‘সমস্যা মাটিতে, আকাশে নয়’

ডিসেম্বর ৫, ২০১৫

15ইসরায়েল এবং পশ্চিমা নীতির সমালোচনাকারী হিসেবে মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ বেশ সরব কণ্ঠস্বর। মধ্যপ্রাচ্য নিয়ন্ত্রনে পশ্চিমা নীতির সরাসরি সমালোচনা করে ইতোমধ্যেই তিনি নিন্দিত এবং নন্দিত দুটিই হয়েছেন। সর্বশেষ মন্তব্যে তিনি বলেছিলেন যে, পশ্চিমা দেশগুলো আইএসআইএস অঞ্চলে যত বোমা ফেলবে ততই পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাবে। সম্প্রতি সিরিয়ার ঘটনাবলী নিয়ে কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আলজাজিরার সঙ্গে কথা হয় মাহাথির মোহাম্মদের। এমনিতেই প্রচলিত কোনো মত পোষণ না করায় বিশ্বব্যাপী মাহাথির মোহাম্মদের সুনাম আছে। ২২ বছর মালয়েশিয়ার ক্ষমতায় থাকার পরেও এই ৯০ বছর বয়সে এসেও তার সেই ভিন্নধর্মী মতামতের ধার একটুও কমেনি, বরংচ তা আরও বেশি লক্ষ্যভেদী হয়েছে।সাক্ষাতকারটি হুবহু অনুবাদাকারে তুলে ধরা হলো।

গত মাসের প্যারিস হামলাকে কেন্দ্র করে পশ্চিমা দেশগুলো সিরিয়ায় আইএসআইএল নিধনে বিমানহামলা চালাচ্ছে। এই সিদ্ধাটিকে আপনি কিভাবে দেখছেন?
মাহাথির: এরফলে পুরো পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকেই যাবে, কারণ অনেক নিরীহ আরব হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছেন। তারা আইএসআইএল’র প্রতি সহমর্মিতা ছাড়া আর কিছুই করতে পারছে না। একই সময়ে আইএসআইএল অথবা অন্যান্য দলগুলো পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ দিকে নিয়ে যাচ্ছে। হতাশ এবং শত্রুপক্ষকে কাবু করতে না পেরে তারা এখন যা ইচ্ছে তাই করতে পারে। আর তারা যা করছে তা আমাদের কাছে সন্ত্রাসবাদ হিসেবে উপস্থাপিত হচ্ছে। কিন্তু আমার কাছে বিমানহামলা করে মানুষ হত্যাও সন্ত্রাসবাদ। যারা বোমার আঘাতে মারা যাচ্ছেন, তারাও সন্ত্রাসবাদেরই শিকার।

আপনি কি বৃহত যুদ্ধের ব্যাপারে শঙ্কিত?
মাহাথির: এটা ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। আমি সবসময়ই বলি যখন প্যালেস্টাইনের ভূমি অধিগ্রহন করা হলো এবং ইহুদিদের ইসরায়েল রাষ্ট্র বানাতে দেয়া হলো তখন থেকেই এর সূত্রপাত। পরবর্তী সময়ে ইহুদিরা প্যালেস্টাইনের প্রায় পুরো অংশই দখল করে নেয়। সেখানে তারা বসতি, রাস্তা নির্মান থেকে সাধারণ মানুষের জীবনযাপনের উপরও নিয়ন্ত্রন আরোপ করতে শুরু করে। প্রকৃতপক্ষে, আরব দেশগুলো ওই ভূমি অধিগ্রহন করতে চেয়েছিল কিন্তু বারবারই তারা সেটায় ব্যর্থ হয়েছে কারণ ইউরোপ এবং আমেরিকা ইসরায়েলকে সমর্থন করে যাচ্ছে। একই সঙ্গে ইসরায়েল যতগুলো আন্তর্জাতিক অপরাধ ঘটিয়েছে তার সবগুলোতেই পশ্চিমাদের সায় আছে। এটা খুবই ভুল।

ইউরোপীয় এবং আমেরিকানদের উচিত দুই পক্ষের কথা ভালো করে শোনা। আমরা কখনোই একপক্ষকে ক্রমাগত ভুল বলতে পারি না। ইসরায়েল অবৈধভাবে অবরোধ জারি করেছে এবং সমুদ্রে জাহাজ প্রবেশ বন্ধ করে দিয়েছে, আর এসবই পশ্চিমাদের বন্ধ চোখের সামনেই হয়েছে। অথচ তারাই আবার সন্ত্রাসবাদ নিয়ে কথা বলে। ইসরায়েল নিজেও সন্ত্রাসবাদ চায় না। যদিও তারা ওটা দিয়েই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রন করে। আপনি যদি একজন ইসরায়েলিকে হত্যা করে, তারা আপনাদের দশজনকে হত্যা করবে। তাদের দশজনকে হত্যা করা হলে, তারা একশ জনকে হত্যা করবে। ঠিক এটাই করছে ইসরায়েল। এই গোটা বিশ্ব বিষয়টি জানে এবং সহ্যও করছে।

