মনে পাপ নেই ।। সমরেশ মজুমদার

ফেব্রুয়ারি ২৯, ২০১৬

SAMARESসমরেশ মজুমদার ।।ভূত বা ভগবানে আমি বিশ্বাস করি কি করি না তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামাবে না, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যেহেতু বিশ্বাস করতেন তাই অনেকের ধন্দ থেকে যাচ্ছে । এই শতাব্দীর সবচেয়ে আধুনিক, বিজ্ঞানমনস্ক মানুষটি বেশ কিছুদিন প্ল্যানচেট করেছেন, তাতে মশগুল ছিলেন যখন, তখন আত্মা সম্পর্কে আমাদের আস্থা বাড়তেই পারে । অবশ্য ওই কিছুদিন কেটে গেলে রবীন্দ্রনাথ প্ল্যানচেট করার নেশা থেকে মুক্ত হয়েছিলেন এবং কখনোই আর এই কর্মটি করেননি । তাহলে কি পুত্র শোকে তাঁর সাময়িক মতিভ্রম হয়েছিল ?

জানি না। রবীন্দ্রনাথের মতিভ্রম হওয়ার কথা আমি যেমন কল্পনাও করতে পারি না, তেমনি প্ল্যানচেটের মাধ্যমে মৃত আত্মাদের সঙ্গে আলাপ করার ব্যাপারটাকে স্রেফ গাঁজাখুরি বলে এড়িয়ে দেওয়ার মতো তরল মানসিকতাও আমার নেই । হোমিয়োপ্যাথিতে আমার আজ পর্যন্ত কোনো কাজ হয়নি । শিশুদের অসুস্থতার সময় অনেকেই হোমিয়োপ্যাথি চিকিৎসা করিয়ে থাকেন । কাজ হলে ভালো কথা,না হলে ছুটে যান অ্যালোপ্যাথের কাছে । যে অসুস্থতা নিয়ে দীর্ঘকাল কাটানো যায় , মৃত্যু –সম্ভাবনা কম, তার চিকিৎসার জন্য হোমিয়োপ্যাথিরা আছেন বলে প্রচলিত ধারণা । কিন্তু আমার শরীরে প্রতিক্রিয়া হয়নি বলে আমি যদি বলি হোমিয়োপ্যাথিকে কোনো কাজ হয় না, তাহলে আমার মতো মূর্খ পৃথিবীতে নেই । সেই প্রাচীনকাল থেকে চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে চর্চা চলছে তা যদি অসার হত তাহলে বহু আগেই বন্ধ হয়ে যেত । হয়তো রোগ নির্ণয় করতে অথবা ঠিকঠাক ওষুধ প্রয়োগ করার ব্যাপারে গলদ থাকায় কিংবা সেই ওষুধ যথাযথ ভাবে প্রস্তুত না হওয়ায় গুণহীন হয়ে পড়তে পারে । রবীন্দ্রনাথ হোমিয়োপ্যাথিতে আস্থা রাখতেন ।

