আবারও আবুল হোসেন!

মার্চ ২৬, ২০১৩

abul_hossainঢাকা জার্নাল: আবারও আবুল হোসেন মিডিয়ার নজর কাড়লেন। তবে সেটা পদ্মা সেতুর মত কোন কেলেঙ্কারি ঘটনায় নয়। দুটি টেলিকম প্রতিষ্ঠানে আবুল হোসেনের বিনিয়োগকৃত অর্থের উৎস নিয়ে সরকারের কয়েকটি দফতর থেকে সম্প্রতি প্রশ্ন উঠেছে!

জানা যায়, ভিশনটেল লিমিটেড এবং ক্লাউডটেল লিমিটেড নামের দুইটি কোম্পানিতেই সাবেক যোগাযোগ মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন ও মন্ত্রীর দীর্ঘ বছরের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত সিঙ্গাপুরের হুন্ডি ব্যবসায়ী এম. বদিউজ্জামান পরিবারের সদস্যদের নামে বিনিয়োগ রয়েছে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) সূত্রে জানা গেছে, ২০১০-১১ কর-বছরে বদিউজ্জামান ১০ লাখ ৪৩ হাজার টাকা আয় দেখিয়েছেন। ওই কর-বছরে তিনি আয়কর দিয়েছেন এক লাখ ৩৩ হাজার ৩৯৩ টাকা।অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, মাত্র এক বছরের ব্যবধানে সপরিবারে তিনি একটি টেলিকম কোম্পানির অধিকাংশ শেয়ারের মালিক কিভাবে হলেন? আরেকটি টেলিকম কোম্পানির অর্ধেক মালিকানা তিনি কিনে নিতে চাচ্ছেনই বা কিভাবে? এত অর্থ কোথা থেকে এলো? বদিউজ্জমানের নামে অন্য কেউ বিনিয়োগ করছেন না তো!২০১১ সালের অক্টোবরে কোম্পানি হিসেবে নিবন্ধিত হয় ভিশনটেল। একই বছরের নভেম্বরে নিবন্ধিত ক্লাউডটেল। তবে ভিশনটেল আন্তর্জাতিক গেটওয়ে (আইজিডব্লিউ) লাইসেন্স পেয়েছে চলতি বছরের এপ্রিলে। একই সময়ে ক্লাউডটেল পেয়েছে ইন্টারকানেকশন এক্সচেঞ্জ (আইসিএক্স) লাইসেন্স। দেশে আন্তর্জাতিক ফোনকল যাওয়া-আসার পুরো ব্যাপারটি হয়ে থাকে আইজিডব্লিউ এবং আইসিএক্স কোম্পানির মাধ্যমে।ভিশনটেল ও ক্লাউডটেল কোম্পানি দুইটির বেশিরভাগ মালিকানাই রয়েছে সৈয়দ আবুল হোসেন ও এম. বদিউজ্জামান-এই দুই পরিবারের হাতে।

