তেলের নিয়ে পাঁচ যুদ্ধ

ডিসেম্বর ৫, ২০১৫

11ঢাকা : বেঁচে থাকা তথা অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে একটি অপরিহার্য উপাদান হচ্ছে জ্বালানি। এই জ্বালানির অত্যতম একটি অনুষঙ্গ হচ্ছে তেল। আমরা গ্যাস, কয়লাকেও জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করে থাকি। প্রতিটি দেশের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখে এই জ্বালানি। যে দেশ তেল বা গ্যাসের দিক থেকে  যতো সমৃদ্ধ, সে দেশ নিরাপত্তার দিক থেকে ততোটাই সুরক্ষিত। এই তেল নিয়ে রাষ্ট্রগুলো যুদ্ধে পর্যন্ত জড়িয়ে পড়ে।

গত পাঁচ দশকে বিশ্বে ছোট-বড় অনেক যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। এর মধ্যে বড় বড় কয়েকটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে এই তেলের কারণেই। এমনকি এখন সিরিয়া ও ইরাকে যে যুদ্ধ চলছে তার নেপথ্যেও রয়েছে এই তেল। দেশ দুটির বিস্তীর্ণ ভূমি দখল করে গড়ে উঠা ইসলামিক স্টেটের ( আইএস) বিরুদ্ধে বোমা হামলা চালাচ্ছে পশ্চিমারা। মাস দুয়েক হল এই যুদ্ধে যোগ দিয়েছে রাশিয়া।

সম্প্রতি রাশিয়ার একটি জঙ্গি বিমান গুলি করে ভূপাপিত করেছে তুর্কি সেনারা। আর এতেই সেখানকার পরিস্থিতি এখন ভিন্ন দিকে মোড় নিচ্ছে।

রাশিয়া অভিযোগ করেছে, আইএসের কাছ থেকে তেল পাওয়ার স্বার্থেই তুরস্ক গুলি করে রুশ বিমান ভূপাপিত করেছে। আইএস থেকে বছরে শত কোটি ডলারের তেলের সরবরাহ তুরস্কে যায়। সেই তেলবাহী ট্রাক বহরের ওপর বিমান হামলা চালাচ্ছিল রুশ জঙ্গী বিমানগুলো।

যদিও তুরস্ক এর প্রতিবাদ জানিয়েছে তীব্র ভাষায়। তারা বলছে, ইসলামিক স্টেটের কাছ থেকে তেল কেনার অভিযোগ সত্য নয়। তবে এই অভিযোগকে ঘিরে বিভিন্ন যুদ্ধে তেলের ভূমিকা আবারও আলোচনায় আসছে। সেরকম পাঁচটি যুদ্ধ:

সিরিয়া এবং ইরাক: ২০১১ থেকে বর্তমান

ইরাক এবং সিরিয়ায় কথিত ইসলামিক স্টেটকে ঘিরে যে যুদ্ধ, তাতে তেলের যে বিরাট ভূমিকা আছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। ইসলামিক স্টেট জঙ্গীদের আয়ের বড় উৎস তেল সম্পদ। তারা সিরিয়া তেল সমৃদ্ধ অঞ্চলের বেশিরভাগটাই নিয়ন্ত্রণ করে।

ইরাক যুদ্ধের পেছনেও ছিল পশ্চিমা দেশগুলোর তেলের স্বার্থ। ২০১৪ সালে ইসলামিক স্টেট প্রতিদিন দুই মিলিয়ন ডলারের তেল বিক্রি করতো। ইরাকের মসুলের কাছে অনেক তেলকূপও তাদের দখলে। এই তেল তারা চোরাচালানি থেকে শুরু করে বিভিন্ন পক্ষের কাছে বিক্রি করে। চোরাচালানিরা আবার এই তেল বিক্রি করে সিরিয়ার আসাদ সরকার থেকে শুরু করে প্রতিবেশি তুরস্কের কাছে। রাশিয়া আসলে তাদের অভিযোগে এই বিষয়টির দিকেই ইঙ্গিত করেছে।

