কাশিমপুর থেকে কেন্দ্রীয় কারাগারে মীর কাসেম

জুন ২০, ২০১৬

Kasem-aliঢাকা জার্নাল: মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলীকে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার পার্ট-২ থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আনা হয়েছে।

সোমবার (২০ জুন) সকাল ৭টা ২০ মিনিটে পুলিশের প্রিজন ভ্যানে করে তাকে কেন্দ্রীয় কারাগারে আনা হয়।

বিষয়টি  নিশ্চিত করেছেন কাশিমপুর কারাগার পার্ট-২ এর সিনিয়র জেল সুপার প্রশান্ত কুমার।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এর দেওয়া মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে গত ০৮ মার্চ মীর কাসেম আলীর মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার সংক্ষিপ্ত আকারে চূড়ান্ত রায় দেন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বে পাঁচ বিচারপতির আপিল বেঞ্চ। অন্য বিচারপতিরা হলেন- বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার ও বিচারপতি মোহাম্মদ বজলুর রহমান।

রায়ে শহীদ কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিম উদ্দিনসহ ছয়জনকে হত্যা-গণহত্যার দায়ে ফাঁসির দণ্ডাদেশ বহাল রাখা হয়েছে চট্টগ্রাম অঞ্চলে মানবতাবিরোধী অপরাধের মূল হোতা মীর কাসেম আলীর।

গত ০৬ জুন ২৪৪ পৃষ্ঠার পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেন সর্বোচ্চ আদালত। পাঁচ বিচারপতির রায়ে স্বাক্ষরের পর তা প্রকাশিত হয় সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে।

রায়টি রাতেই বিচারিক আদালতে গেলে মৃত্যু পরোয়ানা জারি করেন চেয়ারম্যান বিচারপতি মোহাম্মদ আনোয়ার উল হক এবং বিচারিক প্যানেলের সদস্য বিচারপতি শাহিনুর ইসলাম ও বিচারপতি মোহাম্মদ সোহরাওয়ার্দীর সমন্বয়ে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল। এর পর পরই মৃত্যু পরোয়ানাসহ পূর্ণাঙ্গ রায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারসহ স্বরাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রণালয়, ঢাকার ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট (জেলা প্রশাসক) কার্যালয়সহ সংশ্লিষ্টদের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

পরদিন ০৭ জুন সকালে কাশিমপুর কারাগার পার্ট-২ এর কনডেম সেলে থাকা কাসেম আলীকে মৃত্যু পরোয়ানা ও পূর্ণাঙ্গ রায় পড়ে শোনানো হয়।

পরে রোববার (১৯ জুন) সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের ফাঁসির রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে রিভিউ আবেদন করেন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত এ জামায়াত নেতা। এতে ফাঁসির রায় বাতিল করে খালাস ও অভিযোগ থেকে অব্যাহতির আরজি জানিয়েছেন তিনি।

এ রিভিউ আবেদন খারিজ হলে সরকারের সিদ্ধান্তে কারা কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে শুরু হবে দেশের এই শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির রায় কার্যকরের চূড়ান্ত প্রক্রিয়া। অবশ্য শেষ আইনি সুযোগ হিসেবে মীর কাসেম আলী তার অপরাধ স্বীকার করে ও ক্ষমা চেয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন জানাতে পারবেন। সেটি না করা হলে বা প্রাণভিক্ষার আবেদন নাকচ হলে তাকে ফাঁসির দড়িতে ঝোলানোর ক্ষেত্রে আর কোনো বাধা থাকবে না।

আপিল মামলার রায়ে মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে শহীদ কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিম উদ্দিনসহ ছয়জনকে হত্যা-গণহত্যার দায় (১১ নম্বর অভিযোগ) প্রমাণিত হওয়ায় তাকে সর্বোচ্চ দণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে।

১১ নম্বর ছাড়াও ১২ নম্বর অভিযোগে রঞ্জিত দাস লাতু ও টুন্টু সেন রাজুকে হত্যার দায়েও কাসেমের মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছিলেন ট্রাইব্যুনাল। তবে চূড়ান্ত রায়ে প্রমাণিত না হওয়ায় এ অভিযোগ থেকে তাকে খালাস দিয়েছেন আপিল বিভাগ।

