অর্থে অভিগম্যতাই টেকসই নারী ক্ষমতায়ন ।। এস এম আববাস

জুন ১, ২০১৬

indexনারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ : অর্থে অভিগম্যতাই টেকসই নারী ক্ষমতায়ন
॥ এস এম আববাস ॥
ঢাকা, ২৯ মে ২০১৬ (বাসস) : বিস্ময়করভাবে নারীর ক্ষমতায়ন বেড়েছে। গত এক দশকে বাংলাদেশের এ উত্থান সারা দুনিয়ার মানুষের নজরে এসেছে। তবে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে নারীর অভিগম্যতা সেভাবে বাড়েনি। যা প্রকৃতপক্ষে টেকসই নারী ক্ষমতায়ন।
নারীর আর্থিক নিরাপত্তা কতটা বেড়েছে, তা নিয়ে এখনও যথেষ্ট প্রশ্ন আছে। স্বাধীনভাবে নারী সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার কতটা পাচ্ছে তাও ভাবার বিষয়।

কর্মক্ষেত্রে আর্থিক ব্যবস্থাপনায় নারী কতটা দায়িত্ব পালনের সুযোগ পাচ্ছে, রাজনীতিতে ও প্রশাসনে ক্ষমতায়ন কতটা বেড়েছে তা হিসেব মিলিয়ে দেখাঈর সময় এসেছে। প্রশাসনের উঁচু পদে নারীর সংখ্যা কত, আর নিচ পদে নারীর সংখ্য্ াকত, তাও আজ ভাবতে হবে।
নারীর ক্ষমতায়ন হতে হলে পরিবার থেকে কর্মক্ষেত্র,তৃণমূল থেকে প্রশাসন পর্যন্ত অর্থনৈতিক কর্মকা-ে নারীকে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জায়গায় পৌঁছুতে হবে। রাষ্ট্র ও সমাজের প্রতিটি স্তরে অর্থনৈতিক কর্মকা-ে নারীকে টেকসই অবস্থানে যেতে হবে।

রাজনীতি ও প্রশাসনসহ সবখানে সক্ষমতা দেখাতে পারলেই বলা যাবে নারীর ক্ষমতায়ন হয়েছে। যদিও টেকসই অবস্থানে পৌঁছুতে হবে নারীকেই।

কথায় কথায় বলা হয়, নারীকে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা দিতে হবে। আসলে নারী তখনই সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা পাবে, যখন সে সক্ষমতা অর্জন করবে এবং তা আদায় করে নেওয়ার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করবে। স্বাভাবিকভাবে একজন পুরুষ যত সহজেই নিজেকে প্রস্তুত করতে পারে একজন নারীর পক্ষে তা সম্ভব হয় না, পারিবারিক ও সামাজিক বাধার কারণে।

অবশ্যই এ লড়াই নারীর একার নয়, পুরুষকেও এ লড়াইয়ে শামিল হতে হবে এ লড়াইয়ে পরিবারকে পাশে থাকতে হবে।
রাজনীতি, প্রশাসন বা কর্মক্ষেত্র নারীর অংশগ্রহণই নারী ক্ষমতায়ন নয়। এ ক্ষেত্রে নারী কতটা সফলভাবে তার ভূমিকা পালন করতে পারছে, সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারছে, সেটাই আসল কথা। একজন নারী নিজে আর্থিকভাবে কতটা সমলম্বী তা নারী ক্ষমতায়নের মূল বিষয়।

‘ক্ষমতা নারীর, আর অর্থ পুরুষের’ তবে তাকে নারী ক্ষমতায়ন বলা যাবে না। অর্থে নারীর অভিগম্যতা (অপপবংংরনরষরঃু) থাকতে হবে। অর্থনৈতিক কর্মকা-ে নারীর স্বাধীন মতামতের মূল্য থাকতে হবে। তাহলেই বলা যাবে নারীর ক্ষমতায়ন হয়েছে।

অর্থে অভিগম্যতা কীভাবে নারীর স্বাধীন মতামত প্রতিষ্ঠা করতে পারে তার উদাহরণ দেশে আছে। আবার কর্মজীবী নারীর আর্থিক ক্ষমতা পরিবার বা সমাজে টেকসই হচ্ছে না তারও উদাহরণ আছে।

বাস্তব উদাহরণ- রাজশাহীর স্কুল শিক্ষক রাশিদা খাতুন। শহরে শিক্ষিত পরিবারে, বড় সরকারি কর্মকর্তার মেয়ে হিসেবে জন্ম নিয়েও রাশিদা খাতুন তার স্বাধীন মতামত প্রয়োগ করতে পারেননি। লেখাপড়া শেষ করে নিজে চাকরিতে প্রবেশের পর অবশ্য তা পেরেছেন।
রাজশাহীর বিড়াদহ গ্রামের সরকারি একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকরি করেন রাশিদা খাতুন। অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার আগে পরিবারে তার মতামত প্রতিষ্ঠিত করতে পারেননি। এমনকি পছন্দের মানুষটিকে বিয়েও করতে পারেননি। পরে চাকরিতে যোগ দিয়ে নিজে সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছেন। নিজের সিদ্ধান্তে পছন্দের পুরুষকে বিয়ে করতে সক্ষম হয়েছেন। এখানে অর্থে অভিগম্যতাই তাকে ক্ষমতায়নের একধাপ এগিয়ে দিয়েছে।

