প্রকাশক হত্যা ও আক্রমণে লেখকদের ‍ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া

নভেম্বর ২, ২০১৫

21‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির, / জ্ঞান যেথা মুক্ত, যেথা গৃহের প্রাচীর / আপন প্রাঙ্গণতলে দিবসশর্বরী / বসুধারে রাখে নাই খন্ড ক্ষুদ্র করি’—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘প্রার্থনা’ কবিতার সতঃসিদ্ধ এই লাইনগুলো দেশের বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষিতে উচ্চারণ করা কঠিন। কারণ ভয়শূণ্য চিত্তে লেখার জন্যই ধর থেকে শির ছিন্ন করা হচ্ছে একের পর এক। স্বাধীন মত প্রকাশের জন্য আক্রান্ত হচ্ছে লেখক। পরিস্থিতি আরো গুরুতর পর্যায় যাচ্ছে প্রকাশক হত্যার মধ্যদিয়ে। আগামীতে পাঠককে পাঠ থেকে বিরত রাখার জন্য একই কায়দায় হত্যাকাণ্ড হবে না, তার নিশ্চয়তা কী–এরকম প্রশ্ন উঠে আসছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে।

২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে একুশের বই মেলার গেটে প্রথাবিরোধী লেখক ও অধ্যাপক হুমায়ূন আজাদের উপর আক্রমণ দিয়ে লেখক হত্যার নৃশংসতার যাত্রা শুরু। একই ভাবে ২০১৫ সালে ফেব্রুয়ারিতে বইমেলা থেকে বের হওয়ার পর উগ্রবাদীদের হামলায় প্রাণ হারান বিজ্ঞান-লেখক অভিজিৎ রায়। তারপর থেকে গত এক বছরে একে একে খুব হয়েছেন ৬ জন ব্লগার।
এদিকে হুমায়ুন আজাদ হত্যামামলাটির বিচার এখনও শেষ হয়নি, অন্যগুলোর অধিকাংশই এখনো তদন্তের পর্যায়ে। এরই মধ্যে গত ৩১ অক্টোবর এক দিনে রাজধানীর দুই স্থানে অভিজিৎ রায়ের বইয়ের দুই প্রকাশকের ওপর হামলা হয়। এই হামলায় জাগৃতি প্রকাশনির ফয়সল আরেফিন দীপন মরা গেছেন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় আছেন শুদ্ধস্বর প্রকাশনীর স্বত্তাধীকারী আহমেদুর রশীদ টুটুলসহ অন্যরা। এর কোনোটাই বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বরং সুপিরিকল্পিত তা বোঝা যায়।
প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের পরই নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন থেকে হত্যার দায় স্বীকার করে বিবৃতি প্রকাশ করেছে। এর মধ্যদিয়ে জঙ্গিরা যেমন অবিনীত উল্লাস করছে, তেমনি ভয়ের বিষবাষ্প প্রবেশ করিয়ে দিতে চাইছে মুক্তমনের মানুষের ফুসফুসে।
স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে লেখকের ওপর এমন ঘোর অমানিশা আর কখনো নেমে আসেনি। এবার প্রকাশক হত্যার মধ্যে দিয়ে মতপ্রকাশের পুরো পথটাই রুদ্ধ করতে চাইছে তারা। দেশের এই পরিস্থিতি নিয়ে আমাদের শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন লেখকের প্রতিক্রিয়া এই লেখাটি। প্রতিক্রিয়াগুলো শ্রুতিলিখন ও গ্রন্থনা করেছেন অলাত এহসান। বি.স.

