নতুন রাষ্ট্রপতি ক্ষমতায় থাকবেন ৫ বছর: জটিলতার আশঙ্কা

মার্চ ২২, ২০১৩

image_1099_309537ঢাকা জার্নাল: আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট অথবা অন্য কোন দল ক্ষমতায় এলে রাষ্ট্রপতির পদ নিয়ে জটিলতা তৈরি হতে পারে।

কেননা সংবিধানের ৫০ (১) অনুচ্ছেদে বলা আছে, রাষ্ট্রপতি তার কার্যভার গ্রহণের তারিখ হতে পাঁচ বছর পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন। সুতরাং গুরুতর কোনো অভিযোগে তাকে যদি ইমপিচ বা অভিশংসন করা না হয়, সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতিকে তার পদ থেকে সরানো বেশ কঠিন। আবার অভিশংসন করতে হলে সংসদের দুই তৃতীয়াংশ সদস্যের ভোট দরকার হবে। তবে আগামী নির্বাচনে আবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে এই জটিলতার আশঙ্কা নেই।

সংবিধানের ১২৩ (২) অনুচ্ছেদ অনুসারে রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করতে হবে। সে হিসাবে আগামী ১৯ জুনের মধ্যে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করতে হবে। রাষ্ট্রপতি সরাসরি ভোটে নয়, সংসদ সদস্যদের ভোটে নির্বাচিত হন। তবে তফসিল ঘোষণাসহ এই নির্বাচন পরিচালনা করে নির্বাচন কমিশন।

মোঃ জিল্লুর রহমানের পরে কে হচ্ছেন দেশের রাষ্ট্রপতি, তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা চলছে। দুজন ব্যক্তির নাম এক্ষেত্রে শোনা যাচ্ছে। বর্তমানে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্বে থাকা অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ (স্পিকার) এবং সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী।

এ দুজনের যাকেই রাষ্ট্রপতি করা হোক না কেন, আগামী নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসবে, তাদের নানাবিধ রাজনৈতিক জটিলতার মধ্যে পড়তে হতে পারে। এমনকি দেশের রাজনীতি যেভাবে সংঘাতময় হয়ে উঠেছে, তা অব্যাহত থাকলে এক পর্যায়ে জরুরি অবস্থা জারির মতো অপ্রিয় কাজও রাষ্ট্রপতিকে করতে হতে পারে।

আবার এমন কাউকে রাষ্টপ্রতি করার ব্যাপারে আওয়ামী লীগ চিন্তা ভাবনা করবে, যিনি নির্বাচনের আগে আগামী আট-নয় মাস এবং নির্বাচন পরবর্তী চার বছর (মোট পাঁচ বছর) দায়িত্ব পালন করতে পারেন।

কিন্তু জটিলতা তৈরি হতে পারে যদি আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচনে হেরে যায়। সেক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দল চাইবে তাদের দলের মধ্য থেকে কাউকে রাষ্টপ্রতি করতে। কিন্তু যদি তাদের দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকে এবং রাষ্ট্রপতিকে ইমপিচ বা অভিশংসন করতে ব্যর্থ হয় এবং রাষ্ট্রপতি নিজের থেকে যদি পদত্যাগ না করেন, তাহলে পরিস্থিতি খুবই ঘোলাটে হবার আশঙ্কা আছে। যদিও ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের পুরো শাসনামলেই রাষ্ট্রপতি ছিলেন বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদ, যিনি আওয়ামী লীগ নেতা ছিলেন না।

প্রসঙ্গত, রাষ্ট্রপতি মোঃ জিল্লুর রহমান দায়িত্ব গ্রহণের চার বছর এক মাসের মাথায় বুধবার বিকেলে সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি রাষ্ট্রপতি থাকা অবস্থায় স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করলেন এবং কোনো ধরণের বিতর্কের জন্ম দেননি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল থেকে ১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারি পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি ছিলেন। যদিও মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তিনি পাকিস্তানে কারাবন্দী থাকার কারণে তখন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে সৈয়দ নজরুল ইসলাম দায়িত্ব পালন করেন।

স্বাধীনতার পরে দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি দেশে সংসদীয় পদ্ধতি চালু করে প্রধানমন্ত্রী হবার পরে ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি থেকে ১৯৭৩ সালের ২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। এরপর মোহাম্মদউল্লাহ দায়িত্ব পালন করেন ১৯৭৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর থেকে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত। ওইদিন বাকশাল গঠন করে বঙ্গবন্ধু আবার দেশে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারব্যবস্থা চালু করেন এবং তিনি রাষ্ট্রপতি হন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তিনি সপরিবারে নিহত হন।

