যুক্তরাজ্যে ঈদের কোরবানি কিভাবে দেয়

সেপ্টেম্বর ২৪, ২০১৫

kkkঈদুল আজহা মানেই বেশ কয়েক দিন আগ থেকেই জায়গায় জায়গায় পশুর হাট; ট্রাকভর্তি গরু-ছাগল আনা নেওয়ার দৃশ্য। সঙ্গে আছে পশুর হাটের কারণে সৃষ্ট যানজটে মানুষের ভোগান্তি; সামর্থ্যের মধ্যে পছন্দের গরু কিনতে হাট থেকে হাটে ঘোরাঘুরি। এসবের মধ্যে আবার দেখা মেলে হঠাৎ গরুর রশি ধরে লোকদের বাড়ি ফেরার দৃশ্য। চলে জনে জনে আলোচনা কে কী কোরবানি দিচ্ছেন? কবে কিনছেন কোরবানির পশু? অবশেষে ঈদের দিন নামাজ শেষে পশু কোরবানি। অতঃপর কাটাকাটির পর চলে ভূরিভোজ। এটাই বাংলাদেশের কোরবানির ঈদের চিরায়ত দৃশ্য।

আজ বৃহস্পতিবার যুক্তরাজ্যে ঈদুল আজহা পালিত হচ্ছে। কিন্তু ভিন্ন জাতির ভিন্ন সংস্কৃতির যুক্তরাজ্যের মুসলমানরা কী একইভাবে কোরবানি দিচ্ছেন? মোটেই না। এখানে পশুর হাট বসানোর সুযোগ যেমন নেই, তেমনি চাইলেই কেউ যেখানে সেখানে পশু জবাই দিতে পারেন না। এখানকার মানুষ কোরবানির পশুর গোশত দেখেন, কিন্তু পশু দেখেন না। তাই বলে যে এখানকার মুসলমানদের মধ্যে কোরবানি দেওয়ায় অতৃপ্তি আছে, তা কিন্তু নয়।

যুক্তরাজ্যে কেবল কিছু সুনির্দিষ্ট স্থানে (স্লটার হাউস বা ফার্ম হাউস) পশু জবাইয়ের অনুমতি রয়েছে। যে কারণে সাধারণ মানুষ চাইলেই পছন্দমতো পশু কিনে ইচ্ছেমতো স্থানে জবাই দিতে পারেন না। হালাল মাংস বিক্রি করে এমন দোকানগুলো মানুষের কাছ থেকে কোরবানির আদেশ (অর্ডার) নেয়। দোকানগুলো তাদের মাংস সরবরাহকারীর (সাপ্লায়ার) মাধ্যমে গ্রাহকের চাহিদামতো পশু কোরবানি দেয়।

গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় পূর্ব লন্ডনের বাংলাদেশি অধ্যুষিত হোয়াই চ্যাপেল ও ব্রিক লেন এলাকার বাংলাদেশি মালিকানাধীন বেশ কয়েকটি দোকান ঘুরে কোরবানির বেশ জমজমাট ভাব দেখা গেল।

ব্রিক লেনের তাজ স্টোরের কর্ণধার জামাল খাতা খুলে বেশ মনোযোগ দিয়ে কোরবানির অর্ডারের হিসাব কষছেন। আর পাশের কাউন্টারে চলছে লাইন ধরে মসলাপাতি কেনার ধুম। ব্যাপক ব্যস্ততার মধ্যে জামাল প্রথম আলোর এই প্রতিবেদককে বললেন, ‘অন্যের কোরবানির দায়িত্ব নেওয়ার বিষয়টি ধর্মীয় দিক থেকে বেশ স্পর্শকাতর। তাই খুব সতর্কতার সঙ্গে কার কী নামে কোরবানি হবে, কে কয় ভাগ দিচ্ছেন এবং তাদের যোগাযোগের নম্বর লিখে রাখতে হচ্ছে।’

ঈদের দু এক সপ্তাহ আগ থেকে তাঁরা কোরবানির অর্ডার নেওয়া শুরু করেন। গতকাল বুধবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত তাঁরা ২৭২টি ভেড়া কোরবানির ফরমায়েশ পেয়েছেন। আর ভাগে গরু কোরবানির ফরমায়েশ পেয়েছেন তিনটি। ঈদের দ্বিতীয় দিন এবং তৃতীয় দিনও তাঁদের কাছে কিছু পশু কুরবানির আদেশ আছে বলে জানান জামাল।