—————————

সময়টা তো খুব আশঙ্কাজনক

sirazul-islam-chowdhury-0.jpg
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
—————————
সাম্প্রদায়িক উত্থানে সমাজ-রাষ্ট্র-সংস্কৃতির ভূমিকা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে লেখালেখি করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরেটাস শিক্ষক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। সাম্প্রদায়িক উত্থান উদ্বেগের সঙ্গে গভীর পর্যবেক্ষণ করছেন এই শিক্ষাবিদ-সমাজচিন্তক। তার কাছে, ‘সময়টা তো খুব আশঙ্কাজনক, একের পর হত্যাকাণ্ড ঘটছে। আশঙ্কাজনক আরো এক কারণে যে, অপরাধীরা ধরা পড়ছে না। আর অপরাধীরা ধরা পড়ছে না বলেই এই অপরাধ বাড়ছে। এর মাত্রাও বেড়ে যাচ্ছে। এরা ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে। এরা মনে করছে যে, এদের কোনো কিছুই হবে না। এমনিতেই এরা মনে করছে, ধর্মীয়ভাবে শহীদ হবে যদি শাস্তি পায়। তার ওপরে এরা শাস্তি পাচ্ছেও না। কাজেই তারা মনে করে যে, এভাবে পাড় পাওয়া যাবে এবং এটা তাদের পক্ষে অনেকটা বীরত্বপূর্ণ কাজে পরিণত হয়েছে।’ রাষ্ট্র ও সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রমে এই ধরনের উগ্রবাদীরা সবুজ সংকেত পেয়ে যাচ্ছে কি না, এই বিষয়ে তিনি বলেন, ‘তা তো বটেই। যারা লিখছে তারা তো অপরাধ করে নাই, নিজের মত প্রকাশ করছে। তারা বৈজ্ঞানিকভাবেই তা লিখছে, কোনো ধর্মীয় আক্রমনের জন্য লিখছে না।’ তিনি হতাশা বোধ করছেন বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের কার্যক্রমে। এটা প্রতিবাদী তরুণদের উৎসাহিতও করছে না। তার কারণে ‘প্রতিবাদ হচ্ছে না সেভাবে। কেউ গুরুত্বও দিচ্ছে না। এটা তো সবার জন্য সমস্যা। রাষ্ট্র গুরুত্ব দিচ্ছে না, সমাজও গুরুত্ব দিচ্ছে না।’ উত্তোরণের উপায় হচ্ছে, ‘রাষ্ট্রকে সজাগ হতে হবে। রাষ্ট্র যে কেবল চিন্তার স্বাধীনতাকে রক্ষা করবে, তা না। এরা আক্রমণ করছে রাষ্ট্রের যে ভিত্তি—যে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হওয়ার কথা—সেই ভিত্তির ওপর আক্রমণ করেছে। এরা যে জঙ্গি তৎপরতা চালাচ্ছে বিদেশিরা তাকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করছে। বিদেশি মানে বিদেশি পরাশক্তি।’ কিন্তু এটা কি বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা? বা একে কি আদৌ বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলা যায়? ‘একে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলার কোনো অজুহাতই নেই। এটা তো বোঝা যাচ্ছে যে, সুপরিকল্পিত। আর এরা যে নামেই আসুক, জঙ্গি বা অন্যকিছু এদের একটাই কাজ— রাষ্ট্রের মূলনীতিকে আঘাত করা।’

—————————

আইনশৃঙ্খলার অবস্থা নিয়ে আমি কিন্তু হতাশ

hasan-azizul-haque_13.jpg
হাসান আজিজুল হক
—————————
অভিজিৎ হত্যার পর দেশে প্রতিবাদ হলে তখন সরব প্রতিবাদ করেছেন কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক। বরাবরই অসাম্য-সম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লিখে, বক্তৃতা করে পথের দিশা দিতে চেষ্টা করেছেন তিনি। এবারের ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, ‘আমি বলবো, বাংলাদেশের অবস্থা নিয়ে, আইনশৃঙ্খলার অবস্থা নিয়ে আমি কিন্তু হতাশ। এবং মনে করি, আমাদের রাষ্ট্র পরিচালনা যারা করছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যাদের হাতে আছে তারা এখনো কেন সমস্ত শক্তি নিয়ে এই অপশক্তির বিরুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ছে না। এটা কি তাদের দুর্বলতা, না কি?—এভাবে তো জাতি তাদের জিজ্ঞেস করছে। এটা কি দুর্বলতা যে তারা এটা করতে পারছেন না? কতগুলো ছেলে এভাবে মরে গেল, কতগুলো ছেলে!’ দেশে শিশু হত্যা, লেখক-ব্লগার হত্যা দেশের আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা অবনতির নমুনা মনে করেন তিনি। ‘অক্ষম রাষ্ট্রেরই নমুনা এটি যে, দেশের কোর্মা-পোলাওয়ের সংস্থাকারী ব্যক্তি যদি দেশের সার্বিক অবস্থা বিবেচনা না করেই বলে সবার ডাল ভাতের সংস্থান হয়েছে, তা হবে চরম রকম ভণ্ডামি।’ দেশের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে একটা অসম অবস্থা বিরাজ করছে বলে তিনি মনে করেন। এ বছরের প্রথম দিকে যে লেখকদের ঐক্যের জন্য ডাক দিয়েছিলেন, ধারণা করা যেতে পারতো, তার ডাকে সাড়া দিয়ে এই ক্রান্তিকালে যদি লেখক-সাহিত্যিকরা এগিয়ে আসতেন, তাহলে এই ধরনের পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পথ পাওয়া যেতো। কিন্তু ঢাকায় অবস্থান না করায় এই ডাক প্রতিধ্বনিহীনভাবে মরে গেছে। ‘আমি আশা করেছিলাম আমি যেহেতু ঢাকায় না, যারা ঢাকায় থাকে তারা কিছু করবেন। আমি যেহেতু বাইরে থাকি, আমি বলি, এরচেয়ে বেশি আমার কি করার সম্ভব?’