একটি ভ্রূণ মাতৃগর্ভে জন্ম নিয়ে ধীরে ধীরে পূর্ণাঙ্গ মানবশিশু হয়ে ভূমিষ্ঠ হল, হয়ে কাঁদল । পৃথিবীর সব মানুষের জন্ম একইভাবে হয়ে থাকে । ওই জন্মলগ্ন থেকে মৃত্যুক্ষণ পর্যন্ত সময়সীমা কারও ক্ষেত্রে স্বল্প , কারও মাঝারি , কেউ দীর্ঘকাল বেঁচে থাকেন । ধরা যাক, পাঁচটি শিশু , যারা একই সঙ্গে পাঁচটি মাতৃগর্ভ থেকে নির্গত হয়েছিল । তাদের জন্মকাল থেকে একসঙ্গে রেখে, একই খাদ্য, ওষুধ, যত্ন দিয়ে বড় করে, একই শিক্ষায় শিক্ষিত করা হল । দেখা গেল এদের মেধা, পছন্দ এবং আগ্রহ একই রকম হচ্ছে না । যদি গোটা জীবন একসঙ্গে রাখা যায় তাহলে দেখা যাবে কেউ পঞ্চাশ, কেউ ষাট ,কেউ আশিতে মারা গেল । এর কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তাত্ত্বিকরা বলবেন, পূর্বপুরুষের জিনের কল্যাণে এক-একজন এক এক রকম হয়েছে । যে শিশুর পিতা চিরকাল চাষ করেছে সে যদি দারুণ উপন্যাস লিখে ফেলে তাহলে তার পেছনে জিন কীভাবে কাজ করল তা নিয়ে আলোচনা হতেই পারে । পাঁচজনের শরীর একই খাবার,এক ওষুধ খেয়েও বিভিন্ন সময়ে মারা গেল । কেন ওদের আয়ুর এই পার্থক্য হল ? ওদের তো কাছাকাছি সময়ে চলে যাওয়া স্বাভাবিক ছিল ।

এসব প্রশ্নের উত্তর যাই হোক না কেন তা আমাদের পুরোপুরি সন্তুষ্ট করে না । তাই বিভ্রান্ত হই । মাঝে মাঝে মনে হয়, একটি মানুষ সারা জীবন বেঁচে থেকে সবাইকে আনন্দ দিলেন , বিপদে পাশে দাঁড়ালেন , তাঁর শরীরের মৃত্যুর পরে সবকিছু কেন শেষ হয়ে যাবে ? শরীরের মৃত্যু তো একটা প্রক্রিয়া মাত্র,কিন্তু এই পৃথিবীর মাটি ,বাতাসে যে মানুষটি দাপিয়ে বাস করেছেন সেখানে তাঁর কোনো অস্তিত্ব মিশে থাকবে না ? নরম মাটির ওপর কেউ হেঁটে গেলে তাঁর পায়ের ছাপ সেই মাটিতে আঁকা হয়ে যায় । মানুষটি লক্ষ মাইল দূরে চলে গেলেও সেই ছাপ পড়েই থাকে । তাহলে যে হাসিখুশি পরোপকারী মানুষটি মারা গেলেন তাঁর কোনো চিহ্ন পৃথিবীতে থাকবে না ,তা মেনে নিতে খুব অসুবিধে হয় ।

আমি সাধারণ মানুষের কথা বলছি । একজন লেখক,কবি চলে গেলে তাঁদের বই থেকে যায় । একজন চিত্রশিল্পী ছবি রেখে যান । একজন গায়কের সিডি বা ক্যাসেট বহুকাল ধরে বেজে যায় । একজন চিত্রাভিনেতার ফিল্ম থাকে ,একজন নাট্যশিল্পী বেঁচে থাকেন দর্শকদের স্মৃতিতে । কিন্তু একজন সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে তো এই সুযোগ নেই। তখন আমরা ভাবি তাঁদের আত্মাকে নিয়ে । ভেবে নিই সেই আত্মা মিশে আছেন আকাশে বাতাসে । যদি এই ভাবনাকে ভুল ভাবি তাহলে কেউ আঙুল তুলে বলতে পারেন, বাইবেল মিথ্যে কথা বলেনি । যিশুর মরদেহ কবরস্থ করার পরেও তাঁর রেজারেকশন হয়েছিল । তিনি কবর থেকে উঠে এসেছিলেন অসমাপ্ত কাজ শেষ করতে । এমন ঘটনা কখনোই সত্যি হতে পারে না জেনেও আমরা মেনে নিই । মেনে নিতে ভালো লাগে ।

