আধুনিকতার বোঝা নাকি বদলে যাওয়ার শুরু!

জুন ২৩, ২০১৬

Munzurul karimমনজুরুল করিম:আধুনিকতার বোঝা নাকি বদলে যাওয়ার শুরু! ছোটবেলায় যখন কোন অপরাধে (পড়াশোনা) পরিবারের বড়দের মার খেতাম, তখন একটা প্রতিশোধের নীল নকশা তৈরি করতাম। আমার প্রতিশোধ পরিকল্পনাগুলো এমন- ‘এক সময় যখন আমার টাকা হবে তখন এদের দিকে ফিরেও তাকাবো না’, ‘যখন অনেক বড় হবো তখন এদের না খাইয়ে মারবো’, ‘নিজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে এদের সাথে কোন যোগাযোগ রাখবো না’ ইত্যাদি।
প্রতিষ্ঠিত হতে পারি বা না পারি, আর টাকা-পয়সা থাকুক বা না থাকুক-আমি আমার সামর্থ্যের সবটুকুই পরিবারের জন্যই দিতে চাই এখন। এখন সেই মার খাওয়াটাকেই আশির্বাদ মনে হয় আমার। এখন বুঝতে পারি, তারা তাদের অভিজ্ঞতা দিয়ে আমার মঙ্গলই কামনা করেছেন।
এখন কতকিছু নিয়ে গবেষনা হয়! এই যেমন, শিশুকে কিভাবে বড় করা উচিত, সংসারে স্বামী-স্ত্রী’র দাম্পত্য সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত..আরো কত কিছু! কিন্তু খুব অবাক হয়ে দেখলাম, যে বিষয় নিয়ে যত গবেষনা হচ্ছে, ফেসবুকে যে বিষয় নিয়ে যত চেতনা ছড়ানো হচ্ছে, টেলিভিশনে যত পরামর্শমূলক অনুষ্ঠান হচ্ছে, বিশেষজ্ঞদের যত চেম্বার হচ্ছে, মানুষের অধিকার নিয়ে যত বাণী প্রচারিত হচ্ছে- ততই ভাঙ্গনের পরিমাণ বাড়ছে। ভেঙ্গে যাচ্ছে সবকিছু।
আপনি যদি কোন পুষ্টিবিদের চেম্বারে যান তাহলে দেখবেন এই দেশের কত মানুষ ওবেসিটি বা স্থুলতার সমস্যায় ভুগছে। আপনি যদি বিবাহ সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ আইনজীবির কাছে যান তাহলে দেখবেন কত সংসার ভেঙ্গে যাচ্ছে। আর ডাক্তারের চেম্বারে গেলে তো মনে হবে দেশের সব মানুষই অসুস্থ।
তাহলে এই যে, নারী-পুরুষকে তাদের অধিকার শেখালেন-সেটা কি জন্য? সংসারে গিয়ে অধিকার নিয়ে তুমুল দ্বন্দ্ব তৈরি করার জন্য। বিষয়টি কি এমন যে, এই বিষয়গুলো কেউ জানতো না। নিজের ব্যক্তিগত ভালো থাকা তার বাস্তবতার উপর নির্ভর করে, কোন প্রেসক্রিপশনের উপর নয়। অধিকারের দ্বন্দ্বে যদি সংসার ভেঙ্গে যায় তাহলে পরামর্শ বা চেতনা ব্যবসা ভালো হতে পারে-কিন্তু সুখ বা শান্তি অধরাই থেকে যাবে। তারপর একটা সময় যখন মানুষের সব তেজ কমে যায়, তখন একটা নীড় খুঁজতে চাইলে আর পাবে না। বর্তমান অবস্থা আসলে কি সেই দিকে যাচ্ছে?
