঝর্ণা। তার আগেই সবার মায়া ত্যাগ করে তিনি না ফেরার দেশে চলে গেছেন।

ঝর্ণার বড় ছেলে বাসুদেব ভৌমিক ঢাকার তেজগাঁও কলেজের হিসাববিজ্ঞানে শিক্ষকতা করেন। ছুটিতে বাড়ি এসেছেন। রান্নাঘরে মায়ের রান্না করা সেমাই আর ময়দার গোলা দেখিয়ে বাসুদেব বলছিলেন, ‘অনেকদিন মায়ের রান্না করা খাবার খাইনি। কেমন করে বিশ্বাস করব মা আর নেই। মায়ের ঘরটা ভেসে গেল মায়েরই রক্তে। অনেকদিন পর বাড়িতে এসেছি, মায়ের প্রিয় খাবার জিনিসপত্র এনেছিলাম। আজ সবই যেন স্বপ্ন মনে হচ্ছে। আমরা তো কারো সাতে-পাঁচে ছিলাম না। তবুও আমার মাকে এভাবে মরতে হলো।’

গৌরাঙ্গ ভৌমিক ঝর্ণার স্বামী সারা শরীরে রক্ত নিয়ে স্তব্ধ হয়ে তখন বসেছিলেন স্ত্রীর পাশে। মুখে কোনো কথাই তখন বের হচ্ছিল না। শুধু নীরব কান্নাই সাক্ষ্য দিচ্ছিল কতটা ভালবাসতেন স্ত্রীকে।
গৌরাঙ্গের ভাই উপেন্দ্র ভৌমিক কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘বৌদি রুটি বেলবে বলে আটা মাখছে। পোলায় লুঙ্গি চাইছিল। বৌদি রান্নাঘর থেকে সেটা আনতে ঘরে যাওয়া মাত্রই জানালা দিয়া গুলি আইলো। আমরা সবাই তখন মেঝেতে শুইয়া আছিলাম। ক্যামনে কী হইয়া গেল, বুঝতেই পারলাম না। একজন দায়িত্ববান মানুষ আমাদের সংসার থেকে চলে গেল। আমরা এখন কার কাছে, কি বিচার চাইব।’

ঝর্ণার ছোট ছেলে শুভ। স্থানীয় আজিমুদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। মায়ের খুব আদরের ছেলে। মাকে জিজ্ঞেস না করে পাশের বাসায় পর্যন্ত যায় না। সে ছেলেটিও বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছে, কথা বলে না কারো সঙ্গে। মা মারা যাওয়ার পর থেকে শুধু কেঁদেই চলেছে।

সুশান্ত ভৌমিক ঝর্ণার দেবরের ছেলে, যেন উন্মাদ হয়ে আছে। ‘বড়মা আমাদের ছেড়ে কিভাবে চলে গেল। সে বলে আমরা এখন বুঝতে পারছি আমরা কোথাও নিরাপদ নই। আমাদের দেয়ালে পিঠ লেগে গেছে। ঘরের ভেতরে দরজা-জানালা বন্ধ করেও আমরা বাঁচতে পারব না। এ দেশের কোথাও আমরা নিরাপদ নই।’

এদিকে সন্ত্রাসীদের সঙ্গে পুলিশের গোলাগুলির ঘটনায় নিহত ঝর্ণা রাণীর ভৌমিককে গতকাল বৃহস্পতিবার রাত ১০টায় চর শোলাকিয়ার সাহাপাড়া শ্মশানে দাহ করা হয়। তার বাড়িতে এখন চলছে শোকের মাতম।

এদিকে আজ সকালে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। ঝর্ণা রাণী ভৌমিকের পরিবারকে এক লাখ টাকা দিয়েছেন। এর আগে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদের ২০ হাজার টাকা দেওয়া হয়।

ঢাকা জার্নাল, ০৮ জুলাই ২০১৬।

 

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.