জন্মদিনে ড. জাফর ইকবালকে শুভেচ্ছা

ডিসেম্বর ২৩, ২০১৫

23 বড় ভাই হুমায়ুন আহমেদ জীবিত থাকলে হয়তো বা কথায় রস সৃষ্টির জন্য বয়সের হিসেবটা এভাবেই কষে দেখাতেন। কারণ মজা করে কথা বলতেই যে পছন্দ করতেন তিনি। ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল জনপ্রিয় এই লেখকের ছোট ভাই। অবশ্য জাফর ইকবালও একজন জনপ্রিয় লেখক। কতোটা জনপ্রিয় তা বোঝার জন্য এখানে একটা রেফারেন্স দিচ্ছি। রেফারেন্সটা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রাজীব মীরের।

তিনি লেখেন অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালকে নিয়ে তখনও হৈ চৈ শুরু হয়নি। হুমায়ূন আহমেদ ঝড়ো জনপ্রিয়, উপন্যাসের মতোই মনের বিন্যাসে তিনি ঘোরেন ফেরেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে পড়ার সময়ে ড. সেলিম আহমেদ নামে একজন অসাধারণ ব্যক্তি আমাদের প্রথম বর্ষের টিউটোরিয়াল শিক্ষক ছিলেন। তিনি আমাকে আনন্দে থাকতেও শিখিয়েছিলেন। বলেছিলেন ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ আর কতো! তার চেয়ে জাফর ইকবাল পড়ো। দীপু নম্বর টু বা সায়েন্স ফিকশনের অন্য হাজার রকম গুরুত্ব আছে। কাউকে ছোট করার জন্য নয়, জাফর ইকবালের ভিন্নতা ও অনন্যতাকে নির্দেশ করার জন্য প্রসঙ্গটা টানলাম।

ব্যক্তি জাফর ইকবাল আমেরিকায় থাকতে পারতেন, দেশের মায়ায়-ভালোবাসায় দেশে পড়ে আছেন, সে গল্প পুরোনো। তুমুল জনপ্রিয় গণিত অলিম্পিয়াড জাফর স্যার ও কায়কোবাদ স্যারের প্রত্যক্ষ অবদানে ভরপুর, বাচ্চাদের জন্য স্যারের লেখা যত আছে, লেখার মন আছে তারচে’ হাজারগুণ বেশি- এটা সহজেই অনুমেয়। মোদ্দাকথা, স্যার লেখক হিসেবে নাম কুড়িয়েছেন।

স্যারের লেখার হাত পাঠকের জন্য- সহজ, সরল, প্রাণবন্ত। যা জানেন, তা যতটা লেখেন, তারচে’ যা বোঝেন, সাহসী মনে তারও বেশি লেখেন। শাহবাগ আন্দোলন বিষয়ে সবাই যখন দ্বিধায় ভুগেছেন, পিছপা হয়েছেন- স্যার সামনেই ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকে তার লেখায় বারবার পেয়েছে নতুন প্রজন্ম, দিক ভুল হয়নি।

ড. জাফর ইকবালের মধ্যে দুটো জিনিস প্রবল। এক. দেশপ্রেম দুই. শিশুর প্রতি ভালবাসা। যারা জাফর ইকবালকে একটু নিবিড় করে দেখার মওকা পেয়েছেন তারা একবাক্যে কথাটা স্বীকার করবেন। শিশুদের প্রতি খুবই আশাবাদি তিনি। সম্প্রতি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একটি শিশু কিশোর সংগঠনের অনুষ্ঠানে দেশ বরেণ্য এই শিক্ষাবিদ বলেন, ‘ আমি কোনো অনুষ্ঠানে গিয়ে ছোট ছোট বাচ্চাদের দিতে তাকিয়ে থাকি। কারণ তাদেরকে দেখে আমি চার্জ হই। শিশুরা মন দিয়ে লেখাপড়া করলে দেশকে ঠেকানো যাবে না। ২০৫০ সালের আগেই দেশ ইউরোপ-আমেরিকার মতো হবে।

ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের জন্ম ভাষা আন্দোলনের বছরে অর্থাৎ, সালের ২৩ ডিসেম্বর সিলেটে জন্ম তার। আর এজন্যই সিলেটের প্রতি আলাদা একটা টান আছে তার। তার গর্ব এজন্য যে, বাবা পুলিশ কর্মকর্তা ফয়জুর রহমান আহমেদ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ। মা আয়েশা আখতার খাতুন। পরে আয়েশা ফয়েজ নামে পরিচিত। বড় ভাই কথাসহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদকে কে না জানে। আর ছোট ভাই আহসান হাবীবও খ্যাতনামা রম্য ম্যাগাজিন ‘উন্মাদ’-এর সম্পাদক, লেখক ও কার্টুনিস্ট। আর স্ত্রী ড. ইয়াসমিন হক শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষকতা করছেন।

