সংখ্যালঘুদের দুঃখকষ্ট

ডিসেম্বর ১২, ২০১৫

03বাংলাদেশের যেসব এলাকা রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে ঝঞ্ঝাপূর্ণ, তার মধ্যে দিনাজপুর পড়ে না। উত্তর-পশ্চিমের সীমান্তঘেঁষা এই জেলায় সামাজিক সংহতি ও রাজনৈতিক স্থিতি তুলনামূলক বেশি। সহকর্মী মশিউল আলম সম্প্রতি দিনাজপুরে গিয়ে দেখেছেন, সেখানে ঢাকার রাজনৈতিক উত্তাপ একেবারে নেই। এর আগে আব্দুল কাইয়ুম ও মিজানুর রহমান খানও একই অভিজ্ঞতা পেয়ে প্রীত বোধ করেছেন। কিন্তু সেই দিনাজপুরে মাত্র ২২ দিনের ব্যবধানে ঘটল চার-চারটি সন্ত্রাসী হামলা, যার লক্ষ্যবস্তু হয়েছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উপাসনালয় ও মানুষ। গত ১৮ নভেম্বর প্রথম হামলার ঘটনা ঘটে শহরের মির্জাপুরে গির্জার ধর্মযাজক ও চিকিৎসক পিয়েরো পিচমের ওপর। এরপর ৩০ নভেম্বর চিরিরবন্দর উপজেলার রানীরবন্দরে গুলি করে হত্যার চেষ্টা করা হয় হোমিও চিকিৎসক বীরেন্দ্র রায়কে। ৪ ডিসেম্বর একই উপজেলায় কান্তজিউ মন্দির প্রাঙ্গণে রাসমেলায় বোমা হামলায় ছয়জন আহত হন। আর গত বৃহস্পতিবার রাত পৌনে আটটায় দিনাজপুরের কাহারোল উপজেলায় আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘের (ইস্কন) একটি মন্দিরে দুর্বৃত্তরা গুলি চালিয়ে দুজনকে আহত করে। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, পাঁচটি মোটরসাইকেলযোগে ১৪-১৫ জন যুবক এসে প্রথমে মন্দিরের কাছে চারটি ককটেল নিক্ষেপ করে, এরপর তারা ছয়টি গুলি ছুড়ে পালিয়ে যায়।
এসব অঘটনকে আমরা কীভাবে দেখব? এগুলো কি নিছক আইনশৃঙ্খলাজনিত সমস্যা? মোটেই নয়। বেছে বেছে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা চালানো হচ্ছে। অথচ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সরকার হামলাকারীকে খুঁজেই পাচ্ছে না। অপরাধীরা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাহলে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় কীভাবে ভরসা পাবে?

