পানির নিচে যত শহর

ডিসেম্বর ৩, ২০১৫

19 মানব সভ্যতার ইতিহাস থেকে জানা যায় কালে কালে কত শহর-নগর গড়ে উঠেছে পৃথিবীতে। ঐতিহাসিকভাবে নানা কারণে বিখ্যাত বহু সব শহর, নগর। আজও মানুষ সেই শহরগুলোর কথা মনে রেখেছে। তবে পানির তলায়ও রয়েছে শহর।

নিশ্চয় ভাবছেন, এমনও কি সম্ভব? কে এমন অদ্ভূত যে আবার মাটির উপরে এত জায়গা থাকতে গিয়ে পানির তলায় শহর বানাবে? বাস্তবে এমন শহরও আছে যা পানির তলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তবে পানির নীচে গিয়ে কেউ শহরগুলোকে তৈরি করেনি। কালে কালে নানা কারণে পানির তলায় ডুবে গেছে শহরগুলো। বিভিন্ন সময় এই শহরগুলোকে নতুন করে খুঁজে বের করেছেন অনুসন্ধানকারীরা। আজ জানাচ্ছি তেমনি কয়েকটি ডুবন্ত শহরের গল্প।

 

১. ভিলা ইপেকুয়েন, আর্জেন্টিনা

মরা গাছের শুকনো ডাল-পালা আর মাঝে মাঝে উঁচু হয়ে থাকা কিছু ভেঙে যাওয়া স্থাপত্যের চিহ্ন- এই নিয়েই বর্তমানে আর্জেন্টিনার ভিলা ইপেকুয়েনের দিন কাটলেও একটা সময় ছিল যখন একে দেখতে ভীড় করত হাজার হাজার পর্যটক। ২০ শতকে বুয়েন্স আয়ার্স থেকে ৩৪০ মিটার দূরে অবস্থিত লাগো ইপেকুয়েনের লবনাক্ত পানির সাহায্য নিয়ে এখানে গড়ে উঠেছিল এই শহরটি। ১৯৭০ সালে অব্দি জনসংখ্যা ৫ হাজারে গিয়ে পৌঁছায় এ শহরের। কিন্তু সমস্যাটা দেখা দেয় ১৯৮৫ সালে। অতিরিক্ত বর্ষনে হঠাৎ করে একটা মাটির তৈরি বাঁধ ভেঙে যায় আর ডুবে যায় পুরো অঞ্চল।

 

এ জায়গাটির অধিবাসীরা সেসময় অন্য স্থানে চলে গেলেও পিছনে ফেলে যায় তাদের লবনাক্ত পানিতে ডুবে যাওয়া সব জিনিসপত্র। টানা ২৫ বছর লবণে ঢাকা এ স্থানটি অনেকদিন পর খানিকটা মাথা তুলে দাড়ায় কিছুদিন আগে। মানুষ খোঁজ পায় এর নীচের হারিয়ে যাওয়া শহরের। সেই থেকে লবণ পানিতে ডুবে থাকা ভিলা ইপেকুয়েন অনেকদিন পর ঠিক আগের মতন আবার নতুন করে মানুসের আগমনে ঘটে। এলাকাটিতে সরগরম হয়ে ওঠে দর্শনীয় স্থান হিসেবে।

 

২. শি চেঙ, চীন

চীনের ঝেইজ্যাং প্রদেশের কোয়াইনডো লেকের নীচে শান্তভাবে লুকিয়ে রয়েছে পৃথিবীর অন্যান্য বেশ কিছু শহরের মতন আরেকটি ডুবন্ত শহর। পানির নীচে এ শহরটি টিকে রয়েছে ৬০০ বছর ধরে। ১৯৫৯ সালে প্রচন্ড পানির তোড়ে ভেসে যাওয়া শহরটিকে পরীক্ষা করে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন মাটির উপরে সূর্য, বাতাস আর অন্যসবকিছুর সংস্পর্শে থাকার চাইতে আরো অনেক বেশি ভালো অবস্থায় রয়েছে বর্তমানে চীনের এই ডুবন্ত শহর। পানির সঙ্গেই খুব মিলেমিশে আছে সেটি। তবে ৬০০ বছরের পুরোনো হলেও ২০০১ সালের আগ পর্যন্ত মানুষ জানতেই পারেনি শি চেঙ এর কথা। তবে খুঁজে পাওয়ার পর এর স্থাপত্য আর দালান-কোঠা পরীক্ষা নিরীক্ষা করে জানা যায় এর শুরুটা হয়েছিল ১৭৭৭ সাল বা এর কাছাকাছি কোন একটা সময়ে।

