ভয় কে জয় করতে পারে সংস্কৃতি

আগস্ট ২৩, ২০১৫

nila

রওশন আরা লীনা:অত্যন্ত সুন্দর ও আভিজাত্য পূর্ণ পক্ষী হিসেবে ময়ূরের নাম সর্বজন বিদিত।কিন্তু একটা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত ময়ূর নিয়ে আমার একটা ভুল ধারনা ছিলো। ময়ূরের বড় দীর্ঘ ও সুশ্রী লেজ থাকে অনেকে সাহিত্যে কাব্যে। লোকাচারে পেখম বলে উল্লেখ করেছেন ময়ূর তাকে মেলেধরে বর্ষায় শুধু মাত্র একলা নাচের জন্য। পরবর্তীতে আমি দেখেছি না! শুধু বর্ষা নয় প্রজনন কাল। অস্বস্তিকর গরম আরো নানা কারনে ময়ূর তার নিজের ইচ্ছেমতো পেখম মেলে ধরেছে সকলের সামনে কখোনো আনন্দে কখনো কিন্ন অবজ্ঞায়। এবং পক্ষী প্রেমী ও বিদগ্ধ মানুষ মাত্রেই জানেন ময়ূরের কন্ঠ অত্যন্ত কর্কশ ও তার পা অত্যন্ত নোংরা। ময়ূরের খাবার সম্পর্কে ও নানা মতামত রয়েছে। আমি খাবারের কথা নয় আপাতত: দেহস্থিত ময়ূরেরদিকে আপনাদের দৃষ্টি ফেরাতে চাই। বাঙলাদেশ কে, আজকাল আমার সু-কু- মিশ্রিত ঐ ময়ূর পক্ষীর মতো মনে হয়। তার শরীর আজও শ্যামলা সবুজ পলিমাটি। রক্তাভ নীলচে কখনো কালো চোখ সূর্যস্নাত স্বাধীন বাঙলার সজল আকাশ। মাথার উজ্জ্বল ঝুটি সগর্বে ঘোষনা করছে বাঙালীর স্বাধীনতা আর পুচ্ছের বিকশিত বর্ণময় ছটা আর ছন্দবদ্ধ সৌন্দর্য ঘোষনা করছে বাঙালীর ঐতিহ্য ও গৌরব গাথা। কিন্তু তার কর্কশ স্বর দূষিত নষ্ট রাজনীতিকের। সে দাড়িয়ে আছে কদাকার দুই সংস্কৃতিক নগ্ন পদের ওপর। যে পৃথিবীতে সে দাড়িয়ে আছে তাকে সে ও তারমতো ছোট বড় নানা দেশ অস্ত্রে। অগ্রাসনে বাড়িয়ে দেওয়া ঠোট ও নখরের আচড়ে করে তুলছে এক সমস্যা সঙ্কুল, ধংসন্মুখ আস্তাকুড়, তার সুসজ্জিত পালকের তলায় রন্ধ্রে রন্ধ্রে বাস করছে উন পোকা সাদৃশ্য সন্ত্রাসী পরজীবী। আর তারা চুষেখাচ্ছে জাতির শেনিত, মগজ সাদৃশ্য শিক্ষিত ও অশিক্ষিত সাধারণ মানুষকে যারা স্বপ্নদেখেছিলেন সুন্দর বাঙলাদেশের। কিন্তু বর্তমান বাঙালাদেশে পায়েধরে জীবন ভিক্ষার পরো মন গলেনি ওদের। দুইজন হাত,পা, ধরে রাখে আর একজন গলাটিপে হত্যাকরে শিশু আবু সাইদকে, দিনেদিনে সালাউদ্দীনের জন্য বাড়ছে উৎকন্ঠা, এর আগেও হোটেল রুপসীবাঙলার সামনে থেকে তুলেনিয়ে যাওয়া হয় ইলিয়াস আলী কে। ঈশ্বরদীতে আজো সাত বছরের একজন শিশু ধর্ষিত হয়েছৈ।এবং একজন এনজিও কর্মীকে ধর্ষনের পর জোর পূর্বক সালিশের মাধ্যমে ২০ হাজার টাকা গ্রহণে তাকে বাধ্য করা হয়েছে পুলিশের কাছে না যেতে। দেশে চলছে লাগাতর হরতাল অবরোধ কর্মসূচি আর তার সংগে আর তার সংগে চলছে জিম্মি সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক জীবন যাত্রা চালাবার এক নাভিশ্বাস প্রচেষ্টা! নগ্নপদে নোংরা ঘেটে বাংলার রাজনীতিকরা আকন্ঠ পান করছেন আবর্জনা আর সুতো পোকার স্তুতি। বধির ময়ূরের স্তম্ভিত হৃদয় নিয়ে নিশ্চুপ ভয়ে কাতর বাঙলার বিবেক। যেন হত্যা, গুম, অপহরণ, চোরা গোপ্তা হামলা, নারী ধর্ষণ, হরতাল, তার