আপনার সন্তানের সাথে আপনি কেমন আচরণ করবেন, সেটাও আপনাকে একজন পরামর্শকই বলে দেবেন। কেন, পরামর্শক কি পিতা-মাতার চেয়ে বেশি বুঝে? পরামর্শক আপনাকে বলবে-আপনার শিশুর সাথে আপনি এমন এমন আচরণ করবেন, শাসন করা যাবে না, তাদের ইচ্ছের প্রাধান্য দিতে হবে, তাদের প্রয়োজনগুলো মেটাতে হবে..এমন আরো অনেক কিছু। তাহলে আপনি কি করবেন? শিশু কিছু বুঝে উঠার আগেই তার হাতে একটা ট্যাব উঠে যাবে। আপনি ভাবছেন সে কার্টুন দেখে ইংরেজি শিখছে। অন্যদের সঙ্গে ভাব নিয়ে বলবেন, ‘আমার ছেলে/মেয়ে তো নিজে নিজেই অমুক অমুক এ্যাপস নামাতে পারে, ওর এই বয়সেই এত বুদ্ধি!’ আপনি কিন্তু ঘর বা পরিবার চেনানোর আগেই তাকে সারা বিশ্বের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তার মানে পরিবার বা সমাজকে চেনার আগেই আপনার আয়ত্বের বাইরে চলে গেলো সে। তারপর যখন দেখলেন, সে আপনার নিয়ন্ত্রণে নেই তখন আবার শাসনও করতে পারবেন না। এবার একজন মনোবিজ্ঞানীর কাছে যান। তিনি আপনাকে আপনার সন্তানের সাইকোলজি বুঝে আচরণ করার পরামর্শ দেবেন। শুরু হবে আপনার বেশ কয়েকটি সিটিং। অথবা এত কষ্ট না করে আপনি গুগলে সার্চ দিলেও ভুরি ভুরি বিশেষজ্ঞদের লেখা পাবেন। সেসব পড়ে আপনার চেতনা আরো ঋদ্ধ হবে কিন্তু সমস্যার আর সমাধান পাবেন না।
এভাবেই আধুনিক হয়ে যাচ্ছি আমরা। এভাবেই ঘরের নিয়ন্ত্রণও আধুনিকতার কাছে সমর্পণ করছি অনায়াসে। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্বে সন্তানকে শাসন করার অধিকার হারানোর পর পিতা-মাতার (বাংলাদেশী) যে যন্ত্রণা সেটা তো আমি নিজের চোখে দেখেছি বহুবার। একটা বয়সের পর যখন সন্তানকে আর কাছে পাওয়ারও সুযোগ থাকে না বাবা-মা’র তারা তখন পরিকল্পনা করেন শেষ বয়সে দেশে ফিরে একটা ফার্ম করে সেখানে মাছ ধরবেন। বাংলাদেশেও কি আমরা সেই আধুনিকতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি দ্রুত!
বেশ কয়েকদিন আগে জিপিএ ৫ সংক্রান্ত একটা টেলিভিশন রিপোর্ট নিয়ে তুমুল আলোচনা হলো। রিপোর্টটি যখন প্রথম প্রচারিত হলো তখন সবাই এক সুরে বলতে লাগলো দেশের শিক্ষা রসাতলে গেছে, আমরা ডুবে গেলাম, আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম ভেসে যাচ্ছে-এসব আরো কতকিছু! তার কয়েকদিনের মধ্যেই আবার ফেসবুকে এর বিরোধী একটা গ্রুপ দাঁড়িয়ে গেলো। এমনকি আগে যারা হায় হায় করছিলো তারাও এই দলে যোগ দিলো। বললো, কোমলমতি শিশুদের নিয়ে এসব করা আমাদের ইথিকস বা নৈতিকতার বিরোধী। এবার বলেন, আমাদের নৈতিকতার শিক্ষা কে দিচ্ছে! ফেসবুক? এখন আপনি এর পক্ষেই থাকেন বা বিপক্ষেই যান, বিষয়টা হলো আপনি এর পরিণতি ভোগ করতে শুরু করেছেন।
এ প্রসঙ্গে আমার বস বা সহকর্মী খালেদ মুহিউদ্দীনের কথা মনে পড়ে গেলো। তিনি এক আড্ডায় আমাকে বলেছিলেন, আমাদের সমাজে রাজনৈতিক সমস্যা একটা আশির্বাদ। কারণ, এ দেশে রাজনৈতিক সমস্যা না থাকলে ভেতরের ক্ষয়গুলো সামনে চলে আসবে এবং সেটা ভয়ংকর। বর্তমান অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, দেশের রাজনীতি একটা পর্যায়ে এসে স্থিতাবস্থায় পৌঁছে যাওয়ায় সেই সামাজিক অবক্ষয়গুলো সামনে চলে আসতে শুরু করেছে। এর ধাক্কা সামলানো কঠিন হয়ে পড়বে। আসলেই কি আমরা অস্থির হয়ে যাচ্ছি না? একটা ইস্যু নিয়ে তুমুল আলোচনা হতে হতে আরেকটা ইস্যু এসে যাচ্ছে। আমরা আগেরটা ভুলে যাচ্ছি। ইদানিং তো স্ট্যাটাস দিয়ে সুইসাইড করার সংস্কৃতিও চালু হয়েছে। খালেদ ভাই একটা সময় বলেছিলেন, এই ঢাকা শহরে এখন যদি কেউ একজন ‘শোনা বাবা’ হতে পারে তবে তার ব্যবসা ভালো চলবে। অর্থাৎ সেই ‘শোনা বাবা’ শুধু মানুষের কথা শুনবে কিন্তু কোন সমাধান দেবে না। কারণ আমরা আধুনিক হতে হতে নিজেদেরকে এমন ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছি যে, নিজের কথাটা মন খুলে বলার মতো কোন মানুষ নেই আমাদের।