এর পরের চ্যালেঞ্জটি টেকসই ক্ষমতায়ন। রাশিদা বিয়ের পর স্বাধীনভাবে তার স্বামীর পরিবারে নিজের মতামত প্রয়োগ করতে পারছেন না। বেতন পেয়েই পুরো টাকা তুলে দিতে হয় স্বামী খোকনের হাতে। শুধু নিজের খরচটা কাছে রাখতে পারেন। যদিও কখনও কখনও সেই খরচের টাকা থেকেও স্বামীকে দিতে হয়। পরে আবার তা স্বামীর কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে কিংবা অন্যের কাছ থেকে ধার করে পুরো মাসের নিজের খরচ জোগাড় করতে হয়।পরিবারে আর্থিক সংশ্লিষ্টতা বলতে বেতনের টাকা গুণে স্বামীর হাতে তুলে দেয়া। অর্থাৎ একজন নারীকে টেকসই ক্ষমতায়নে পরিবার তার পাশে দাঁড়ায়নি।

তাই নারী ক্ষমতায়নের লড়াই নারীর একার নয়, পুরুষেরও। রাষ্ট্র, সরকার ও সমাজ নারী ক্ষমতায়নের পটভূমি রচনা করবে আর নারী তার যোগ্যতা দিয়ে টেকসই অবস্থান তৈরি করবে। নারী ক্ষমতায়ন শুরু হবে প্রথমে পরিবার থেকে। প্রথমেই নারীর অর্থে অভিগম্যতা নিশ্চিত করবে তার পরিবার। আর পরিবার বদলালেই সমাজ বদলাবে। রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থায় নারীকে আর্থিকভাবে ক্ষমতাবান করে তুলতে হবে ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে।

একজন নারীর অর্থে অভিগম্যতা নিয়ে কুসংস্কার থাকলেও ধর্মে এর বাধা নেই। পবিত্র কুরআন শরিফে স্পষ্ট বলা হয়েছে, পুরুষ যা অর্জন করে সেটা পুরুষের এবং নারী যা অর্জন করে সেটা নারীর। আয় পুরুষের। (সূরা ৪ : ৩২)। শুধু তাই নয়, ইসলাম নারীকে মত প্রকাশেরও স্বাধীনতা দিয়েছে।

বাংলাদেশের সংবিধানের ২৯নং অনুচ্ছেদ বলা হয়েছে- ‘রাষ্ট্রের কর্মে নিয়োগ লাভের ব্যাপারে সব নাগরিকের সমান সুযোগ থাকবে এবং কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষ ভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিক রাষ্ট্রের কর্মে নিয়োগ বা কর্ম লাভের অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন না অথবা তাঁর প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা যাবে না।’

তাহলে কোন কারণে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক কর্মকা-ে অংশ গ্রহণে বিরূপ অবস্থার সৃষ্টি হয়? আসলে জেন্ডার বৈষম্যই মূল বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। নারীদের পুরুষের স্বার্থে ব্যবহারের আত্মঘাতি চিন্তা এ অবস্থার সৃষ্টি করছে।
একজন নারী অর্থনৈতিক ক্ষমতা পাবে এটি পুরুষতান্ত্রিক সমাজ মেনে নেয় না। রাজনৈতিক ও সামাজিক সিদ্ধান্ত নেয়ার অর্থ নারী পুরুষের ওপরে অবস্থান নেয়া, এই নিচু ধারণা ও মানসিকতা থেকে নারীকে হতে হয় লাঞ্চনার শিকার।এ কারণে সকল স্তরে জেন্ডার সমতা আনতে প্রশাসনিক পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।

দরিদ্র পরিবারকে সহায়তা দিতে নারীদের অর্থে অভিগম্যতা শুরু হয় ১৯৭৪ সালে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশে মাইক্রোক্রেডিট প্রথম শুরু করেন সমাজ সেবার লক্ষ্য নিয়ে। সমবায় ভিত্তিতে আরএসএস প্রকল্পের মাধ্যমে শুরু করেন মাইক্রোক্রেডিট। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর তা আর এগুয়নি। তবে বেসরকারি সংস্থাগুলো (এনজিও) নিজস্ব বিতর্কিত ফরমুলার মধ্য দিয়েই নারীদের অর্থে অভিগম্যতা ছড়িয়ে দেয় সারা দেশে। আর সমবায়ের লক্ষ্য নিয়ে সমাজ উন্নয়নের সরকারি কর্মসূচির প্রসার হয়নি এখনও।
তবে আশার কথা সরকারের প্রায় প্রতিটি সেক্টরেই নারী ক্ষমতায়ন মাথায় রেখে সরকার প্রশাসনে জেন্ডার সমতা আনতে ব্যাপক কর্মসূচি নিয়েছে।

ইতোমধ্যে পরিবেশ অধিদপ্তর পরিবেশ শাসনে জেন্ডার অ্যনালাইসি কাঠামো করেছে (প্রস্তাবিত)। ২০১০ সালে সামাজিক বনায়ন নীতিমালার আওতায় নারী ক্ষমতায়নে বিধি করা হচ্ছে। নারী নির্যাতন বিরোধী আইন করার পাশাপাশি প্রশাসনে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার নানা কর্মসূচি সরকার হাতে নিয়েছে।প্রতিটি মন্ত্রণালয় জেন্ডার বৈষম্য নিরসনে পদক্ষেপ নিয়েছে সরকারের নির্দেশে।
এছাড়া নারীদের রাজনীতিতে সক্রিয় করতে বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন দলে এবং সরকারের ভেতরে।জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত আসনের বিপরীতে নারী প্রতিনিধিত্ব রয়েছে।বাড়ছে সক্রিয় রাজনীতিতেও।
বাসস-ইউনিসেফ ফিচার

ঢাকা জার্নাল, ০১, জুন, ২০১৬।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.