একান্ত নিজস্ব সংস্কৃতি। তাই ঘোরবর্ষণ বা কিশোরীর ঘুঙুরে নেচে ওঠেনা আর ময়ুর পঙ্খী বাঙলাদেশ। আমার দেশ আজ ভয়ে কাতর অস্থির আতংকে কাটাচ্ছে দিন। তার চোখে পেট্রোল বোমা। তার মুখে পুলিশী নির্যাতনের অস্থির আতংক তার জীবনে হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার অনিশ্চিত যন্ত্রনাকাতরতা, তার পরীক্ষা, তার স্বপ্ন সবকিছু পর্যবাসিত এক ব্যর্থ অনিশ্চয়তার। এই নগ্ন জনপদে আলোর দ্বীপ জ্বালকে কারা ?প্রথমত: জীবনানন্দ দাশ আক্ষেপ করেছিলেন ‘ অদ্ভুত আধার ঘনিয়ে এসেছে এক’- দেশের অচল অবস্থা নিয়ে সরকার বেসরকারী নানা বিধ মতামত, বুদ্ধিজীবির কলাম।টকশো-অনুরোধ উপরোধ আমরা বহু পেয়েছি। তবু নি:সাঢ় বাঙালী। কুম্ভকর্ণ আমাদের রাজনীতিকরা। তাই সমাধন তথৈবচ। অথচ আমরা জানি জাতির ক্রান্তিলগ্নে এই বাঙালার মানুষই জেগে উঠেছে বারবার ভেতরের তাগিদে, এক বিরাটতর বোধ ও সংস্কৃতিক ঐক্যে। যদিও মোতাহার হোসেন চৌধুরী  তার সংস্কৃতি কথা প্রবন্ধে বলেছেন ‘ধর্ম সাধারণ মানুষের কালচার আর কালচার শিক্ষিত মার্জিত লোকের ধর্ম’- তবুও সংস্কৃতি বলতে বোঝা হয় এক বিশেষ জাগরণ যা- খ্রিষ্টান, অখ্রিষ্টান, শিক্ষিত, অশিক্ষিত ব্যক্তি নির্বিশেষে এক রকমের জ্ঞানের উৎকর্ষতা ওবোধের ব্যপ্তি। তাই ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে চারণ কবি মুকুন্দদাস জাগিয়ে তোলেন অপামর জনসাধারণ কে আবার হিন্দু মুসলিম বিভেদ ভুলতে রবীন্দ্রনাথ রাখি বাঁধেন সকলের হাতে। এমনি করে- রাখহরি ও আল্লারাখার গল্প যখন পশ্চিম বাঙলায় বাঙলাদেশে লালন করছেন জাতের বিচার, ক্ষুদিরামের ফাঁসি, আমার ভায়ের, রক্তে রাঙানো অথবা মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো প্রমাণ করে শুধুমাত্র রাজনৈতিক কর্মসূচী নয় ব্যপক সাংস্কৃতিক জাগরণ বারবার মানুষকে প্রাণিত করেছে শাসক, শোষক ও সকল অপশক্তিকে রুখে দাড়াতে। আর তার জন্য শিল্পী সাহিত্যিক, কবি সকল চেতনা সম্পন্ন মানুষেরই ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও বোধের জাগরণ দরকার। কারণ রাজনীতি বা স্বাধীনতার ঝান্ডা যারা বহন করছেন আবার যারা করতে চান তাদের বস্তুনিষ্টতা নিয়ে আজ সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। রয়েছে পণ্য চিহ্ন নির্ণয়ক এই বর্তমান পৃথিবীতে আকাশ সংস্কৃতির আগ্রাসন ও অপরিমেয় স্বার্থপর ভোগবাদের মাঝে সত্যিকার ত্যাগ ও ঐতিহ্য মন্ডিত সংস্কৃতিক জাগরণ নিয়ে নবতর বিনির্মানের ঐকান্তিক আশ্বাসের প্রতি ভোগবাদীদের নিরন্তর তাচ্ছিল্য- ডগলাস কেলনের একবার লিখেছিলেন-Although capital produces cars and computers not only to realize profit but also to impose a social system or way of life on individuals, these commodities can be customized, used and circulated for a variety of purpose and gols with a corresponding variety of effects.

