জিম্মির বর্ণনায় গুলশানের সন্ত্রাসী হামলা

জুলাই ৮, ২০১৬

Gulshanঢাকা জার্নাল : গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় সন্ত্রাসী হামলার সময় ওই রেস্তোরাঁতেই ছিলেন। পরদিন সকালে বেঁচে ফিরেছেন। কিন্তু এখন আর ঘুমাতে পারেন না। চোখ বন্ধ করলেই যেন তিনি দেয়ালে জঙ্গিদের ছায়া দেখতে পান, শুনতে পান পায়ের আওয়াজ।

হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় দীর্ঘ ১২ ঘণ্টার জিম্মি দশা থেকে জীবিত উদ্ধার হওয়া ওই নারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত দৈনিক নিউইয়র্ক টাইমসের কাছে সে রাতের দুঃসহ অভিজ্ঞতার বর্ণনা করেছেন।

১ জুলাই রাতে গুলশানে ওই সন্ত্রাসী হামলায় ২০ জন নিহত হন। এর মধ্যে ১৭ জন বিদেশি, তিনজন বাংলাদেশি (একজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন)।

ওই নারী নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেছেন, তাঁদের আটজনকে সন্ত্রাসীরা একটি টেবিলে বসিয়ে রেখে বলেছিল, তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হবে। এই আটজনের মধ্যে ৮ বছর ও ১৩ বছর বয়সী দুজন শিশুও ছিল। সন্ত্রাসীরা তাঁদের মাথা নিচু করে রাখতে বলেছিল। তিনি বেঁচে গেছেন, কারণ জঙ্গিরা মনে করেছিল তারা সবাই বাঙালি মুসলমান।

ওই নারীর বর্ণনা মতে, জঙ্গিরা জিম্মি করার আধা ঘণ্টার মধ্যেই দেশি-বিদেশি নাগরিকদের মধ্যে ২০ জনকে প্রথমে গুলি করে। এরপর ছুরিকাঘাতে তাঁদের মৃত্যু নিশ্চিত করে। এ সময় সন্ত্রাসীরা শিশুদের চোখ-কান ঢেকে রাখতে বলেছিল। কিন্তু চোখ-কান ঢেকে রাখলেও কী হচ্ছে, তা বোঝা তাঁদের জন্য অসম্ভব ছিল না। হত্যাকাণ্ডের পর আক্রমণকারীরা সব লাইট বন্ধ করে দেয়। অন্ধকারের মধ্যেই তাঁরা আটজন মাথা নিচু করে ওই টেবিলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসেছিলেন। ভোর হওয়ার পর সন্ত্রাসীদের কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত দেখাচ্ছিল। জীবিত জিম্মিদের নিয়ে কী করবে, তারা তা বুঝতে পারছিল না। বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করার জন্য তাঁদের টেবিল থেকে দুজন পুরুষকে আক্রমণকারীরা ছাদে নিয়ে যায়। ওই নারী বলেন, পরবর্তী সময়ে তিনি জানতে পেরেছেন, ছাদে নিয়ে যাওয়া দুই জিম্মির একজন সন্ত্রাসীদের বলেছিল, তারা (সন্ত্রাসীরা) কথা দিয়েছিল, বাংলাদেশি মুসলমানদের ছেড়ে দেবে। তিনি সন্ত্রাসীদের কথা রাখতে প্ররোচিত করতে পেরেছিলেন।
কমান্ডো অভিযান শুরু হওয়ার আগে সকাল ছয়টার দিকে সন্ত্রাসীরা তাদের টেবিলে থাকা আটজনকে ছেড়ে দেয়।
এর আগে আর্টিজান রেস্তোরাঁর এক কর্মীকে উদ্ধৃত করে এক ব্যক্তি ভারতের এনডিটিভির কাছে ওই রাতের ঘটনা বর্ণনা করেন। গতকাল বুধবার এনডিটিভি ওই সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ করে। এনডিটিভির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওই কর্মীসহ কয়েকজন আশ্রয় নিয়েছিলেন একটি শৌচাগারে। জঙ্গিরা বাইরে থেকে বলে, ‘এই, এখানে কারা আছিস, তোরা বাঙালি না ফরেনার?’

রেস্তোরাঁর জিম্মি কর্মীকে উদ্ধৃত করে ওই ব্যক্তি বলেছিলেন, ‘ওকে (উদ্ধার হওয়া ব্যক্তি) দিয়ে সারা রাত্র ওরা (জঙ্গিরা) মাছ ভাজা, পাস্তা, অন্যান্য ফুড-জাতীয় খাবার খাইছে। ওকে কোরআন শরিফ পড়াইছে, ও আমাকে যা বলছে। যে রান্না করে খাওয়াইছে, ওকে বলেছে, তোরা নামাজ-কোরআন পড়বি। ওদের সাহরি খাইয়েছে, ওরাও খাইছে।…ওরা যখন মরবে মরবে, মারা যাবে বা পুলিশের অভিযানের কিছুক্ষণ আগে ওদের বলছে, দেখ, আমরা যে রকম ওদের মারছি, আমারও হাসিমুখে কিছুক্ষণ পরে মারা যাব। তোদের সঙ্গে আমাদের জান্নাতে বসে দেখা হবে। হঠাৎ কিছুক্ষণ পরেই ভেতরে শুনতে পাই শব্দ, গোলাগুলির। আমার পাশ দিয়ে আমার শেফ ডিয়েগো, আর্জেন্টিনার ও দৌড় দিছে। আমরা সাথে সাথে বাথরুমের ভেতর ঢুকি। আমরা নয়জন বাথরুমের ভেতর সারা রাত্র থাকি। পরে অনুমান রাত দুই-তিনটা বাজে, তখন ওরা আমাদের ওখান দিয়ে হাঁটে, হাঁটার পরে বলতেছে যে বাথরুমের দরজা বন্ধ, তার ১০ থেকে ২০ মিনিট পরে এসেই আমাদের বলে, এই ওখানে কারা আছিস, তোরা বাঙালি না, ফরেনার। আমি সামান্য মাথা নোয়ানোর ফাঁকা দিয়ে দেখলাম, একজনের সামনে বড় একটা রামদাও ধইরা আছে, আরেকজনের পেছনে…পিস্তল ধরে আছে।’

ঢাকা জার্নাল, জুলাই ০৮, ২০১৬।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.