২.
বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ যখন তাদের দাবিদাওয়া নিয়ে কথা বলে, যখন তারা সম-অধিকার ও সমমর্যাদার দাবিটি সামনে নিয়ে আসে, তখন সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের অনেকেই সংগঠনটির সাম্প্রদায়িক পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। যেন সংখ্যালঘুদের দাবিদাওয়া তুলে তারা মহা অন্যায় করে ফেলেছে। কিন্তু এই বিজ্ঞবানেরা একবারও প্রশ্ন করেন না যে কেন বাংলাদেশে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ নামে একটি সংগঠনের জন্ম হলো? তিনটি প্রধান সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের নিয়ে তখনই সংগঠনটির উদ্ভব হলো যখন স্বৈরশাসক এরশাদ রাষ্ট্রধর্ম আইনটি দেশবাসীর ওপর চাপিয়ে দিলেন। সে সময়ে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের মধ্য থেকে প্রবল প্রতিরোধ উঠলে হয়তো সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে এভাবে ধর্মীয় পরিচয় নিয়ে মাঠে নামতে হতো না। প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রীয় সাম্প্রদায়িকতা রুখতেই হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের জন্ম। যখন সেই সাম্প্রদায়িকতা থাকবে না, তখন এ ধরনের সংগঠনেরও প্রয়োজন হবে না।
আমরা মনে করি, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ করে কোনো অন্যায় করেনি, বরং সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের অক্ষমতা ও দ্বিচারিতাই স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। আমরা এও মনে করতে পারি যে প্রথম সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান মুক্তিযোদ্ধা হয়েও অবলীলায় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশের মৌলনীতি ধর্মনিরপেক্ষতা ছেঁটে দিয়েছিলেন। আর দ্বিতীয় সামরিক শাসন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ আরেক ধাপ এগিয়ে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের কার্যত দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করেছেন।
নব্বইয়ের গণ-অান্দোলনের মাধ্যমে আমরা স্বৈরশাসক এরশাদকে হটাতে পারলেও সংবিধানে তাঁর সৃষ্ট অনেক অপকীর্তির মতো সংবিধানের এই ক্ষতটিও অপসারণ করতে পারিনি। অষ্টম সংশোধনীতে দুটি বিষয় ছিল রাষ্ট্রধর্ম ও ঢাকার বাইরে হাইকোর্টের বেঞ্চ গঠন। দ্বিতীয়টির সঙ্গে যেহেতু আইনজীবীদের পেশাগত স্বার্থ জড়িত ছিল, সেহেতু তাঁরা আন্দোলন করেই এই বিধান রহিত করিয়েছেন। কিন্তু অসহায় সংখ্যালঘুদের স্বার্থ দেখার কেউ নেই। ১৯৯১ সালে জামায়াতের সহায়তায় ক্ষমতায় আসা বিএনপি রাষ্ট্রধর্ম বাদ দেবে না, জানি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ তিন-তিনবার ক্ষমতায় এসেও সেই কাজটি কেন করল না, সেটি বড় প্রশ্ন। বাংলাদেশের রাজনীতি এখন শুধুই ভোটের অঙ্ক। সংখ্যালঘুদের ভোট সাতচল্লিশের মতো ২৯ শতাংশ কিংবা সত্তরের মতো ২০ শতাংশ হলে চরম প্রতিক্রিয়াশীল দলটিও তাদের পাশে দাঁড়াত। এখন একদল মনে করে, ‘সংখ্যালঘুরা কোথায় যাবে, কিছু না করলেও আমরা তাদের ভোট পাব।’ আরেক দল ভাবে, ‘তারা আমাদের ভোট দেবে না, আমরা কেন তাদের জন্য কাজ করব।’ ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ বলেছিল, সংবিধান পরিবর্তন করার মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা তাদের নেই, তাই চাইলেও তারা রাষ্ট্রধর্ম পরিবর্তন করতে পারছে না। কিন্তু ২০০৮ সালে তো তাদের সেই যুক্তি টেকে না। তখন থেকেই সংসদে আওয়ামী লীগ তিন-চতুর্থাংশের বেশি আসন নিয়ে আছে। এমনকি ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে যখন সংবিধানের চার মূল নীতি পুনঃস্থাপন করা হলো, তখনো তারা রাষ্ট্রধর্ম যথারীতি বহাল রাখল। ধর্মনিরপেক্ষতা ও রাষ্ট্রধর্মের সহাবস্থান! পৃথিবীর আর কোনো দেশে এই অদ্ভুত আইন আছে বলে মনে হয় না।