আর এই, বক্তব্যের সারবর্ততার সঙ্গে একমত হয়ে বর্তমানে আর একটি বিষয়ো দেখা যায় প্রিন্ট ও মিডিয়ার উপর অত্যাধিক নিয়ন্ত্রন আমাদের সংস্কৃতিক জাগরণ বা আন্দোলনকে একটু হলেও ভোঁতা করে তুলবার প্রয়াস পেয়েছে। যদিও উল্লেখ করা যায় আল ব্যেয়ার কামুর (১৯৩০-৬০) সেই বিখ্যাত বক্তব্য- “দায়িত্বজ্ঞানহীন শিল্পীর যুগ শেষ হয়ে গেছে। শিল্পের স্বাধীনতা মানে শিল্পীর শিল্পীর আরামদায়ক জীবনকে নিশ্চিত করা নয়। “জ্ঞানের অবনতি ঘটেছে এ কথা কামু বিশ্বাস করেন না। তার মতে জ্ঞানের অবনতি তখনই হয় যখন তা সম্ভাব্য ঝুঁকির আশঙ্কা এড়িয়ে লাইব্রেরিতে আবদ্ধ ও কয়েকজন মানবতাবাদীর কুক্ষিগত হয়ে পড়ে” –

আজ আমরা এই আশংকারই প্রায় বাস্তব রূপায়ন দেখছি। সব ভীত কন্ঠস্বর আত্মা হাতড়ে মরছে মুক্তির দরজা। যেন বা এক অবরুদ্ধ দম বন্ধ শঙ্কাজনক অবস্থার মাঝে আটক আমরা। ”এমার্সন” বলেছিলেন- ‘প্রতিটি ‘দেওয়ালই একটি দরজা’ যে দেওয়ালের বিরুদ্ধে আমরা লড়াই করছি সেই দেওয়াল ছাড়া আর কোন মুক্তির মুক্তির পথ আমরা না খুজি”- আর জাতির তীব্র সংকটে সংস্কৃতিই সেই উত্তোলনের দেয়াল ও দরজা যার জন্য আমাদের মুক্তির তীব্রতা বাড়াতে হবে। ছুঁড়ে ফেলতে হবে আমাদের বর্তমানে প্রথাগত নষ্ট রাজনীতির অপসংস্কৃতি। নিয়ে আসতে হবে মানুষের জন্য সুস্থ সুন্দর বৈশ্বিক উদার জন কল্যানমুখী সংস্কৃতির সুস্থ্য চর্চা ও পরিবেশ। আর এই সংস্কৃতি বলতে আমরা শুধু নাটক, সিনেমা বা গানের জাগরণ বলছিনা। আমরা সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবি, সাধারণ মানুষ সকলের সামগ্রিক জাগরণ ও তাদের উন্নর্ততর কৃষ্টির চর্চা ও সকলের জন্য সমসুবিধার কথা বলছি। শুধুমাত্র সংস্কৃতিক চর্চাই পারে মানুষকে সেই দু:সাহসের ইন্ধন যোগাতে যাতে করে বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনে রাজপথে বুক পেতে দিয়ে বাঙালি গাইতে পারে ”ওরা আমারা মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়” আবার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে কন্ঠ তোলে ”ডিম পাড়ে হাসে, খায় বাগ ডাসে” পূর্ণিমার ওপর হওয়া অত্যাচারে অভিনীত হয়- এক উজ্জল অমাবশ্য পূর্ণিমায়’-অথবা বৃহৎ জাগরণের টানে যেদিন প্রানো ভয় উপেক্ষা করে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল হাজারো মানুষ আর তাদের উৎসাহ দিতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে গান গেয়েছেন অজস্র শিল্পী। লিখেছেন অনেক কবি ও প্রাবন্ধিক। এই সম্পর্কে কামুর বক্তব্য – টাকা, বা চিহ্নের উপর অর্থাৎ প্রতীকের উপর প্রতিষ্ঠিত যে, ঝুটো সমাজ, সেখানে মানুষের ইন্দ্রিয়জ বাসনাকেও মনেকরা হয় কৃত্রিম। তাই অবাক হওয়ার কিছুই নেই যে, এই সমাজ একই সঙ্গে কয়েদখানা আর অর্থ দপ্তরের দেয়ালে খোদাই করেরাখে “মুক্তি আর সমতা” এই শব্দ দুটো। এই ভাবেই সমাজ তৈরী করে নিয়েছে তার ধর্ম আর ন্যায়নীতির সংহিতা, কিন্তু কথা হলো শব্দকে দিয়ে ইচ্ছেমতো বেশ্যা গিরি করানো যায় না” – ঠিক এই কারণেই বোধ সম্পন্ন সংস্কৃতিবান মানুষের উপর যুগে যুগে কালে কালে এসেছে নানা ঘাত প্রতিঘাত। কিন্তু বিবেকবান মানুষ কখনও সাধারণ মানুষ কখনও বিশেষ কোন ঘটনা মানুষকে জাগিয়েছে তার ভেতরে বোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে সময়ের সাথে  সংগ্রাম করতে । প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে জানা যায় ইতিহাসের ঊষালগ্ন থেকে যুগে যুগে দূর দূরন্তথেকে অগন্তি জাতি ও ধর্মের মানুষ এসে বসতি গড়েতুলেছেন এদেশের নদীতটে । আর তাদের মিলিত সাধনায় বিকশিত হয়েছে আমাদের আজকের সংস্কৃতি । কিন্তু বার বার সেই সহজ উর্বরা সমতটে পড়েছে শোন্যের দৃষ্টি । তবু সময়ের থেকে এগিয়ে থাকা মানুষ জেল থেকে জেলে ঘুরে আলোদিয়ে আলো জ্বালাবার দায় অনুভব করেন বিপ্লবী রনেশ দাশগুপ্ত নির্ভয়ে উচ্চারণ করেন ‘স্বাধীনতার আদর্শকে আজ স্বাধীন করা দরকার’- দেশের ক্রান্তি, অস্থিরতা, তার জ্বালাময় নিধন দিনে সকলে যখন ভয়ের সংস্কৃতিতে চুপকরে অভ্যস্ত হতে চাইছি আপন গর্তে তখন একমাত্র সুস্থ সংস্কৃতিক চর্চা ও প্রবলতর সংস্কৃতক জাগরণ ই পারে জাতিকে, মুক্তির পথ দেখাতে, কম্পিউটর, ইন্টারনেট ব্যবহার করে জ্বালাময়ী ষ্ট্যাটাস দিয়ে নয়, গণজাগরণের মত ক্ষণ বিচ্ছিন্ন আন্দোলন নয় বরং সমগ্র মানুষকে সঙ্গে নিয়ে আস-সমুদ্র হিমাচল পর্যন্ত আওয়াজ তোলা ও ভয়ের সংস্কৃতিকে জয়করে হাতেহাত, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বলি পক্ষীময়ূর নয় গরবী গরীয়সী মাতৃভূমি সোনার বাংলা গড়বার বৃহৎ সংস্কৃতিক আন্দোলনের জন্য আসুন আজ সকলে মিলে ঐক্যবদ্ধ হই।

রওশন আরা লীনা,গবেষক,বাংলা বিভাগ,ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়,কুষ্টিয়া।

 

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.