তবে মালিকানা থাকার ক্ষেত্রে আইন লঙ্ঘনের একাধিক ঘটনা ঘটেছে। যেমন-বাংলাদেশী নাগরিকত্ব প্রত্যাহার করেও বাংলাদেশী হিসেবেই অর্থ বিনিয়োগ, বেআইনিভাবে মালিকানায় থাকা, অর্থের উত্স সম্পর্কে স্বচ্ছতা থাকা, অবৈধ শেয়ার হস্তান্তর ইত্যাদি। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক কমিশন (বিটিআরসি) এবং যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের নিবন্ধকের কার্যালয় (রেজসকো) থেকে এ সব তথ্য জানা গেছে।ক্লাউডটেল: ক্লাউডটেলের পরিশোধিত মূলধন ১০ কোটি টাকা। কোম্পানির অর্ধেক অর্থাৎ ৫০ হাজার শেয়ারের মালিক সৈয়দ আবুল হোসেনের ছোট মেয়ে সৈয়দা ইফফাত হোসেন। লাইসেন্স নেয়ার সময় কোম্পানিটির পারফরমান্স ব্যাংক গ্যারান্টি (পিবিজি) দিতে হয়েছে পাঁচ কোটি টাকা।সূত্র জানায়, ক্লাউডটেলে পিবিজির অর্থ এসেছে পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের সঙ্গে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠান সাকো ইন্টারন্যাশনাল থেকে। বিশ্বব্যাংকের ইনটেগ্রিটি ভাইস প্রেসিডেন্সী (আইএনটি) গত বছর যে প্রতিবেদন দাখিল করেছিল সরকারের কাছে, তাতে বলা হয়েছিল, “সৈয়দ আবুল হোসেন ও তার মালিকানাধীন কোম্পানি সাকো হলো দুর্নীতির নেপথ্য প্রতিনিধি (সাইলেন্ট এজেন্ট) এবং পদ্মা সেতু প্রকল্পের কোনো কাজ পেতে হলে বা কোনো প্রাক-যোগ্যতায় টিকতে হলে সাকোকে মোটা অংকের ফি দিতে হবে।”সৈয়দা ইফফাত হোসেন অবশ্য তার পুরো শেয়ারই বিক্রি করে দিতে চেয়েছিলেন বদিউজ্জামানের কাছে। গত ১১ ডিসেম্বর এ জন্য তিনি সিঙ্গাপুরের নাগরিকত্ব গ্রহণকারী হুন্ডি ব্যবসায়ী এম. বদিউজ্জমানের (পাসপোর্ট নম্বর (E2131776B) নামে হস্তান্তরের জন্য বিটিআরসির কাছে আবেদন করেন। যদিও পরের সপ্তাহেই তিনি তা প্রত্যাহার করে নেন।

এদিকে, সৈয়দ আবুল হোসেনের মেয়ে জামাতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জোবায়ের আলম ক্লাউডটেলের পরিচালক হতে যাচ্ছেন বলে জানা গেছে।এ ব্যাপারে বিটিআরসিতে একটি আবেদন থাকলেও বিধিসম্মত না হওয়ায় তা আটকে রেখেছে সংস্থাটি। নিজের মোট শেয়ার থেকে পাঁচ হাজার শেয়ার তার স্বামী জোবায়ের আলমের কাছে বিক্রি করবেন বলে গত ২৫ সেপ্টেম্বর বিটিআরসি চেয়ারম্যানের কাছে আবেদন করেন সৈয়দা ইফফাত হোসেন।  বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ অনুযায়ী যদিও জোবায়ের আলম ক্লাউডটেলের পরিচালক হতে পারেন না।ভিশনটেল: ভিশনটেল লিমিটেডের পরিশোধিত মূলধন দুই কোটি টাকা। তবে এর পিবিজি ১৫ কোটি টাকা। বিটিআরসি সূত্র জানায়, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক লিমিটেডের (বিসিবিএল) গুলশান শাখা বদিউজ্জমানের পক্ষে বিটিআরসিকে পিবিজি দিয়েছে।কোম্পানিটির মালিকানার বেশিরভাগই বদিউজ্জমান পরিবারের সদস্যদের নামে রয়েছে-যাদের কেউই বর্তমানে বাংলাদেশী নাগরিক নন। কোম্পানির মোট পরিচালক ৯ জন। এর মধ্যে চেয়ারম্যান বদিউজ্জামানসহ চার জনই তার পরিবারের সদস্য। পরিচালক তার স্ত্রী নাসরিন জামান (পাসপোর্ট নম্বর E2522233B), ছেলে এহসানুজ্জামান রাজীব (পাসপোর্ট নম্বর E2575003K) ও মেয়ে তানিয়া জামান (পাসপোর্ট নম্বর E2609850C)।

এছাড়া পরিচালক রয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শামসুল হকের ছেলে এসএম আসিফ শামস। জানা গেছে, গত ১০ নভেম্বর চার হাজার শেয়ার স্থানান্তরিত হয়েছে আবাসন খাতের কোম্পানি অ্যাডভান্স হোম (প্রা) লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তৌহিদা সুলতানার নামে। অথচ বাধ্যবাধকতা থাকা সত্ত্বেও মন্ত্রণালয় ও বিটিআরসিকে তা জানানোই হয়নি।