 

বর্তমানে বেশকিছু ডাইভিং কোম্পানি ও  আরো বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান এ শহরে পর্যটকদের অবাধে আসা-যাওয়ার জন্যে চিন্তা করছে টানেল বা বিকল্প কিছুর নির্মাণের। আর সেটা যদি হয় তাহলে আর খুব বেশিদিন নেই পানির নীচে লুকিয়ে থাকা এই শহরটির সবার সঙ্গে পরিচিত হতে।

 

৩. চার্চ অব মেডিয়ানো, স্পেন

আর অঞ্চলের তুলনায় স্পেনে রয়েছে অনেকগুলো ডুবন্ত শহর। সেগুলোর মধ্যে সবচাইতে বিখ্যাত শহরটি হচ্ছে চার্চ অব মেডিয়ানো। মনে করা হয় ১৬ শতকে নির্মিত শহরটি ১৯৭৪ সালে স্থপতি হুয়েস্কার লা ফুয়েভাইয়ের পরিকল্পনায় মেডিয়ানো জলাধার তৈরি করতে গিয়ে ডুবে যায়। শহরটির সবটাই পানির নীচে তলিয়ে গেলেও এর কিছু কিছু অংশ, বিশেষ করে চার্চের উপরের অংশটুকু এখনো পানির উপরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

 

এমনিতে পানির নীচে ও উপরে দুভাবেই শহরটিকে দেখার সুযোগ থাকলেও নিরাপত্তার কারণে পানির নীচে যাওয়াটা অনেকটাই কমিয়ে ফেলেছেন কর্তৃপক্ষ।

 

৪. কিউবার ডুবন্ত শহর, কিউবা

২০০১ সালের ১৪ মে হঠাৎ এক কানাডিয়ান প্রতিষ্ঠান ‘অ্যাডভান্সড ডিজিটাল কমিউনিকেশন’ এর পক্ষ থেকে একটি জরিপ কাজ চালায়। সে সময় মেরিন ইঞ্জিনিয়ার পউলিন জালিটজকি ও তার স্বামী পল ওয়েজেওয়েগ পানির নীচে এক আশ্চর্য স্থাপনা খুঁজে পান। সেটি ছিল ক্যারাবিয়ান সর্ববৃহৎ দ্বীপ পশ্চিম কিউবায়। নানারকম অনুসন্ধানের পর পিরামিড, বারান্দা, রাস্তা, ঘর- কি না খুঁজে পায় মানুষ সেখানে! স্থাপনার গঠন আর আকৃতি দেখে মনে করা হয় ছোটখাটো কোন ব্যাপার নয়, বরং গোটা একটা সভ্যতাই বিকশিত হচ্ছিল এখানে। পুরোদস্তুর একটা শহরকে আবিষ্কার করে পৃথিবী।

 

ভূমির আকৃতি দেখে বিশেষজ্ঞরা জানান একটা সময় মাটির উপরেই ছিল স্থাপনাটি। তাহলে কি করে এভাবে ডুবে গেল এটি? সঠিক উত্তর এখনো পাওয়া যায়নি। এছাড়াও বেশ কিছু বিশেষজ্ঞের মতানুসারে কিউবার ডুবন্ত শহরটির এভাবে ডুবে যেতে সময় লেগেছে প্রায় ৫০,০০০ বছর। কিন্তু এত বছর আগে এতটা উন্নত প্রযুক্তি কিংবা চিন্তা-ভাবনা করার ক্ষমতা ছিল কি মানুষের? আর তা যদি নাই থাকত তাহলে কি করে এমন উন্নত একটি শহর নির্মিত হল সে সময়। এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে অনেকেই এর কৃতিত্ব দিতে চান অতিপ্রাকৃতিক বা ভিনগ্রহবাসীদের। অনেকে এই শহরকে আটলান্টিস শহরের সঙ্গেও মেলাতে চান। কেউ আবার পুরোটা ব্যাপারকেই প্রকৃতির কারসাজি বলে ভাবেন। কিন্তু সত্যিটা আসলে কি? নিজের রহস্যকে নিজের কাছে রেখে এখনো পানির নীচে বহাল তবিয়তে টিকে আছে রহস্য ঘেরা এ ডুবন্ত শহর।