—————————

প্রত্যেককে সতর্ক থাকতে হবে

syed-hoque.jpg
সৈয়দ শামসুল হক
—————————

সাম্প্রতিক এই ঘটনায় বিস্ময় বোধ করেন সব্যসাচী এই লেখক। তবে এই পরিস্থিতিতে তিনি হতাশ হতে নারাজ। তিনি মনে করেন, ‘লেখক হত্যার মধ্যদিয়ে তারা লেখা বন্ধ করতে চায়, আমাদের উচিত হবে এর প্রতিবাদে বেশি বেশি লেখা। আমি এটা এইভাবে দেখি যে, এটা নতুন নয়। কেন, আপনি দেখেননি, ১৯৭১ সালে দেখেননি, পাকিস্তানিরা কিভাবে পিটিয়েছে, খুন করেছে লেখকদের। তাহলে? দেখেননি ’৫২ সালে আমাদের কিভাবে পার্টিসিপেট করতে হয়েছে। দিস ইজ নট সামথিং নিউ। হয়তো প্রকাশের স্তর ভিন্ন হয়েছে। আমরা লেখকরা, জার্নালিস্টরা সব সময়ই পার্টিসিপেট করেছি। কাজেই আমি হতাশ নই, আমি উদ্বিগ্ন, আমি চিন্তিত, আমি ক্রুদ্ধ, আমি স্তম্ভিত। কিন্তু শোকার্ত সত্ত্বেও আমি বলবো এর উত্তরণ আমাদেরকেই করতে হবে।’ এই উত্তরণের পথটাও তার কাছে পরিস্কার। ‘আমাদের লিখে যেতে হবে, আর কি। আমি তো রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াবো না, আমাকে লিখতে হবে। আমরা যা ভাবছি, যা করছি, যা বিশ্বাস করি সেটা লিখব। আমরা লিখতে জানি।’ তিনি মনে করিয়ে দেন যে ‘১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দেশের লেখক-সাহিত্যিকদের ওপরও নির্যাতন হয়েছে।’ আজকের লেখক-হত্যাকাণ্ড ইতিহাসেরই ধারাবাহিকতা। ‘ইট ইজ নট নিউ, বাট স্টিল। লেখকরা সব সময়ই পারসিকিউট হয়েছে।’ কোনো ব্লগের লেখা বা ব্লগারদের কোনো বই পড়া না থাকলেও সৈয়দ হক এই লেখক হত্যাকে মোটেও সমীচিন মনে করেন না। ‘আমি বলি, আপনি যা ভাবছেন, মুক্তভাবে সেটা লেখবেন, সেটাই হচ্ছে আদর্শ পরিস্থিতি।’ তবে দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে রাষ্ট্র ‘আরো ভাল’ ভূমিকা রাখতে পারতো কি না, সেই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্র যথেষ্ট ভূমিকা রাখছে। ভাল ভূমিকা বলতে কি মনে করছেন আপনি? পাঁচটা গুণ্ডা এসে একজনকে আক্রমণ করবে, রাষ্ট্র সেখানে কি রন্ধ্রে রন্ধ্রে দাঁড়িয়ে থাকবে?’ তিনি মনে করেন, ‘যারা লিখছেন, যারা এই সমস্যার সঙ্গে পরিচিত তাদেরকেও সতর্ক থাকতে হবে।…প্রত্যেককে সতর্ক থাকতে হবে। রন্ধ্রে রন্ধ্রে রাষ্ট্র আপনাকে নিরাপত্তা দিতে পারে না, কোনো রাষ্ট্রই পারবে না। আপনি যদি বলেন, সব চেয়ে নিরাপত্তহীন রাষ্ট্র হচ্ছে আমেরিকা (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র)। যেখানে অমন দু’টো টলেস্ট বিল্ডিংকে ধ্বংস করেছে। …পৃথিবীর আর কোনো দেশে এমনটা হয়নি। তাহলে কিভাবে বলছেন আমরা এখানে নিরাপদ নই?’ তবে সবাইকে সতর্ক থাকার পরামর্শ তার। ‘যেমন আমাদের ’৫২ সালের পর সতর্ক থাকতে হয়েছে, ’৭১ সালে সতর্ক থাকতে হয়েছে, ’৭৫-এ বঙ্গবন্ধু হত্যার পর আমাদের সতর্ক থাকতে হয়েছে। আজকে নতুন পরিস্থিতি এসেছে, সেখানেও সতর্ক থাকতে হবে। তার জন্য মোকাবেলার উপায় হচ্ছে, কন্টিনিউ ইউর রাইটিং, নট স্টপ, দ্যাটস অল।’