ড. জাফর ইকবালের পড়াশোনা মাধ্যমিক পরীক্ষা দেন ১৯৬৮ সালে, বগুড়া জিলা স্কুল থেকে। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন ঢাকা কলেজ থেকে ১৯৭০ সালে। পদার্থ বিজ্ঞানে স্নাতক সম্মান করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, ১৯৭৩ সালে। আর তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, ১৯৭৪ সালে। তার পিএইচ-ডি যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটন থেকে, ১৯৮২ সালে। Parity violation in Hydrogen Atom বিষয়ে পিএইচ-ডি করার পর তিনি ১৯৮২ থেকে ১৯৮৮ পর্যন্ত ক্যালিফোর্নিয়া ইনিস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে (ক্যালটেক নামে বিখ্যাত) সাফল্যের সঙ্গে ডক্টরেট-উত্তর গবেষণা সম্পন্ন করেন।

কর্মজীবন শুরু করেন ১৯৮৮ তে। সে সময় তিনি বিখ্যাত বেল কমিউনিকেশনস রিসার্চ (বেলকোর) এ গবেষক হিসেবে যোগদান করেন এবং ১৯৯৪ পর্যন্ত সেখানেই কাজ করেন। ওই বছরেই তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে যোগদান করেন।

 

 

লেখালেখি তার বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকেই। একাধারে লিখে গেছেন উপন্যাস, ছোট গল্প, কিশোর উপন্যাস, কিশোর গল্প, শিশুতোষ গল্প, ভৌতিক সাহিত্য, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি, ভ্রমণকাহিনি,মুক্তিযুদ্ধ এবং বিজ্ঞান ও গণিত বিষয়ক লেখা। তবে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি ও কিশোর উপন্যাগুলোর জন্য তিনি নবীন প্রজন্মের কাছে অসাধারণ জনপ্রিয় একজন লেখক।

পাশাপাশি তাঁর লেখা কিছু নাটক বিভিন্ন চ্যানেলে প্রচারিত হয়েছে। তার লেখা গল্প ও উপন্যাস আবার রেডিও ও টিভির নাটকে এবং চলচ্চিত্রে ব্যবহার হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে পত্রপত্রিকায় নিয়মিত কলাম লিখেন তিনি।

ব্যক্তিগত জীবনেও তিনি সবসময় নানা সাংগঠনিক কার্যকলাপে তরুণদের উৎসাহ ও সহযোগিতা করেন। লিখে যান অন্যায়ের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড গড়ে তোলার পিছনে রয়েছে তার অসামান্য অবদান। আর ২০০৪ সালে প্রাপ্ত বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। আসলে ড. জাফর ইকবাল এমন একজন কপটতাহীন ব্যক্তিত্ব যাকে চোখ বুজে ভালবাসা যায়।

 

লেখক হিসেবে তাকে বাংলাদেশে সায়েন্স ফিকশন জনপ্রিয়করণের পথিকৃৎ বলা যায়। পিতার চাকরির সুবাদে ছেলেবেলার অনেকটাই কেটেছে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায়। বাবার লেখালেখির চর্চা ও পরিবারের সাহিত্যমনস্ক আবহাওয়ার কারণে তিনি খুব অল্প বয়সেই লিখতে শুরু করেন। সাত বছর বয়সে প্রথম সায়েন্স ফিকশন লিখেন তিনি। সাপ্তাহিক বিচিত্রায় জাফর ইকবাল বিশ্ববিদ্যালযয়ের ছাত্র থাকাকালীন প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল সায়েন্স-ফিকশন গল্প ‘কপোট্রনিক ভালোবাসা’ । সুদূর আমেরিকাতে বসে তিনি বেশ কয়েকটি সায়েন্স-ফিকশান রচনা করেন। দেশে ফিরে এসেও তিনি নিয়মিত বিজ্ঞান-কল্পকাহিনী লিখে যাচ্ছেন, প্রতি বইমেলাতে তার নতুন সায়েন্স ফিকশান কেনার জন্যে পাঠকেরা ভিড় জমায়। তিনি কিশোর উপন্যাসের লেখক হিসেবেও অত্যন্ত সফল। এই শাখাতেই তার প্রতিভা সর্বোচ্চ শিখর ছুঁয়েছে। তার লেখা অনেকগুলো কিশোর উপন্যাস বাংলা কিশোর-সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। বাংলাদেশের কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে লেখক হিসেবে জনপ্রিয়তার শীর্ষে। বড় ছেলে নাবিল ইকবাল যুক্তরাষ্ট্রের কলোনেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞান ও গণিতে স্নাতক সম্পন্ন করে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনলজিতে পদার্থবিজ্ঞানে পিএইচডি করছেন এবং কন্যা ইয়েশিম ইকবাল কলোনেল বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক সম্পন্ন করে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে মনোবিজ্ঞানে পিএইচডি করছেন।

 

 

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.