শ্রমজীবী মায়েদের সন্তানের নিরাপত্তা

জুন ২১, ২০১৬

Aktarul Islamমো. আকতারুল ইসলাম : শান্তি, বয়স ৩ কিংবা ৪ বছর। বাবা-মা কাজ করে গার্মেন্টস কারখানায়। থাকে মিরপুরে টিনসেডের ভাড়া ঘরে। বাবা-মা গেছে কাজে। পাশের ঘরের মহিলার হেফাজতে রেখে গেছে শান্তির মা-বাবা। পাশের ঘরের চুলা থেকে গরম পানি পড়ে ঝলসে গেছে শান্তির গোটা শরীর। শান্তিকে কোলে নিয়ে পাশের ঘরে এক মহিলা দৌড়াচ্ছে ডাক্তারের উদ্দেশ্যে। শান্তির শরীরে যেখানেই হাত দিয়ে ধরছে, হাতের সাথে কচি চামড়া উঠে আসছে। নির্বাক আতংকিত শান্তি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। রাস্তার পাশে ঔষধের দোকান থেকে কেউ একজন পোড়ার ক্রিম কিনে ক্ষতস্থানে লাগাতেই চেঁচিয়ে কেঁদে উঠলো শান্তি। চলতিপথের লোকজন কিছু টাকা পয়সা হাতে দিয়ে শান্তিকে পাঠিয়ে দিল হাসপাতালে তখনও শান্তির বাবা-মা জানে না তাদের বুকের ধন শান্তির এতবড় ক্ষতি হয়ে গেছে। শান্তিকে নিয়ে কিছুদিন আগে তার বাবা-মা এসেছে ঐ টিনসেডের ভাড়া ঘরে। তাদের মোবাইল নম্বর জানে না পাশের ঘরের ভাড়াটিয়ারা।

এই শহরে শান্তির বাবা-মা’র মতো লাখ লাখ শ্রমজীবী তাদের সন্তানদের অনিরাপদ অবস্থায় রেখে কর্মক্ষেত্রে যেতে বাধ্য হন। নি¤œবিত্ত পরিবারে একজনের আয় রোজগারে সংসার চলে না। ফলে ছোট ছোট সন্তানদের অন্যের হেফাজতে রেখে কর্মক্ষেত্রে যেতে বাধ্য হন বাবা-মা। এই শিশুদের জন্য সারাদিন নানা রকম বিপদ আসেপাশে ঘুরে। শান্তির মতো নি¤œবিত্ত এবং শ্রমজীবী মা-বাবার সন্তান কখনো আগুনে পুড়ে, কখনো ড্রেনে পড়ে, কখনো বিদ্যুৎ শক খায়, কখনো রাস্তায় বের হয়ে দুর্ঘটনার শিকার হয়, হারিয়ে যায়, আবার কখনো খারাপ লোকের কবলে পড়ে ধর্ষণের শিকার হয়, আহত-নিহত হয়।

জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কাউন্সিলÑএনসিডিসি ঢাকা, গাজিপুর, নারায়ণগঞ্জ এলাকায় তৈরি পোশাক কারখানায় সম্প্রতি একটি জরিপ কার্য পরিচালনা করে। ১০৪৮ জন শ্রমজীবীর ওপর জরিপ চালনা করা হয়। তাদের মধ্যে ৯৫২ জন অর্থাৎ ৯০.৮৪ ভাগ বসবাস করে ভাড়াঘরে। আত্মীয়স্বজনের বাসায় থাকে ১.৫৩ ভাগ, সাবলেট বা শেয়ার বাসায় বসবাস করে ৪.৩৯ ভাগ, কোম্পানির ডরমেটরিতে থাকে ০.২৯ ভাগ আর সরকারি ডরমেটরিতে থাকে মাত্র ০.১০ ভাগ।

শ্রমজীবী মা-বাবার ওপর আর একটি জরিপ পরিচালনা করা হয়। ১০২১ জন শ্রমিকের ওপর জরিপ চালিয়ে দেখা গেছে বাবা-মা কর্মক্ষেত্রে গেলে তাদের মধ্যে মাত্র ০.৯৫ ভাগ সন্তান থাকে শিশু যতœ কেন্দ্রে। শতকরা ৪৫.৬৩ ভাগ শিশু থাকে তাদের দাদা-দাদী কিংবা নানা-নানীর কাছে। ২১.৪৮ ভাগ শিশু থাকে তাদের অন্যান্য আত্মীয়স্বজনের হেফাজতে। কর্মজীবী মায়ের ৫২৬ জন শিশুর মধ্যে ৭৪ জন থাকে তাদের বাবা কাছে। যা ১৪.০৭ ভাগ। আর প্রতিবেশীর কাছে থাকে শতকরা ০.৩৮ ভাগ শিশু।

দুটি জরিপেই দেখা গেছে যে, শ্রমজীবীদের শতকরা প্রায় ৯০ ভাগের বেশিই থাকেন ভাড়াবাড়িতে কিংবা টিনসেডের ঘরগুলোতে। ঘিঞ্চি, অস্বাস্থ্যকর, আলো বাতাসহীন পরিবেশে দিনের পর দিন বসবাস করতে হয়। সরকারি বা কোম্পানির ডরমেটরিতে শতকরা ১ ভাগও শ্রমজীবী মানুষ বাস করে না। শ্রমজীবী মায়েদের সন্তান শতকরা ১ ভাগেরও কম থাকে শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রে।

