শিক্ষা মানোন্নয়ন ১১ প্রকল্পের বেহাল দশা

মার্চ ২৬, ২০১৩

irregularities-at-education-projects1হুমকির মুখে পড়েছে মাধ্যমিক শিক্ষার মানোন্নয়নের ১১টি প্রকল্প। এর মধ্যে ১০টি বিনিয়োগ প্রকল্প ও একটি কারিগরি সহায়তা প্রকল্প। শিক্ষার মানোন্নয়ন প্রকল্পে দুর্নীতি ও লুটপাট বাড়ছেই। ঘুষ বা উৎকোচ ছাড়া প্রকল্পের অনুকূলে অর্থ ছাড় হচ্ছে না।

কয়েকটি প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) ইচ্ছেমতো ঋণের অর্থ তছরুপ করছেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। শিক্ষামন্ত্রী প্রকল্পের কাজে গতি ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে নিরলস প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখলেও আমলারা চলছেন উল্টো পথে। শিক্ষামন্ত্রীর নির্দেশনা আমলে না নিয়ে প্রায়ই বিভিন্ন প্রকল্পের অধীনে বরাদ্দকৃত অর্থ কাটছাঁট করে ছাড় করছে মন্ত্রণালয়ের একটি চক্র। তবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অনৈতিক পন্থায় খুশি করতে পারলে দ্রুত সময়ের মধ্যেই প্রত্যাশিত অর্থ ছাড় হচ্ছে বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, অর্থ ছাড়ে অহেতুক বিলম্ব না করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) এ সংক্রান্ত মাসিক সমন্বয় সভায় সিদ্ধান্ত হলেও তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। এর ফলে আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলোও সময়মতো অর্থ ছাড় করতে পারছে না। এ সমস্যা নিয়ে এ মাসের প্রথম সপ্তাহে মাউশির মাসিক সভায় বিস্তারিত আলোচনা হলেও কোন সমাধান আসেনি। এমনকি গত ১০ ফেব্রুয়ারি প্রকল্প বাস্তবায়ন ও অগ্রগতি সংক্রান্ত বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাসিক সভায়ও নানা অভিযোগ উত্থাপন হয়, কিন্তু ফল আসেনি।

জানা গেছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একাধিক মাসিক সভায় শিক্ষা সচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী বলেন, কয়েকজন পিডি দক্ষতার পরিচয় দিতে পারেননি। এরপর তিনি নানা অনিয়মের দায়ে চলতি মাসের সভায় এসইএসডিপি, আইসিটি, টিকিউআই-২ প্রকল্পের পিডিকে সতর্ক করেন। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের বিতর্কিত আমলাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে শিক্ষা সচিব বরাবরই নমনীয়তা দেখাচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। তবে শিক্ষামন্ত্রী সুনির্দিষ্ট অভিযোগ সম্প্রতি মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা শাখার দুইজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাকে সরিয়ে দিয়েছেন।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সেকেন্ডারি এডুকেশন সেক্টর ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের (এসইএসডিপি) আওতায় বিভিন্ন জেলায় ৩৫টি মাদ্রাসাকে মডেল মাদ্রাসায় রূপান্তরিত করা হচ্ছে। এর মধ্যে নারায়ণগঞ্জের স্থানীয় সংসদ সদস্য প্রথমে ‘বক্তাবলী ইসলামিয়া মাদ্রাসা’কে মডেল রূপান্তর করতে চাহিদাপত্র দেয়। পরবর্তীতে ওই মাদ্রাসার পরিবর্তে তিনি অন্য একটি মাদ্রাসাকে মডেলে পরিণত করতে চাহিদাপত্র দেন। একপর্যায়ে বিষয়টি নিয়ে মামলা হয়। এরপর উচ্চ আদালত ‘বক্তাবলী ইসলামিয়া মাদ্রাসা’কে মডেল মাদ্রাসায় রূপান্তরের নির্দেশ দেন। কিন্তু পিডি রতন কুমার রায় আদালতের নির্দেশনা আমলে না নিয়ে মাদ্রাসার উন্নয়ন কাজ বন্ধ রাখেন এবং বারবার মাদ্রাসার তালিকা পরিবর্তন করছেন। পরে সম্প্রতি মন্ত্রণালয়ের এক সভায় রতন কুমার রায়কে ভর্ৎসনা করেন শিক্ষা সচিব।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা শাখার যুগ্ম প্রধান সরদার ইলিয়াস হোসেন সম্প্রতি (গত সপ্তাহে স্যান্ড রিলিজড) বলেন, ‘টিকিউআই প্রকল্পের প্রায় ১০ কোটি টাকার হদিস নেই। এই টাকা কিভাবে ব্যয় করা হয়েছে, কারা ব্যয় করেছে, তার কোন ব্যাখ্যা দিতে পারছেন না প্রকল্পের কর্মকর্তারা।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে টিকিউআই প্রকল্পের একজন উপ-পরিচালক সাংবাদিকদের বলেন, ‘এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) আমাদের কাছে প্রায় ১০ কোটি টাকা পাবে। এর মধ্যে প্রথম কিস্তি হিসেবে প্রায় ছয় কোটি টাকা এডিবির অনুকূলে ছাড় করা হয়েছে। এখানে কোন অনিয়মের সুযোগ নেই।’