 

৫. পাভলোপেত্রি, গ্রীস

গ্রীসের পেলোপনেশিয়ার দক্ষিণ ল্যাকোনিয়ায় পানির নীচে অবস্থিত পাভলোপেত্রির। তবে এর প্রকৃত নামটা এখনও অজানা মানুষের। তাই নতুন করে শহরটির নাম হয়েছে পাভলোপেত্রি। ১৯০৪ সালে ফোকিয়োনোস নেগ্রিস প্রথম আবিষ্কার করেন এই পানির নীচের শহরটিকে। এর পর তার আবিষ্কারকে ১৯৬৭ সালে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেন নিকোলাস ফ্লেমিং। বর্তমানে এর অবস্থান এলাফোনিসস গ্রাম আর পাভলোপেত্রি নামের একটি ছোট্ট দ্বীপের মাঝখানে। ৫,০০০ বছরের পুরোনো হলে কি হবে? বর্তমান শহরগুলোর চাইতে কোন দিক দিয়েই কম নয় পাভলোপেত্রি। কি নেই এখানে? ৩,২২,৯১৭ বর্গমাইলের এই শহরে রাস্তা, দালান, মন্দির- মোটকথা, পুরো শহরের নকশাই সাজানো আছে এতে। যা দেখলে চোখ কপালে উঠবে অনেকেরই।

 

ব্রোঞ্জ যুগের এই শহরটি ১০০০ বিসিতে পরপর ঘটে যাওয়া তিনটি ভূমিকম্পের কবলে পড়ে চিরতরে জন্য পানিতে ডুবে যায়। যেটা এরপর আর জেগে ওঠেনি কখনোই। তবে ডুবে যাওয়ার আগেই কৃষি, কাপড় বোনাসহ আরো অনেক অনেক দক্ষতা দেখিয়ে গিয়েছে একানকার মানুষেরা তাদের কাজে। শুধু তাই নয়, পাভলোপেত্রির মানুষেরা ব্যবসা নিয়েও বেশ এগিয়ে ছিল বলে জানা যায়। বর্তমানে নৌকো করে চাইলেই ঘুরে আসতে পারেন পর্যটকেরা এই অসম্ভব সুন্দর স্থাপনাটি থেকে। তবে কেবল পর্যটকদেরই নয়, ইউনেস্কোর কাছ থেকেও বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী স্থানের সম্মান মিলেছে পাভলোপেত্রি শহরের ভাগ্যে।

 

৬. পোর্ট রয়্যাল, জ্যামাইকা

শুকনো থাকাবস্থায় কি না ছিল এ শহরে? বিশেষ করে মাদক, বেশ্যাবৃত্তি, জলদস্যু- এ সব দিয়ে ভরা ছিল ১৭ শতকে শয়তানের শহর বলে পরিচিতি ছিল সেটি। তবে সেখানে ঝামেলা শুরু হয় খুব দ্রুতই। কথায় বলে না, পাপের ঘড়া পূর্ণ হওয়া! ১৬৯২ সালে ঠিক সেরকম অবস্থায়ই হয়তো হয়েছিল পোর্ট রয়্যালের।

 

হঠাৎ এক প্রবল ভূমিকম্প হয় শহরটিতে। সেই সঙ্গে ভয়ংকর এক সুনামি হয়। সব দালান-কোঠা তো ধ্বংস হয়েই যায়, মারা পড়ে শহরের প্রায় দুই হাজার অধিবাসী। ডুবন্ত এই শহরটির বর্তমান অবস্থান প্রায় ৪০ ফুট পানির নীচে।

 

 

 

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.