সৃজনশীলরা কি মানসিক রোগী?

এপ্রিল ১২, ২০১৬

Creativeসৃষ্টি ঘটক : বাইপোলার ডিজ-অর্ডার বা ম্যানিক ডিপ্রেশনে আক্রান্ত ব্যক্তিরাই সৃজনশীল পেশার প্রতি বেশি আগ্রহী। সিজোফ্রেনিয়া, আশঙ্কা ও হতাশাগ্রস্ত মানুষের ক্ষেত্রেও এটা হতে পারে। ২০১১ সালে  সুইডিশ সরকারের আদম শুমারির তথ্য পর্যালোচনা করে একদল গবেষক সৃষ্টিশীল মানুষের মানসিক রোগ সম্পর্কে এমন তথ্য দেন।

এই গবেষকদল সৃজনশীলতার আপেক্ষিকতা নিয়ে কাজ করেন। পেশার ধরন বিবেচনা করে তারা শিল্পী, আলোকচিত্রী, নকশাকার ও বিজ্ঞানীদেরকেই সৃজনশীল মানুষ হিসেবে চিহ্নিত করেন। কয়েকটি পেশার মানুষের ওপর চালানো এই সমীক্ষা কতটুকু যুক্তিযুক্ত, সেটিও আলোচনার বিষয়। তবে তারা বেশ জোর দিয়েই বলেছেন, সৃজনশীল মানুষ অন্যান্য পেশার মানুষের তুলনায় বেশি মানসিক সমস্যায় ভোগেন।

একই বিষয়ে ১৯৮৭ সালে ন্যান্সি অ্যানড্রাসেন ৩০ জন লেখক এবং ৩০ জন অন্যান্য পেশার মানুষের ওপর একটি গবেষণা চলান। তিনি দেখেন, লেখকদের মধ্যে বাইপোলার ডিজ-অর্ডার তুলনামূলক বেশি। পনের বছর ধরে নেওয়া ৩০ জন লেখকের সাক্ষাৎকার অবেক্ষণ করে তিনি এ সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন। এখানেও রয়েছে ভিন্নমত। কারণ, ন্যান্সি শুধু সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতেই মানসিক সুস্থতার বিষয়টি তুলে এনেছিলেন। এ-ও সত্য, তিনি সাক্ষাৎকারের গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কেও তেমন কিছু স্পষ্ট করেননি।

ব্যাপারটা এমন কি, মানসিক অসুস্থতাই লেখকদের এই পেশা বেছে নিতে সাহায্য করছে? কিংবা সৃজনশীল মানুষ মানসিক অসুস্থতার কারণে সাধারণ পেশার প্রতি আকর্ষণবোধ করছেন না! আবার এমনও হতে পারে, মানসিক অসুস্থতাই পেশা নির্বাচনে প্রভাবকের কাজ করছে। এটা জানা বেশ কঠিন।

এখানে সৃজনশীল মানুষের মধ্যে মানসিক সমস্যার পক্ষে আরো দুটি সমীক্ষা উল্লেখ করা হলো। প্রথমটি ‘অ্যান আনকোয়াইট মাইন্ড’-এর লেখক কে রেডফিল্ড জিমসনের। তিনিও গবেষণার মাধ্যম হিসেবে সাক্ষাৎকারই বেছে নিয়েছিলেন। এতে গিনিপিগ হয়েছিল কবি, ঔপন্যাসিক, জীবনী লেখক এবং শিল্পীরা। ৪৭ জন মানুষের সঙ্গে তিনি কথা বলেন। অংশগ্রহনকারীদের মানসিক অসুস্থতা দেখে বিস্মিত হন। জিমসন জানান, সাক্ষাৎকার দেওয়া অধিকাংশ কবিই এক বা একাধিক বার মানসিক চিকিৎসা নিয়েছেন।

দ্বিতীয়টি আরনল্ড লুইংয়ের। তিনি হাজারের বেশি বিখ্যাত মানুষের জীবনী অনুসন্ধান করে গবেষণা চালান। লুইং দেখেন, বিভিন্ন পেশার মানুষের মধ্যে সমস্যার ধরন আলাদা। মোটকথা, সাধারণত বিখ্যাত মানুষেরা অন্যদের থেকে ভিন্ন হলেও তাদের সৃজনশীলতার বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায় না। এ গবেষণায় বিখ্যাত মানুষদের জীবনাচরণ পর্যবেক্ষণ করা হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু ফলাফল অনুমানের সঙ্গে মেলেনি।

 

আরো খানিকটা পেছনে যাওয়া যাক। ১৯০৪ সাল। হ্যাভলক ইলিস হাজারের বেশি মানুষের ওপর গবেষণা করেন। তিনি মানসিক অসুস্থতা ও সৃজনশীলতার মধ্যে কোনো সম্পর্ক খুঁজে পাননি। ১৯৪৯ সালে আরেক গবেষণায় ১৯ হাজার জার্মান শিল্পী ও বিজ্ঞানীর জীবনাচরণ পর্যালোচনা থেকে একই সিদ্ধান্ত আসে।

তাহলে কি করে বলি,  সৃজনশীল মানুষেরা মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে থাকেন? অনেক বিশেষজ্ঞই বলেন, মানসিক সমস্যা যেকোনো কিছুকে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখার রসদ জোগায়! এটা মানুষকে ব্যতিক্রম কোনো কিছু ভাবতে সাহায্য করলেও অসুখটা তাকে সাধারণ বা তার চেয়ে নিচু অবস্থানে নামিয়ে দিতে পারে। তারাই আবার বলেন, মানসিক সমস্যা ও সৃজনশীলতার মধ্যকার সম্পর্কটা বেশ জটিল।

এ সম্পর্কটি মেনে নিলে রোগটি আশঙ্কার কারণ হয়ে উঠবে। অনেকের ধারণা, অসুখটাই তাকে সৃজনশীল করে তুলছে। তারা ভাবেন, স্বাভাবিক হলেই তারা সৃষ্টিশীলতা হারাবেন। এক্ষেত্রে ওই মানুষগুলো মেধার চেয়ে তাদের অসুস্থতাকেই বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। এমন পরিস্থিতিতে মানসিক রোগীরা অন্য কোনো মেধার সন্ধান না পেলে আরো বেশি হতাশ হবেন। বাড়তি চাপের সৃষ্টি হবে। ভারসাম্যহীনতাও বাড়বে।

গবেষণা বলছে, সৃজনশীলতা ও মানসিক সমস্যার সম্পর্কের বিষয়টি অধিকাংশের কাছেই পরিষ্কার। ব্যাপারটা এমন যে, এটাই স্বাভাবিক! এটি সৃজনশীল মানুষের ইতিবাচক দিকটাই তুলে ধরছে। সাক্ষাৎকারের তথ্য বলছে, মানসিক সমস্যার নেতিবাচকতা নিয়ে সবাই সন্তুষ্ট। কিন্তু সত্যটা হলো, মানুষ আসলে মানসিক অসুস্থতার সঙ্গে সৃজনশীলতার সম্পর্ক খুঁজে আনন্দ পায়! এটা তাদের ভাবনার জগতকে চঞ্চল রাখে।

ঢাকা জার্নাল, এপ্রিল ১২, ২০১৬।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.