আমরা জানি, তৈরি পোশাক রপ্তানি খাত হচ্ছে আমাদের রপ্তানি আয়ের প্রধান উৎস। রপ্তানির দিক থেকে বিশ্বে আমাদের অবস্থান দ্বিতীয়। চীনের পরেই আমাদের স্থান। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরের তথ্যমতে ২০১৫ সালের জানুয়ারি-নভেম্বর ১১ মাসে বাংলাদেশ ২৬.২৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করেছে। যা আগের যে কোন সময়ের রপ্তানি আয়ের চেয়ে বেশি।

তৈরি পোশাক খাত হচ্ছে দেশের শ্রমজীবী মানুষের অন্যতম বড় কর্মক্ষেত্র। যেখানে ৫০ লাখের বেশি লোক কাজ করে। তার মধ্যে শতকরা ৮০ ভাগই মহিলা। এতবড় একটি খাতে কর্মজীবী মানুষগুলো তাদের সন্তানদের নিরাপদ এবং শিক্ষামূলক পরিবেশে রাখার সুযোগ পান খুবই কম ।

রানা প্লাজা দুর্ঘটনা পরবর্তী সময়ে তৈরি পোশাক কারখানার নিরাপত্তা ব্যবস্থা, নিরাপদ কর্মপরিবেশের তাৎপর্যপূর্ণ উন্নতি ঘটেছে। বিশেষ করে কারখানা ভবন অগ্নি নিরাপত্তা, কর্মপরিবেশের উন্নয়নে সরকার কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন নামে নতুন একটি অধিদপ্তরের সৃষ্টি করেছে। প্রায় এক হাজার পরিদর্শক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। প্রতিটি তৈরি পোশাক কারখানাগুলোকে নিয়মিত পরিদর্শনের আওতায় আনা হয়েছে। জানা গেছে, তৈরি পোশাক কারখানায় কর্মরত নারী শ্রমিকের জন্য আবাসন সমস্যা নিরসনের জন্য শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় চট্টগ্রামের কালুরঘাট ও নারায়ণগঞ্জ বন্দর এলাকায় ২টি ডরমেটরি নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। এটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। আর রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় কর্মজীবী মায়েদের শিশুদের জন্য মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের কিছু দিবাযত্ন কেন্দ্র রয়েছে। রয়েছে বেসরকারি উদ্যোগে যেমন: ক্রিস্টিনা ফাউন্ডেশন, ফুলকী এর মতো দু’চারটে শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র। এছাড়া বড় কারখানায়ও কিছু ডরমেটরি তৈরি হয়েছে। যা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল। শুধু অপ্রতুলই নয় শ্রমজীবী অধিকাংশ মা-বাবাই জানেনই না যে, দিবাযতœ কেন্দ্রে তাদের সন্তানকে রাখা যায়।

তৈরি পোশাক শিল্পে নিয়োজিত বিরাট সংখ্যক শ্রমজীবী জনগোষ্ঠী যারা দেশকে মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। দেশের অর্থনীতির চাকা গতিশীল করছে তদের থাকা, খাওয়া-চিকিৎসা, তাদের সন্তানদের নিরাপদ পরিবেশে গড়ে ওঠার ব্যবস্থা আমরা করতে পারিনি। শান্তিরা নিরাপদ পরিবেশে বেড়ে ওঠার পরিবেশ পাচ্ছে না।

বাংলাদেশ শ্রম বিধিমালা ২০১৫ এর ৯৩-৯৫ বিধিতে কর্মজীবী মায়েদের শিশুদের রাখা, খাবার এবং চিকিৎসার বিষয়ে বলা হয়েছে। বলা হয়েছে প্রতিষ্ঠানে সাধারণত ৫০ জনের সংস্থান সংকুলান সুবিধা, সম্মিলিত খাবার ও বিশ্রামের ব্যবস্থা রাখতে হয়েছে। প্রতিষ্ঠানে ৪০ বা ততোধিক মহিলা শ্রমিক নিয়োজিত থাকলে তাদের ৬ বছরের কম বয়সী শিশুদের ব্যবহারের জন্য এক বা একাধিক উপযুক্ত কক্ষের ব্যবস্থা ও রক্ষনাবেক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতিটি সন্তানের জন্য ২৫০ গ্রাম পুষ্টিকর খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে।

শ্রম আইন ও বিধিমালা মেনে শুধু কারখানা পর্যায়ে বিশেষ করে নারী শ্রমিকদের থাকা এবং তাদের সন্তানদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা করতে পারলে শান্তিরা শান্তি পাবে। শান্তির বাবা-মা’রা নিশ্চিন্তে উৎপাদনে ভূমিকা রাখতে পারবে। তৈরি পোশাক খাতটি আরো দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাবে। জাতীয় অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।

[পিআইডি- শিশু ও নারী উন্নয়নে যোগাযোগ কার্যক্রম ফিচার]

ঢাকা জার্নাল, জুন ২১, ২০১৬।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.