ট্রাইব্যুনালে প্রমাণিত মোট ১০টি অভিযোগের মধ্যে আরও ৬টি অভিযোগে মীর কাসেমের সাজা বহাল এবং আরও ২টি থেকে অব্যাহতি ও খালাস দেওয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে চূড়ান্ত রায়ে ফাঁসির পাশাপাশি ৫৮ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডাদেশ পেয়েছেন তিনি।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী কিলিং স্কোয়ার্ড আলবদর বাহিনীর তৃতীয় শীর্ষনেতা ছিলেন জামায়াতের বর্তমান কর্মপরিষদ সদস্য মীর কাসেম আলী। সুপিরিয়র রেসপন্সিবিলিটি (ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বের দায়) ও জয়েন্ট ক্রিমিনাল এন্টারপ্রাইজ (যৌথ দায়বদ্ধতা) হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে আলবদর বাহিনী ও ছাত্রসংঘের অপরাধের দায়ও তাই বর্তেছে তার ওপরে।

ট্রাইব্যুনালে আটজনকে নির্যাতনের পর হত্যা ও মরদেহ গুম এবং ২৪ জনকে অপহরণের পর চট্টগ্রামের বিভিন্ন নির্যাতনকেন্দ্রে আটকে রেখে নির্যাতনসহ মানবতাবিরোধী ১৪টি অভিযোগে অভিযুক্ত হন মীর কাসেম আলী।

এ ১৪টি অভিযোগের মধ্যে ১০টি প্রমাণিত হয় ট্রাইব্যুনালের রায়ে। বাকি ৪টি অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে পারেননি প্রসিকিউশন।

১৪টি অভিযোগের মধ্যে ১০টি অর্থাৎ ২, ৩, ৪, ৬, ৭, ৯, ১০, ১১, ১২ ও ১৪ নম্বর অভিযোগ প্রমাণিত হয় এবং ৪টি অর্থাৎ ১, ৫, ৮ ও ১৩ নম্বর অভিযোগ প্রসিকিউশন প্রমাণ করতে পারেননি বলে ট্রাইব্যুনালের রায়ে উল্লেখ করা হয়।

এর মধ্যে ১১ নম্বর অভিযোগে সর্বসম্মত ও ১২ নম্বর অভিযোগে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে ফাঁসির রায় দিয়েছিলেন ট্রাইব্যুনালের বিচারপতিরা।

ফাঁসি ছাড়াও প্রমাণিত অন্য ৮টি অভিযোগে আরও ৭২ বছরের কারাদণ্ডাদেশ পান মীর কাসেম আলী। এর মধ্যে প্রমাণিত ফারুককে অপহরণ-নির্যাতনে (২ নম্বর অভিযোগ) ২০ বছর ও নাসির উদ্দিন চৌধুরীকে অপহরণ করে ডালিম হোটেলে নিয়ে নির্যাতনের (১৪ নম্বর অভিযোগ) দায়ে ১০ বছরের কারাদণ্ড পান তিনি। এছাড়া অপহরণ, আটক ও নির্যাতন সংক্রান্ত ৩, ৪, ৬, ৭, ৯ ও ১০ নম্বর অভিযোগে ৭ বছর করে কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়।

অভিযোগগুলোর মধ্যে ৪, ৬ ও ১১ নম্বর বাদে বাকি ৭টিতেই সাজা বহাল রেখেছেন আপিল বিভাগ। ফলে একটিতে ফাঁসি ও দু’টিতে ৭ বছর করে ১৪ বছরের কারাদণ্ডাদেশ কমেছে মীর কাসেমের।

২০১৪ সালের ০২ নভেম্বর মীর কাসেম আলীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশের রায় দেন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-২।

এ রায়ের বিরুদ্ধে  ওই বছরের ৩০ নভেম্বর খালাস চেয়ে আপিল করেন তিনি। প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বে আপিল বিভাগের এক নম্বর বেঞ্চে সাত কার্যদিবসে আপিল মামলাটির শুনানি শেষ হয় গত ২৪ ফেব্রুয়ারি।

ঢাকা জার্নাল, জুন ২০, ২০১৬।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.