কিছুদিন আগে একটা বিয়ের অনুষ্ঠানে গেলাম। সেখানে আয়োজন বলতে খাওয়া-দাওয়া ছাড়াও চোখে পড়ার মতো বিষয় ছিল ছবি তোলা বা ভিডিও করার বিষয়টি। কারো মধ্যে কোন আন্তরিকতা বা উৎসব চোখে পড়লো না। আমন্ত্রিত অতিথিদের খাওয়া-দাওয়ার পালা শেষ হলো খুব দ্রুত। তারপর শুরু হলো বিভিন্ন অবস্থান এবং পোজে ছবি তোলা। সেখানে লাইট, ক্যামেরা, ট্রলি, ডিরেকশনের অবস্থা দেখে মনে হলো কোন সিনেমার শ্যুটিং। আমার সাথে থাকা একজন বললেন, এটাই বিয়ের মূল আয়োজন। আজ রাত থেকেই ছবিগুলো ফেসবুকে চলে যাবে। লাইকের পর লাইক, কমেন্টের পর কমেন্ট আসবে এবং এটি একটি সফল বিয়ে হিসেবে প্রচারিত হবে। তাহলে বিয়েটাও কি মানুষ ফেসবুকের জন্যই করছে এখন? আমি বা আপনি কারো এই ধারার বাইরে থাকার সুযোগ নেই। যদি সাহস করে এই ধারায় মিশতে না চান তাহলে আপনি অসামাজিক বা গ্রাম থেকে উঠে এসেছেন। আসলেই কি ফেসবুকের একটা হাসিমুখ মানেই ব্যক্তিগত জীবনে সুখী মানুষ সে। কিছুদিন আগে শুনলাম, সন্তান জন্মানোর জন্যও নাকি এখন স্টাইলিশ হাসপাতাল বা ক্লিনিকগুলোর কদর বেশি। কেন? কারণ, তারা যে এ্যাপ্রনটা পড়তে দেয় সেটাতেই অনেক বড় স্ট্যাটাস বুঝায় এবং সন্তান জন্মের সাথে সাথে ফেসবুকে যে ছবি দেয়া হয় তাতে সেই আভিজাত্যই ফুটে উঠে।
আমাদের গ্রাম থেকে দীর্ঘ আলপথ পাড়ি দিয়ে খালি পায়ে হেঁটে স্কুলে যেতাম আমি। খুব স্বপ্ন দেখি, আমার সন্তানও সেই স্কুলে পড়তে যাক-মাটির স্পর্শে বেড়ে উঠুক। এমন ইচ্ছের কথা আমার এক সহকর্মীকে বলার পর তিনি তার বাস্তবতার কথা বললেন। জানালেন, তার ছেলেক স্কুলে দেয়ার সময় এসেছে। তিনি চান তার ছেলে বাংলা মিডিয়ামে পড়ুক, বড় স্কুলে ছুটোছুটি করে বড় হোক। কিন্তু পরিবারের সব সদস্য এর বিরুদ্ধে। ইংলিশ মিডিয়ামে না পড়লে সেই ছেলের ভবিষ্যৎ কি! আসলেই তো তাই, ভবিষ্যৎ কি? এরপর তাকে ছেলেকে ইংলিশ মিডিয়ামে ভর্তি করাতে হবে। সেখানে তাদের একটা স্ট্যাটাস মেইনটেইন করতে হবে। বাবাকে তার আর্থিক সামর্থ্যর প্রমাণের পরীক্ষা দিতে হবে স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে। কয়েকদিন পর তাকে একটা বড়সড় ট্যাব কিনে দিতে হবে। বছর বছর খরচ বাড়বে। সেই খরচ যোগাতে আরো বেশি কাজ করতে হবে অথবা দূর্ণীতি করতে হবে। কিছুদিন পর সেই সন্তান এত বেশি স্মার্ট হয়ে যেতে পারে যে, গ্রামে বেড়ে ওঠা বাবা সহজেই আনস্মার্ট হয়ে যাবে।
রমজান মাস। বেশি কথা না বলি। কারণ, কোন পরিবর্তনের শুরুতেই বেশিরভাগ সময় তার ভবিষ্যৎ দেখা যায় না। এই সমাজ বদলে যাচ্ছে, এই সমাজ সামাজিক গণমাধ্যম নির্ভর জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। এটা ঠেকানো যাবে না। মূল্যবোধ, পরিবার কোন কিছুই টিকবে না। শিক্ষা এবং আচরণের ধারণার পরিবর্তন হয়ে যাবে। এসব মেনে নিতে না পারা বা কষ্ট করে মানিয়ে নেয়া একটা জেনারেশনের মৃত্যুর পর, পরবর্তী জেনারেশনের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে এই সমাজ। আর সেটা ভালো না মন্দ তা বলার যোগ্যতা নেই আমার।
লেখক, সাংবাদিক, ইনডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশন।
মতামতে দিতে হবে।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.