বিবিসির সংবাদদাতা ফ্রাংক গার্ডনার বলছেন, তেল নিয়ে এই ব্যবসা যে চলছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। তবে এতে তুরস্কের সরকার জড়িত থাকার কোন প্রমাণ এখনো নেই।

২০০৩ সালে সালের ইরাক যুদ্ধ

২০০২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে যখন ইরাক যুদ্ধের প্রস্তুতি চলছে, তখন তৎকালীন ইরাকী উপ-প্রধানমন্ত্রী তারেক আজিজ বলেছিলেন, ইরাকের তেলের লোভেই পশ্চিমা শক্তি এই যুদ্ধে যাচ্ছে। আরব বিশ্বে সে সময় এই ধারণাটাই আসলে বদ্ধমূল ছিল।

ইরাকের রয়েছে বিপুল তেলসম্পদ।  বিশ্লেষকরা একমত যে, এই তেলের স্বার্থ ওই যুদ্ধের অন্যতম কারণ, তবে একমাত্র কারণ নয়। ইকোনমিস্ট ম্যাগাজিন এক নিবন্ধে ওই যুদ্ধের নেপথ্যে তেলের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি স্বীকার করে। ওই নিবন্ধে বলা হয়, ইরাকের বিপুল তেল সম্পদ উন্মুক্ত করা এই অভিযানের অন্যতম লক্ষ্য ছিল। অন্যদিকে সাদ্দাম হোসেন যেভাবে এই তেলসম্পদকে ইরাকের প্রভাব বৃদ্ধির কাজে লাগাচ্ছিলেন, সেটা বন্ধ করাও পশ্চিমা দেশগুলোর উদ্দেশ্য ছিল।

১৯৯১ সালের প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধ

প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধের আগে যেসব যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভ হতো, সেগুলোতে একটা জনপ্রিয় শ্লোগান ছিল ‘ তেলের জন্য রক্ত নয়’। এই যুদ্ধে তেলের স্বার্থ যে সবচেয়ে বড় ছিল তা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। ইরাক মূলত এই তেল সম্পদের লোভেই প্রতিবেশি কুয়েত দখল করে নেয়। সাদ্দাম হোসেন অবশ্য কুয়েতকে তাদের একটি প্রদেশ হিসেবে দাবি করে।

আর যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের মিত্ররা যে কুয়েতকে দখলমুক্ত করতে চেয়েছে, সেটাও তেলের স্বার্থেই। তারা চেয়েছে কুয়েতের বিপুল তেলের সরবরাহ যেন তাদের জন্য উন্মুক্ত থাকে।

১৯৫৩ সালের ইরান অভ্যুত্থান

১৯৫৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেন মিলে ইরানে যে অভ্যুত্থান ঘটায়, তার পেছনে ছিল তেলের স্বার্থ। নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মোসাদ্দেগের সরকারকে তারা যে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয় তার কারণ তিনি ইরানে ব্রিটিশ মালিকানাধীন তেল কোম্পানিকে জাতীয়করণ করেছিলেন।

পশ্চিমা দেশগুলোর বিরুদ্ধে যে ইরানে ব্যাপক সন্দেহ তৈরি হয়, তার সূত্রপাত এখান থেকেই। এর পরিণতিতেই কিন্তু ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামী বিপ্লব সংঘটিত হয়, ক্ষমতাচ্যূত হন রেজা শাহ পাহলভি।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে ফ্যাসীবাদের বিরুদ্ধে লড়াই হিসেবে বর্ণনা করা হয়। কিন্তু এই যুদ্ধেও তেলের ভূমিকা ছিল। জাপান যখন চীনে অভিযান চালায়, তার জবাবে যুক্তরাষ্ট্র জাপানে তেল সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। তখন এর পাল্টা জবাব হিসেবে জাপান আক্রমণ চালায় যুক্তরাষ্ট্রের পার্ল হারবারে। জাপানের অর্থনীতি পুরোপুরি নির্ভরশীল ছিল আমদানি করা তেলের ওপর।

অন্যদিকে ইউরোপীয় রণক্ষেত্রে সে সময়ের সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ, তেল সমৃদ্ধ আজারবাইজান দখল করা ছিল জার্মানদের লক্ষ্য।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.