—————————

বুদ্ধিজীবী আছে কেউ আমাদের দেশে?

kamal-lohani-1.jpg
কামাল লোহানী
—————————
বর্ষিয়ান এই সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ব্লগারের পর প্রকাশককে হত্যাকাণ্ডে বিচলিত। জাগৃতির প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপনের পিতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও সমাজ চিন্তক আবুল কাসেম ফজলুল হকের প্রতি সহমর্মিতা জানিয়ে, তার এই হত্যার বিচার না চাওয়া প্রসঙ্গে বলেন, ‘তিনি দীর্ঘদিন থেকে দেখছেন, এতোগুলো লোক মারা গেল, কোনো বিচার হলো না।’ ২০১৩ সালে হেফাজত ইসলামের প্রস্তাব অনুযারি চারজন ব্লগার গ্রেফতার ও ব্লগার নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় মৃত্যুর পর লেখালেখির কিছু দিকের ওপর লিখতে বারণ করে দেয়া পুলিশ প্রশাসনের বক্তব্যে দুষ্কৃতিকারীরা শুধু সবুজ সংকেত পেয়ে গেছে বলে মনে করেন। তাছাড় সুপ্রিম কোর্ট থেকে ’৭২-এর সংবিধান সম্পূর্ণ পুনঃবহালের পরও তার কিছু কিছু জায়গায় গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন করে পঞ্চদশ সংশোধনও দুষ্কৃতিকারীদের প্রশ্রয় দিয়েছে। তিনি প্রশ্ন করেন, ‘মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে যে চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশকে গড়ে তোলা দরকার, আমরা কি সেই পথে আছি? থাকলে কেন এই ধরনের হত্যাকাণ্ডগুলো একটার পর একটা হয়ে যাচ্ছে, তার কোনো বিচার হচ্ছে না? বরঞ্চ উল্টো এরা প্রশ্রয় পেতে পারে কেন–এমন সব কথাবার্তা বলছি , আইন প্রণয়ন করছি? কী কারণে?’ আশ্চর্যের বিষয়, রাষ্ট্রে একের পর এক হত্যাকাণ্ডের পরও দেশের বুদ্ধিজীবী মহলে জোড়ালো প্রতিবাদ হচ্ছে না। ভারতে ‘রাষ্ট্রে অসহিষ্ণুতা’র জন্য দেশের সাহিত্যিক-বিজ্ঞানী-সাংস্কৃতিক কর্মীরা প্রতিবাদের বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় ও অ-রাষ্ট্রীয় পদক ফিরিয়ে দিয়ে রাজপথে নামছে, কিন্তু আমাদের দেশে এমন নজির নেই দেখে তিনি ক্ষোভে বলে, ‘আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবীদের সেই মানসিকতা নেই। সবাই তো বিক্রি হয়ে আছে। তুমি কাকে বুদ্ধিজীবী বলবে, বুদ্ধিজীবী আছে কেউ আমাদের দেশে?’ তবে তিনি মনে করেন এই ঘোর অমানিশা থেকে বেরিয়ে আসার একমাত্র উপায় হচ্ছে ‘জনগণের কাছে যাওয়া, তাদের উদ্বুদ্ধ করা। যে কাজটা গণজাগারণ মঞ্চ করেছিল। সেই মঞ্চ ভেঙে দেয়ার কারণে এবং হেফাজতের সঙ্গে বিনিময়ে তাদেরকে উচ্ছেদ করার ফলে তার ফল এখন ভোগ করতে হচ্ছে।’