৩.
৪ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ আয়োজিত মহাসমাবেশ থেকে যে সাত দফা দাবি পেশ করা হয়েছে, তাতে জাতীয় সংসদসহ রাষ্ট্রের সর্বস্তরে সংখ্যালঘু ও নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর যথাযথ প্রতিনিধিত্ব দাবি করা হয়েছে। একই সঙ্গে সাংবিধানিক বৈষম্য বিলোপ, সম-অধিকার ও সমমর্যাদার পাশাপাশি সংখ্যালঘুদের আইনি সুরক্ষার ওপর জোর দিয়েছে তারা। ঐক্য পরিষদের এই দাবিনামার মধ্যে অনেকে সাম্প্রদায়িকতার গন্ধ খুঁজতে পারেন, কিন্তু সংখ্যালঘুদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য এর বিকল্প আছে বলে মনে করি না। জনসংখ্যার হিসাবমতে তারা যতটা প্রান্তিক, তার চেয়ে অনেক বেশি প্রান্তিক রাজনীতিতে। বর্তমানে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুর হার প্রায় ১০ শতাংশ হলেও জাতীয় সংসদসহ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে তাদের প্রতিনিধিত্ব আরও অনেক কম। বাংলাদেশে এই প্রথম সংখ্যালঘু সম্প্রদায় থেকে একজন প্রধান বিচারপতি হয়েছেন (বিচারপতি এস কে সিনহা)। গত ৪৪ বছরে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় থেকে কেউ রাষ্ট্রপতি, কেউ স্পিকার, কেউ প্রধান নির্বাচন কমিশনার, কেউ পিএসসি বা ইউজিসির চেয়ারম্যান হননি। কিন্তু ভারতে অন্তত পাঁচজন রাষ্ট্রপতি হয়েছেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায় থেকে, প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও প্রধান বিচারপতি হয়েছেন, সশস্ত্র বাহিনীরও শীর্ষ পদে গিয়েছেন।
বাংলাদেশে বর্তমানে ৩০০ সাধারণ আসনের সংসদে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধি মাত্র ১৭ জন, সংরক্ষিত ৫০টি নারী আসনে মাত্র একজন। বিএনপি-জামায়াত আমলে এই সংখ্যা আরও কম ছিল। ২০০৯ সালে গঠিত শেখ হাসিনার সরকারে তিনজন পূর্ণ মন্ত্রী থাকলেও এখন মাত্র তিনজন প্রতিমন্ত্রী রয়েছেন, পূর্ণ মন্ত্রী একজনও নেই। ঐক্য পরিষদ জাতীয় সংসদে সত্তরের জনসংখ্যাকে মানদণ্ড ধরে ৬০টি আসন সংরক্ষিত রাখার দাবি জানিয়েছে, যারা মুসলিম লীগের মতো পৃথক নয়, যুক্ত নির্বাচনের মাধ্যমে আসবেন। নারীনেত্রীরাও সংরক্ষিত আসন না রেখে সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে ১০০ আসন দাবি করছেন। প্রতিটি নির্বাচনের আগে নারী ও সংখ্যালঘু আসনগুলো নির্ধারিত থাকবে, যেখানে কেবল তারাই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। পরবর্তী নির্বাচনে আসনগুলো পরিবর্তন হবে। তবে এটি করতে হলে রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংবিধান সংশোধন করতে হবে।
ঐক্য পরিষদ একই সঙ্গে স্থানীয় সরকার সংস্থা ও রাজনৈতিক দলে ২০ শতাংশ হারে প্রতিনিধিত্ব এবং একই হারে সরকারি চাকরি, পুলিশ, পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা বাহিনীতে পদায়নের দাবি করেছে। এই সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে, কিন্তু তাদের প্রতিনিধিত্বের ন্যায্যতা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই। সরকারি পরিসংখ্যানমতে, ১৯৪৭ সালে এ দেশে সংখ্যালঘুর হার ছিল ২৯ দশমিক ৭ শতাংশ, সেটি ১৯৭০ সালে এসে দাঁড়ায় ২০ শতাংশ, ২০১১ সালে এসে পৌঁছেছে ৯ দশমিক ৭ শতাংশে। আর পার্বত্য চট্টগ্রামে দেশভাগের সময় পাহাড়ি জনগোষ্ঠী ছিল যেখানে ৯৮ দশমিক ৬ শতাংশ, সেখানে এখন ৪৮ শতাংশ। অর্থাৎ তারাই সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে, এটিও দুই সামরিক শাসকের কৃতিত্ব।
তবে ঐক্য পরিষদ স্বীকার করেছে যে শেখ হাসিনার শাসনামলে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন, হিন্দু বিবাহ নিবন্ধন আইন এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সই হওয়া সম-অধিকার প্রতিষ্ঠার পথে একধাপ অগ্রগতি। সরকারি প্রশাসনে ও পুলিশ বিভাগে সংখ্যালঘুদের বর্তমান পদায়নেও তারা সন্তুষ্ট। কিন্তু পরিষদের অভিযোগ বিজিবি বা প্রতিরক্ষা বাহিনীতে তাদের প্রতিনিধিত্ব ১ শতাংশের কম। সেখানেও অংশীদারত্ব থাকা প্রয়োজন। অন্যদিকে তারা রাষ্ট্রীয় অন্যতম মূলনীতি ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কিত সংবিধানের ১২ নম্বর অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ২ক অনুচ্ছেদের বিলোপ করে রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষ নীতি পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়েছে, তাও অবিলম্বে কার্যকর করা প্রয়োজন।
এ ছাড়া ঐক্য পরিষদ ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর সাংবিধানিক রক্ষাকবচ-সংবলিত অনুচ্ছেদ সংযোজন করা, সব ধর্ম-সম্প্রদায়ের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি রাষ্ট্রীয়ভাবে সংরক্ষণ, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন, সমতলে জাতিগত সংখ্যালঘুদের ভূমি সমস্যার সমাধান, হিন্দু বিবাহ আইন বাস্তবায়ন, অর্পিত সম্পত্তি আইন বাস্তবায়ন, দেবোত্তর সম্পত্তি আইন প্রণয়ন, অধিকতর অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর কল্যাণে বিশেষ আইন প্রণয়নের যে দাবি করেছে, তা-ও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার দাবি রাখে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ২০০১ সালের নির্বাচনের পর সংঘটিত সাম্প্রদায়িক সহিংসতার জন্য বিএনপি-জামায়াতকে দায়ী করলেও যারা সেই সহিংসতা ঘটিয়েছে, তাদের কাউকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করায়নি বা করাতে পারেনি। এ ব্যাপারে গঠিত সাহাবউদ্দিন কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নেরও কোনো উদ্যোগ নেয়নি সরকার। অতীতের সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিচার হয়নি বলেই এখনো সংখ্যালঘুদের বাড়িতে, উপাসনালয়ে, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা ও জবরদখলের ঘটনা ঘটছে। সংখ্যালঘুদের মনে যে ভয় ও শঙ্কা রয়েছে, তা দূর করতে চাই অতীতের সহিংসতার বিচার এবং বর্তমানে যাতে তার পুনরাবৃত্তি না ঘটে তার নিশ্চয়তা।
কোনো দল বা ধর্মের মানুষের নয়, ধর্ম-বর্ণ-জাতিসত্তানির্বিশেষে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি সবার হোক।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabhassan55@gmail.com

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.