বিদ্যমান আইজিডব্লিউ নীতিমালা,২০১১-এর ২১ (২) ধারায় বলা হয়েছে, ‘বিটিআরসির লিখিত অনুমতি ছাড়া বাংলাদেশী নাগরিক নন এমন কেউ লাইসেন্স পাবেন না এবং এমনকি তার নামে কোনো শেয়ারও হস্তান্তরিত হতে পারবে না।”

একই নীতিমালার ৩১ (৫) ধারায় বলা হয়েছে, “বিটিআরসির লিখিত অনুমতি ছাড়া যে কোনো পরিমাণ শেয়ার হস্তান্তরিত হলে কোম্পানির লাইসেন্স বাতিল করা হবে।”

তৌহিদা সুলতানার নামে শেয়ার হস্তান্তরে কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন থাকার নিয়ম রয়েছে। সূত্র জানায়, পর্ষদের অনুমোদন রয়েছে বলে যে কাগজপত্র রেজসকোতে জমা দেয়া হয়েছে, সেই পর্ষদ সভার কোরাম পূর্ণ ছিল না। অর্থাৎ তৌহিদা সুলতানার নামে শেয়ার হস্তান্তরের ক্ষেত্রে বিধি অনুসরণের তোয়াক্কা করা হয়নি।

অন্যদিকে, ক্লাউডটেলের পরিচালক হতে চাইলেও বিধি-বহির্ভূতভাবে ভিশনটেল চালাচ্ছেন এখন জোবায়ের আলম।

বদিউজ্জামান কে: ২০১০ সালের মাঝামাঝি গোপালগঞ্জ পৌরসভার মেয়র হাসমত আলী শিকদার চুন্নু স্বাক্ষরিত জন্মসনদ অনুযায়ী, গোপালগঞ্জ পৌরসভার নবীনবাগের সার্কিট হাউস রোড বদিউজ্জমানের স্থায়ী ঠিকানা। সিঙ্গাপুরের ঠিকানা: ০৩-১৮, নর্থ ব্রীজ রোড, পেনিনসুলা প্লাজা। ঢাকার বর্তমান ঠিকানা-বাড়ি-১, রোড-১৫, গুলশান-১।

সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশী হাই কমিশন সূত্রে জানা গেছে, ১০ বছর আগে থেকেই তিনি সিঙ্গাপুরের নাগরিক। কর ফাঁকির দায়ে মনিটারি অথরিটি অব সিঙ্গাপুর এম. বদিউজ্জামান ও তার ভাইয়ের নামে মামলা করেছে, যা বর্তমানে তদন্তাধীন।
তানিয়া গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা বদিউজ্জামানের তানিয়া ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান রয়েছে সিঙ্গাপুরে। ‘জামান মার্কেট’ নামে একটি মার্কেটও রয়েছে তার। এ ছাড়া এক্সেলসিওর হোটেল অ্যান্ড শপিং সেন্টারে ‘অঙ্গন’ নামে ওই দেশে একটি রেস্তোরাঁও রয়েছে।দেশে তিনি অ্যাডভান্স হোমসের চেয়ারম্যান এবং অ্যাডভান্স করপোরেশনের স্বত্ত্বাধিকারী। বাংলাদেশ ফিন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানির (বিএফআইসি) পরিচালক। এগুলোসহ টেলিকম কোম্পানিতে তিনি বিনিয়োগ করেছেন বিদেশি বিনিয়োগকারী হিসেবে নয়, বরং বাংলাদেশী হিসেবে। ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরাম অব বাংলাদেশের (আইবিএফবি) তিনি সদস্য।বিটিআরসির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মকর্তারা বলছেন, বদিউজ্জামান যেহেতু আর বাংলাদেশী নাগরিক নন এবং বাংলাদেশে তিনি চলাফেরা করেন আবার বাংলাদেশী পরিচয়েই, এবং যেহেতু বহু বছরের পুরনো হুন্ডি ব্যবসায়ী তিনি, তাই তার মাধ্যমে দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচারের শঙ্কা রয়েছে।
উল্লেখ্য, সৈয়দ আবুল হোসেনের সঙ্গে বদিউজ্জামানের ঘনিষ্ঠতা দীর্ঘ বছরের। সৈয়দ আবুল হোসেন যখন ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশে (টিসিবি) চাকরি করতেন, তখন থেকেই দুইজনের সম্পর্কের শুরু।
সূত্র: এনবি

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.