কিন্তু আইএসআইএল’র উত্থান ইসরায়েল সৃষ্টির চেয়েও অধিক চিন্তার নয় কি?
মাহাথির: আমি মনে করি, এটা অনেক বড় ব্যাপার, কিন্তু এটা আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে। গোরিলা যুদ্ধক্ষেত্রে এরকম সাধারণ যুদ্ধ কৌশল দিয়ে কাজ হবে না, আকাশ থেকে বোমা ফেলে যুদ্ধে জেতা যাবে না। মালয়েশিয়াতে আমাদের অভিজ্ঞতা হয়েছে। আমাদের এখানে যখন গেরিলারা ছিল, তখন আমরা জনগণের হৃদয় জয় করার চেষ্টা করেছি যাতে তারা গেরিলাদের সমর্থন না দেয়। এভাবেই আমরা সফল হয়েছিলাম। আমরা আরবদের সমস্যা সমাধান করতে বসিনি। আমাদের জন্য হতাশার যে আমাদের পক্ষে কিছু করা সম্ভব হচ্ছে না।

পশ্চিমা রাজনীতিবিদেরা কি তাহলে অতীতের ভুলই আবার করছে?
মাহাথির: হ্যা। আপনি যদি এখানে আইএসআইএল’কে হত্যা করেন, তাহলে অন্যত্র আইএসআইএল মাথা তুলে দাড়াবে। আপনিই যুদ্ধটিকে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। আমাদের মালয়েশিয়াতেও আইএসআইএল’র প্রতি সহমর্মি রয়েছে। তারা উগ্রপন্থী হয়ে যাবে এবং তারা যা ইচ্ছে তাই করতে পারবে। এটা আমাদের সংস্কৃতি নয় এবং এটা দেখে আমরা সত্যিই ব্যথিত যে অনেক মালয়েশিয়ই তাদের পরিবার নিয়ে সেখানে যাচ্ছেন। এমন একটা কর্মকাণ্ডে তারা অংশগ্রহন করতে যাচ্ছেন যা ইসলাম বর্হিভূত। এটা ইসলামের সকল শিক্ষার বিপরীত।

কোন নীতি নেয়া উচিত বলে মনে করেন?
মাহাথির: প্রতিশোধ- তুমি আমার মানুষ হত্যা করেছ, আমি তোমার মানুষ হত্যা করবো- এই চিন্তা কাজ করবে না। এই মানুষগুলো কেন এই কাজ করছে তার উৎস খুঁজে বের করতে হবে। আধুনিক সন্ত্রাসবাদ সম্পর্কে আমরা জেনেছি। আজ তারা টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে সন্ত্রাসবাদ নিয়ে হাজির হয়েছে। এটা তাদের নতুন অস্ত্র, এবং এই অস্ত্র দেখে বিশ্ববাসী আতঙ্কিত। মুসলিম দেশগুলো আতঙ্কগ্রস্ত। তারা শুধু সৈন্যদেরই হত্যা করছে না, তারা যে কাউকে হত্যা করছে। গোটা বিশ্ববাসীর সামনে তারা নিরাপরাধ মানুষগুলোকে জবাই করে হত্যা করছে।

এই সংঘর্ষ আরও গভীর হলে মানবিক বিপর্যয় কেমন হতে পারে?
মাহাথির: আমার মনে হয় এই পরিস্থিতিতে সকলের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়া দরকার। এই শরণার্থীদের অনেক দেশের মাঝে বিতরন করে দেয়া হয় তাহলে কোনো একটি দেশের উপর তা বোঝা হয়ে দাড়াবে না। কমবেশি চার মিলিয়ন মানুষ জীবন নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে, যাদের অর্ধেকই হলো সিরিয়ার। প্রত্যেক দেশেরই উচিত তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসা। এই মানুষগুলো ওই দেশগুলোতে সারাজীবন থাকার জন্য যাচ্ছেন না, তারা নিজ দেশে ফিরে যেতে চায়।

সবচেয়ে বড় কথা, সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতির অবসান করা। আকাশ থেকে তাদের উপর বোমা ফেলে কোনো কাজ হবে না। সমস্যাটিতো মাটিতে, আকাশে নয়। এই করে আইএসআইএল’কে আঘাত করা যাবে না। আপনি নিরীহ মানুষকে হত্যা করছেন, গোটা দেশ ধ্বংস করে দিচ্ছেন।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.