—————————

চাপাতির কোপ খেয়ে মরতে চাই না

nirmalendu-goon.jpg
নির্মলেন্দু গুণ
—————————
বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে আছেন জনপ্রিয় কবি নির্মলেন্দু গুণ। অবস্থা এমন, শুধু লেখা নয়, লেখক হত্যা নিয়ে মন্তব্য করাও এখন ঝুঁকির বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে। তিনি বলেন, ‘এই বৃদ্ধ বয়সে চাপাতির কোপ খেয়ে মরতে চাই না। আমি ভীত বোধ করছি। এটাই প্রমাণ করে যে এদের বিরুদ্ধে কথা বলতেও আমি ভয় পাচ্ছি। এতগুলো হত্যাকাণ্ডের কোনোটারই বিচার হলো না–এটা উদ্বেগজনক। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এটুকুও বেশি বলে ফেললাম। আমি স্বাভাবিক মৃত্যুর অপেক্ষায় আছি। ‘

জন্মদিন নিয়ে গুণের কবিতার সেই বিখ্যাত লাইন ‘আমরা জন্মের প্রয়োজনে ছোট হয়েছি, এখন মৃত্যুর প্রয়োজনে বড় হচ্ছি।’ বর্তমান অবস্থা নিয়ে বিস্তুত মন্তব্য না করলেও সংক্ষিপ্ত মন্তব্যের মধ্যে তিনি তার আশংকা উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন।