সেকায়েপ প্রকল্পে অনিয়ম :

জানা গেছে, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে পরিচালিত সেকেন্ডারি এডুকেশন কোয়ালিটি অ্যান্ড অ্যাকসেস এনহান্সমেন্ট প্রজেক্টের (সেকায়েপ) বিভিন্ন কেনাকাটা সংক্রান্ত অনিয়মের দায়ে গত বছর এই প্রকল্পের চারজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক (বদলি ও বিভাগীয় মামলা) ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল। কিন্তু ক্রয় সংক্রান্ত কমিটি বাতিল করা হয়নি। ওই কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন মাউশির কর্মকর্তা জুলফিকার রহমান এবং সদস্য মাউশির ওই সময়ের সহকারী পরিচালক রাশেদুজ্জামান, প্রকল্পের কর্মকর্তা এনামুল হক ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন সিনিয়র সহকারী সচিব। তবে এবার ওই কমিটি বাতিলের জন্য গত ১৪ জানুয়ারি বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিস থেকে চিঠি দেয়া হলে পিডি শহীদ বখতিয়ার আলম তা বাতিল করেন। কিন্তু অভিযোগ উঠেছে, এবারও ক্রয় কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে বিগত চারদলীয় জোট সরকারের সুবিধাভোগী মাউশির উপ-পরিচালক ইমরুল হাসানকে।

গতমাসে অনুষ্ঠিত সংসদীয় কমিটির সভায় শিক্ষা সচিবকে জিজ্ঞেস করা হয় রাশেদুজ্জামানের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিলো? জবাবে সভার মাইক বন্ধ করে দিয়ে খালিমুখে সচিব জানান শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার মতো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া যায়নি রাশেদুজ্জামানের বিরুদ্ধে। এমন জবাবে অসন্তুষ্ট এককজন সংসদ সদস্য কমিটির পরবর্তী সভায় ওই তদন্ত কমিটির রিপোর্ট উপস্থাপন করতে বলেছেন। রাশেদুজ্জামানের কপালটা খুলে গেছে, তিনি এখন মধুর হাড়িখ্যাত ডিআই-এর উপ-পরিচালক।

এ ছাড়া ফারুক আহমেদ নামে আরেক অভিযুক্ত যিনি শিক্ষা ক্যাডার থেকে উপ-সচিব হয়েছিলেন তাকেও ‘মাফ’ করে দেয়া হয় । এ দুনীর্তিবাজ কর্মকর্তা এখন একজন গুরুত্বপূর্ণ সচিবের পিএস।

এছাড়াও সেকায়েপ প্রকল্পের উপবৃত্তি কার্যক্রমে নিয়োজিত বিশ্বব্যাংকের পরামর্শক এডমন্ড বার্কের বেতন থেকে প্রায় ১৫ লাখ টাকা কর হিসেবে কেটে রাখায় নতুন করে ওই প্রকল্পে অর্থায়নে অনীহা দেখাচ্ছে সংস্থাটি। কারণ পরামর্শকের বেতন থেকে কর কর্তনের কোন নিয়ম নেই। প্রসঙ্গত, সেকায়েপ প্রকল্পের অধীনে দেশের ১২১টি উপজেলায় মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি প্রদান করা হচ্ছে।

জানা গেছে, মাধ্যমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে বর্তমানে ৯টি প্রকল্প চলমান আছে। এগুলো হলো- টিচিং কোয়ালিটি ইম্পপ্রুভমেন্ট ইন সেকেন্ডারি এডুকেশন প্রজেক্ট (টিকিউআই-সেপ), এসইএসডিপি, সেকায়েপ, হায়ার এডুকেশন ফিমেইল স্টাইপেন্ড প্রজেক্ট, সেকেন্ডারি এডুকেশন স্টাইপেন্ড প্রজেক্ট, ট্রান্সফরমেশন অফ অ্যাকজিসটিং নন-গভর্নমেন্ট স্কুল ইন টু মডেল স্কুলস ইন সিলেকটেড ৩০৬ উপজেলা হেডকোয়াটার্স, এস্টাবলিশমেন্ট অফ ১১ সেকেন্ডারি স্কুল অ্যান্ড ৬ কলেজেস (গভর্নমেন্ট) ইন ঢাকা মেট্রোপলিটন সিটি, ডেভেলপমেন্ট অফ পোস্ট-গ্রাজুয়েট গভর্নমেন্ট কলেজেস এট দি ডিস্ট্রিক হেডকোয়াটার্স ফর ইম্প্রভিং কোয়ালিটি অফ এডুকেশন এবং আইসিটি ফর এডুকেশন ইন সেকেন্ডারি অ্যান্ড হায়ার সেকেন্ডারি লেভেল প্রজেক্ট।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.