ব্যাপারটাকে ভৌতিক গল্প বলে নস্যাৎ করতে একদম ইচ্ছে করে না ।

ভারতীয় পৌরাণিক কাহিনীগুলোতে দেবতা, দেবীদের ভিড় । সেখানে মৃত মানুষের আত্মার জায়গা প্রায় নেই বললেই হয় । সেই দেবতারা যেসব কাণ্ড করেছেন তাকে অলৌকিক বলা হয় । অর্থাৎ যা লোকালয়ের মানুষেরা করতে পারেন না তাই অলৌকিক । হনুমান সূর্যকে বগলে ধারণ করে রেখেছিল জেনে গাঁজাখুরি কাহিনি না বলে অলৌকিক কাহিনি বললে অনেক সুবিধে হয় । সৎ বীরকে সাহায্য করতে যেমন সমুদ্র ভাগ হয়ে রাস্তা করে দেয় অথবা কোনোরকম শিক্ষা ছাড়াই ভারত থেকে সিংহলে যাওয়ার জন্য রামচন্দ্র সেতু তৈরি করতে পারেন সমুদ্রের ওপরে – আমাদের গিলতে হয় ।

অর্থাৎ যা আমাদের প্রীত করে তা অবাস্তব হলেও আমরা তাতেই মজে থাকি । এই অবাস্তবতা আমরা কিরকম চোখ বন্ধ করে নেমে নিয়েছি তার অন্যতম প্রমাণ শ্রাদ্ধের মন্ত্র উচ্চারণ করার সময় বোঝা যায় । সংস্কৃত আমাদের ভাষা নয় । আমরা আমাদের এই ভূখণ্ডে আসিনি । অথচ আমাদের যাবতীয় ধর্মকর্ম সংস্কৃত ভাষায় পরিচালিত, যা নিরানব্বই ভাগ মানুষ বোঝেন না । পুরোহিত ঠিকঠাক উচ্চারণ করছেন কি না,না জেনেই মাথা নেড়ে অক্ষম আওড়াতে চেষ্টা করেন । শ্রাদ্ধের সময় , সংস্কৃতে বলা হয়েছে মৃত মানুষটি এখন প্রেত হয়ে চারপাশে ঘুরছেন , তিনি যাতে অনিষ্ট না করতে পারেন তাই কাক হয়ে এসে পিণ্ড খেয়ে স্বর্গে চলে যান । সেই মানুষটি পিতা বা মাতা হলে তাঁকে প্রেত ভাবার কী কারণ আছে ? প্রেত মানে তো দুষ্ট –আত্মা । পিতা বা মাতা দুষ্ট –আত্মা হয়ে সন্তানের ক্ষতি করবেন –এটা কোনো সুস্থ মানুষ বলতে পারেন ? কিন্তু বহু বছর ধরে বলা হচ্ছে । আমার বিশ্বাস , এইসব কথা মূলমন্ত্রে ছিল না । পরবর্তীকালে সংযোজিত হয়েছে । আমরা পবিত্র মনে তা উচ্চারণ করে যাচ্ছি । করে প্রীত আছি ।