—————————

রাস্তায় নেমে এদের প্রতিহত করতে হবে

mohammod-rafiq.jpg
মোহাম্মদ রফিক
—————————
বাংলা কবিতায় ষাটের দশকের অন্যতম প্রধান স্বর ও সাবেক বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক মোহাম্মদ রফিক দেশের বর্তমান অবস্থায় ভীষণ ক্ষুব্ধ। তিনি মনে করেন, ‘মুক্ত মনের চর্চাটাকেই বন্ধ করে দেয়ার চেষ্টা। এখন এটাকে প্রতিরোধ করার পথ কী, তা আমাদের ভাবতে হবে। আমাদের সচেতন নাগরিকদের এগিয়ে আসতে হবে। এবং আমাদের আর ঘরে বসে থাকলে চলবে না, যাদের যে ক্ষমতা আছে, রাস্তায় নেমে এদের প্রতিহত করতে হবে।’ কিন্তু উগ্রবাদীদের হাতে নিহত শেষ কয়েকটি হত্যাকাণ্ড দেখে একটা জিনিস পরিষ্কার যে, ঘরও আজ নিরাপদ নয়। সন্ত্রাসীরা ঘরে-অফিসে গিয়ে গিয়ে হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছে। ‘কোথাও নিরাপদ না’ মোহাম্মদ রফিক বলেন, ‘এই যে আমি এখন বারান্দায় বসে আছি, কিন্তু আমি তো নিরাপদ বোধ করছি না। কিন্তু লুকিয়ে থেকে এই পশু শক্তির হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে না।’ কিন্তু রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা ব্যক্তিরা একে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলছেন। অথচ দেশে ধারাবাহিক হত্যাকাণ্ড ঘটছে। ‘না না, এটা বলে তো তারা মিথ্যাচার করছেন।’ তিনি আশ্চর্যবোধ করেন একে বিচ্ছিন্ন বলা হয় কি করে! ‘একের পর এক হত্যা হচ্ছে।’ ব্লাগারদের তিনি ‘লেখক’ মর্যাদাই দেন। হুমায়ূন আজাদ থেকে শুরু করে ব্লগ লেখকদের হত্যার পর এখন প্রকাশকদের হত্যাকাণ্ডকে তিনি মনে করেন আমাদের অমর একুশে বইমেলাকেই বন্ধ করে দেয়ার একটি প্রক্রিয়া। কারণ অনেক আগে থেকেই বাংলা একাডেমি আয়োজিত এই বইমেলাকে বন্ধের জন্যও হুমকি দিয়ে আসছে বারবার। ‘এরা দেশটাকে পুরোপুরি মধ্যযুগের মূর্খামির ভেতর নিয়ে যাওয়া জন্য পায়তারা করছে। কিন্তু এদেরকে ঠেকানোটা আমাদের একটা কর্তব্য। জাতীয় কর্তব্য। পবিত্র কর্তব্য।’
‘বিশ্বের সর্বত্রই এই ধরনের ঘটনা ঘটছে। কিন্তু আমরা মুক্তিযুদ্ধের দেশ। আমরা মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীন হয়েছি। ত্রিশ লক্ষ মানুষ শহীদ হয়েছে, দুই লক্ষ মা-বোন সম্ভ্রম হারিয়েছে। সুতরাং আমাদের অবস্থানটা পৃথিবীর অন্যদের মতো নয়। আমাদের অবস্থান সিরিয়া, সৌদি আরব—এদের মতো নয়। তাই আমাদের দেশে এই ধরনের ঘটনা ঘটবে আর আমরা সহ্য করে যাবে মুখ বুজে, এটা তো হতে পারে না। আমরা রক্ত দিয়েছি। ভবিষ্যতে রক্ত দিয়ে হলেও এদের প্রতিহত করতে হবে। তরুণদের এ ব্যাপারে উৎসাহিত হওয়া উচিত। কারণ সব সময় যুবকরাই সামনে এগিয়ে যাওয়ার জোয়ালটা কাঁধে তুলে নেয়।’ তিনি মনে করেন ‘সরকার যদি দ্বিধাগ্রস্থ না হতো, সরকার যদি স্পষ্ট ভূমিকা রাখতো বা এগিয়ে আসতো, তাহলে এই ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে না।’ এই ঘটনা ‘সরকারের মুখে ছাই ফেলার মতো অবস্থা। সরকারের লজ্জিত হওয়া উচিত।’

—————————

বেশির ভাগই সব ‘দল-দাস’ হয়ে গেছে

hayder-akbar-khan-rano-1.jpg
হায়দার আকবর খান রনো
—————————
বর্ষিয়ান রাজনীতিক ও লেখক হায়দার আকবর খান রনো একের পর এক ব্লগার হত্যা, এখন প্রকাশকে হত্যার ঘটনাকে দেশের এক অশনিসংকেত হিসেবে মনে করেন। তাছাড়া অতীতের কোনো ঘটনার কূলকিনারা করতে না পারা ও নতুন করে ঘটনার জন্য তিনি সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলকেই দায়ি করেন। ‘আমি তো অবাক হয়ে যাই দেশে এতোগুলো ঘটনা ঘটে গেল, অথচ সরকার কোনো স্টেপ নিতে পারলো না। এদের মধ্যে আশিকুর বাবুর হত্যাকারীকে তো সরাসরি ধরিয়ে দেয়ার পরও কিছু হয় না। আমাদের বুদ্ধিজীবী মহলের অল্প সংখ্যক লোকসবাদে বেশির ভাগই সব ‘দল-দাস’ হয়ে গেছে। বুদ্ধিজীবী নেই, হয় এই দলের দাস নয় ওই দলের দাস।’ জনগণ সচেতন আছে বলে তার অভিমত। তাই এই অচলাবস্থা দূর করার জন্য সরকারকেই প্রথমে এগিয়ে আসতে হবে। ‘সেই দায়িত্ব সরকারের। সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে। এই জঙ্গিদেরকে ধরা, পুলিশ-গোয়েন্দা দিয়ে তাদের নির্মূল করবে সরকার। জনগণ সচেতন আছেন, জনগণ তাদের সাপোর্ট দিচ্ছে না।’

(বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম থেকে)

 

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.