১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু নিহত হবার পর তৎকালীন বাণিজ্যমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদ রাষ্ট্রপতি হন। তিনি ওই বছরের ৬ নভেম্বর পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি ছিলেন। ওইদিন জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত করা হয় এবং বিচারপতি আবু সাদত মো. সায়েম রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হন। তিনি ১৯৭৬ সালের ২০ এপ্রিল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন। যদিও ওই সময়ে প্রকৃত ক্ষমতার মালিক ছিলেন সামরিক প্রশাসক মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান।

২১ এপ্রিল বিচারপতি সায়েমকে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয় এবং প্রধান সামরিক প্রশাসক জিয়াউর রহমান নিজেই রাষ্ট্রপতি হন। তিনি একই সঙ্গে রাষ্ট্রপতি এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হন। তিনি ১৯৮১ সালের ২৯ মে পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি ছিলেন। ৩০ মে তিনি চট্টগ্রাম সার্কিট হউজে নিহত হন।

এর পরদিন ৩০ মে থেকে ১৯ নভেম্বর পর্যন্ত বিচারপতি আবদুস সাত্তার ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং ২০ নভেম্বর থেকে ১৯৮২ সালের ২৩ মার্চ পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি ছিলেন। ১৯৯৮২ সালের ২৪ মার্চ হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ক্ষমতা দখল করেন এবং তিনদিনের মাথায় ২৭ মার্চ আ ফ ম আহসানউদ্দিন চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি করেন। তিনি ১৯৮৩ সালের ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি ছিলেন। এরপর ১৯৮৩ সালের ১১ ডিসেম্বর এরশাদ রাষ্ট্রপতি হন এবং ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকেন। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর তিনি বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে বাধ্য হন এবং শাহাবুদ্দিন আহমেদ অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে ১৯৯১ সালের ৯ অক্টোবর পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। অর্থাৎ এ পর্যন্ত এরশাদ ছাড়া কেউই রাষ্ট্রপতির মেয়াদ শেষ করতে পারেননি। আবার এরশাদ মেয়াদ পূর্ণ করলেও তিনি বহু বিতর্কের জন্ম দেন।

’৯১-এর নির্বাচনের পর বিএনপি সরকার গঠন করলে আবদুর রহমান বিশ্বাস দেশের রাষ্ট্রপতি হন এবং ১৯৯১ সালের ৯ অক্টোবর থেকে ১৯৯৬ সালের ৯ অক্টোবর পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। তিনি পূর্ণ মেয়াদে রাষ্ট্রপতি ছিলেন। কিন্তু মৃত্যুবরণ করেছেন এরপরে।

’৯৬-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে এবং বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদকে রাষ্ট্রপতি করা হয়। তিনিও পূর্ণ মেয়াদে ১৯৯৬ সালের ৯ অক্টোবর থেকে ২০০১ সালের ১৪ নভেম্বর পর্যন্ত দায়িত্বে ছিলেন। তিনি এখনও জীবিত এবং দায়িত্ব পালনকালে কোনো ধরণের বিতর্কের জন্ম দেননি।

২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসে এবং একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী রাষ্ট্রপতি হন। তিনি দায়িত্ব নেন ২০০১ সালের ১৪ নভেম্বর এবং দেড় বছরের মাথায় ২০০২ সালের ২১ জুন রাষ্ট্রপতির পদ থেকে সরে যেতে বাধ্য হন। এরপর ২০০২ সালের ২১ জুন থেকে ৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এদের কেউই বেশিদিন রাষ্ট্রপতি পদে থাকতে পারেননি। দুজনই এখনও জীবিত এবং রাজনীতিতে সক্রিয় আছেন।

ওই বছরের ৬ সেপ্টেম্বর অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহমেদকে রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত করা হয় এবং তিনি ২০০৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দায়িত্বে ছিলেন। তার মেয়াদ শেষ হবার পরেও দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতি কারণে তিনি অতিরিক্ত দুই বছর রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। সম্প্রতি তিনি ইন্তেকাল করেন। এক-এগারোর মতো পরিস্থিতি তৈরির জন্য তাকে দায়ী করা হয়।

সবশেষ ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার গঠন করলে মোঃ জিল্লুর রহমান ২০০৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন। দায়িত্ব নেয়ার চার বছরের কিছু বেশি সময় পরে তিনি ইন্তেকাল করলেন।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.