অর্থাৎ শ্রাদ্ধ করার নামে আমরা আত্মার অস্তিত্ব মেনে নিচ্ছি এবং সেই আত্মাকে দুষ্ট –আত্মা বলতেও দ্বিধা করছি না । বোধহয় এখান থেকেই ভৌতিক গল্পের শুরু । মৃত্যুর পরে নাকি অনেকেই মৃত মানুষটিকে দেখতে পান, অনুভব করেন । সেটা করতে তাঁদের ভালো লাগে বলেই করেন । একটি মানুষের মৃত্যু হওয়ামাত্র তাঁর মন –হৃদয় ইত্যাদির কি হাল হল তা জানার কোনো উপায় নেই । তবু জাতিস্মরের কাহিনি আমরা বিশ্বাস করছি ।
সত্যজিৎ রায় ‘ সোনার কেল্লা’ লিখলেন । রবীন্দ্রনাথ লিখলেন ভৌতিক গল্প । কিন্তু সবাইকে ছাপিয়ে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় মৃত্যুর পরে আত্মাদের নিয়ে যে লেখা লিখলেন তা বাংলা সাহিত্যে ক্লাসিক হয়ে আছে । ‘দেবযান’ পড়তে পড়তে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে ,ওরা আত্মা নয় ,জীবিত চরিত্র । মৃত শরীর থেকে বেরিয়ে উঠোনের গাছের ডালে বসে আত্মা অবাক হয়ে দেখছে তার শরীরকে কেন্দ্র করে কান্নাকাটি চলছে । প্রায় সত্তর বছর আগে লেখা এই কাহিনীর একাংশের প্রতিফলন দেখলাম ইংরেজি ‘ঘোস্ট ‘ ছবিতে, যা তৈরি হয়েছে বছর দশেক আগে । সেই ছবিতে আত্মা খুব বেচারা, ইচ্ছে করলেও একটা আলপিন নাড়াতে পারে না, স্ত্রীর সঙ্গে বন্ধু প্রেম করতে চাইলে সে ঠাস করে চড় মারতে চায় কিন্তু বন্ধু টের পায় না । ছবিতে একটা সূক্ষ্ম ব্যঙ্গ এবং অসহায়তা থাকলেও ইউরোপ , আমেরিকায় একটি ভূতরাত্রি পালিত হয় । বাড়ির সামনে বিশাল কুমড়ো ঝুলিয়ে ভূত তাড়ানো হয় । অর্থাৎ এই অজানা জগৎ নিয়ে একটু মশগুল থাকতে পৃথিবীর সব মানুষই পছন্দ করে।

কথিত আছে, রবীন্দ্রনাথের প্ল্যানচেটে আত্মারা আসতেন । রবীন্দ্রনাথ মৃত সন্তান শমীকে ভালোবাসতেন খুব,তাকে আনতে চাইতেন প্ল্যানচেটে । শোনা যায় সেইসব আত্মারা এসে পেন্সিলে কাগজের ওপর আঁকাবাঁকা অক্ষরে কিছু লিখে যান মিডিয়ামের মাধ্যমে । এক্ষেত্রে মানুষের উদারতাও লক্ষণীয় । বেশ কিছুদিন আগে মারা গিয়েছেন, এমন আত্মাকে ডাকতে ডাকতে শেষ পর্যন্ত তিনি আসেন এবং লিখে যান ,তিনি অনেক উচ্চস্তরে চলে গেছেন, সেখান থেকে আসতে খুব কষ্ট হয়, তাকে যেন আর কষ্ট দেওয়া না হয় । দেখে গেছে, কোন প্ল্যানচেট- কর্মই দীর্ঘস্থায়ী হয় না। হতাশা প্রবল হয়,যখন কর্মটি অন্তঃসারশূন্য প্রমাণিত হয় ।

এসব জানা সত্ত্বেও যদি ভেবে নিই আত্মা আছে ,তাহলে স্বীকার করতে আমি বাধ্য যে তারা খুব একা হয়ে আছে । আত্মায় আত্মায় বন্ধুত্ব তৈরি হয় না । তাছাড়া মারা গেলেই যে ওপরে যেতে হবে ,তার স্থিরতা কোথায় ? মরার পরে তো নীচেও যেতে হতে পারে । নীচে, মাটির নীচে গিয়ে একা একা আত্মারা কতদিন বাস করতে পারে ?

এই অবধি শোনার পর একটি সাড়ে তিন বছরের শিশু পণ্ডিতের মতো মাথা নেড়ে বলল, — এইবারে বুঝলাম ।

জিজ্ঞেস করলাম, — কী বুঝলে ?

–মানুষ মরে গিয়ে মাটিতেই চলে যায় বলে কিছুদিন পরে গাছ হয়ে ওপরে উঠে আসে ।

শিশু হাসল ।

মনে মনে বললাম – তাই যেন হয় ; পৃথিবীটা গাছ –গাছালিতে ভরে যাক ।

 

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.