ব্রিক লেনের কিছুটা অদূরে বাংলা টাউন ক্যাশ অ্যান্ড কারিতেও একই রকম ভিড় দেখা গেল। এই দোকানের কর্ণধার রফিক হায়দার বলতে চাইলেন না তাঁরা কোরবানির কী পরিমাণ অর্ডার পেয়েছেন। বললেন, সংখ্যাটা ‘ব্যবসায়িক সিক্রেট’। তবে অর্ডার অন্যবারের তুলনায় বেশ বেড়েছে বলে জানান তিনি।
একইভাবে ব্রিক লেনের জমজম ব্রাদার্স, হোয়াইট চাপেলের প্রিমিয়ার বাজার কিংবা ক্যানারি ওয়ার্ফের ক্লিফটনেও কোরবানির অর্ডার গতবারের তুলনায় বেড়েছে।
প্রসঙ্গত, ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী যুক্তরাজ্যে প্রায় ৩০ লাখ মুসলমানের বসবাস।

দোকান মালিকেরা জানান, ভেড়া ও গরুর সমস্ত ওজন মেপে দাম নির্ধারণ হয়। প্রতিটি ভেড়া জন্য ১৪০ থেকে ১৬০ পাউন্ড (প্রায় ১৬ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা) এবং গরুর এক ভাগের জন্য দু শ থেকে আড়াই শ পাউন্ড (২৪ হাজার টাকা থেকে ৩০ হাজার টাকা) পর্যন্ত মূল্য নিচ্ছেন তাঁরা।

ভেড়া কোরবানির মাংস ঈদের দিন বিকেলেই গ্রাহক পেয়ে যান। কিন্তু গরুর মাংস আসে ঈদের পরের দিন। দোকানিরা জানান, একসঙ্গে এতগুলো পশুর চাহিদা মেটাতে তাঁরা রমফোর্ড, অক্সফোর্ড, বার্মিংহাম ল্যাঙ্কাশায়ার ও লেস্টারশায়ারসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের ফার্মহাউসগুলোতে পশু জবাইয়ের ব্যবস্থা করেন। তাই যথাযথ প্রক্রিয়া শেষ করে মাংস গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দিতে কিছুটা সময় লাগে।

তবে কিছু কিছু দোকান আছে যারা ঈদের নামাজ শেষ হওয়া মাত্রই গ্রাহকদের কোরবানির মাংস দেওয়া শুরু করে। যেহেতু ঈদের নামাজের আগে পশু কোরবানির বিধান নেই, তাই এসব দোকান যথাযথভাবে কোরবানির দায়িত্ব পালন করছে কি না-তা নিয়ে অনেকের মধ্যে সন্দেহ রয়েছে।
বাঙালি দোকানগুলোর পাশাপাশি পাকিস্তানি, তুরস্ক কিংবা অন্যান্য দেশীয় হালাল মাংসের দোকানগুলোও পশু কোরবানির অর্ডার নিয়ে থাকে। যুক্তরাজ্যে মুসলমানদের উপস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে ‘টেসকো’ কিংবা ‘আসডা’র মতো বহুজাতিক সুপারমার্কেটগুলোতে হালাল মাংসের কাউন্টার রাখা হয়েছে। এসব সুপারমার্কেটগুলোও বেশ কয়েক বছর যাবৎ পশু কোরবানির অর্ডার নিচ্ছে।

পূর্ব লন্ডনের সারে কিস’র টেসকো এক্সট্রাতে কাজ করেন বাংলাদেশি মোবারক হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এবার তাঁরা তিন শতাধিক ভেড়া কোরবানির আদেশ পেয়েছেন। প্রতিটির মূল্য ধরা হয়েছে ৯৭ পাউন্ড (প্রায় সাড়ে ১১ হাজার টাকা)। ঈদের একদিন পর শনিবার তারা কোরবানির মাংস সরবরাহ করবে।

অবশ্য চাইলে যে কেউ ফার্মহাউজে গিয়ে কোরবানির পশু পছন্দ করে জবাই করিয়ে নিয়ে আসতে পারেন। ব্যাপারটি তেমন সহজ নয় বিধায় ফার্মহাউজে গিয়ে কোরবানি দেওয়ার এই হার নেহাতই কম।

যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশিদের মধ্যে অনেকেই আছেন যাঁরা এখানে কোরবানি না দিয়ে বাংলাদেশে পশু কোরবানির ব্যবস্থা করেন। আবার অনেকে আছেন যাঁরা আত্মীয়স্বজন ও পরিচিতজনদের মধ্যে কোরবানির কাঁচা মাংসও বিলান।

যুক্তরাজ্যে কোরবানি দেওয়ার রীতি যতই ভিন্ন হোক, বাঙালি মুসলিমদের দলবেঁধে নামাজ পড়া, নামাজ শেষে কোলাকুলি কিংবা ঈদের আগের দিনের সূর্য অস্ত যাওয়া মাত্রই মোবাইলে খুদেবার্তা পাঠানোর আমেজটা অটুট আছে ঠিক বাংলাদেশের মতোই।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.