এইডস মহামারী বলে কিছু নেই!

মার্চ ১৭, ২০১৩

women-aidsঢাকা জার্নাল: (লিখেছেন অনার্য সঙ্গীত)-

  • এইচআইভি নামের ভাইরাসটি এইডস রোগের জন্য দায়ী। এইডস হলে শরীরের নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা দূর্বল হয়ে যায়। এরকম পরিস্থিতিতে, আপাত নীরিহ রোগগুলোই ভয়াবহ হয়ে ওঠে। এইডস কথাটার লম্বা মানেও সেই কথাই বলে। সহজ বাংলায় বললে, এইডস অর্থ “রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়ার লক্ষণ”! রোগীর রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেছে সেটা বোঝা যাচ্ছে, কারণ রোগী নানারকম সহজ-কঠিন রোগে আক্রান্ত! রোগ সারছে না! শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেছে বলেই সারছে না!

ডুয়েসবার্গ কী বোমা ফাটিয়েছেন সেটা আগের লেখাতেই বলেছি। তিনি বলতে চেয়েছেন, এইডস নিয়ে তোমরা অনর্থক লাফাচ্ছ! লাফালাফি বন্ধ করা দরকার! কারণ,

  • এইডস কোনো মহামারী নয়।
  • এইচআইভি ভাইরাসটিই যে এইডসের জন্য দায়ী তার শক্ত প্রমাণ নেই। ভাইরাসটি বরং নীরিহ!
  • এবং, এইডসের বর্তমান চিকিৎসা ক্ষতিকর! লোক এইডসে নয়, মরছে ওষুধে!

এইডস মহামারী বিষয়ে ডুয়েসবার্গের বিরোধীরা দুইভাগে বিভক্ত। একভাগ, যাঁরা কতটা বৈজ্ঞানিক কথা বলেন তা নিয়ে সন্দেহ আছে! এঁরা বিজ্ঞানের চাইতে ধর্মে বেশী মানানসই! দূর দূর! বুড়ো পাগল! যত্তসব! এতদিন পরে এসেছে ঝামেলা করতে! ওর ওসব খোঁড়া যুক্তি! ওর বংশ ভালো না! …ইত্যাদি কথা বলে এঁরা ডুয়েসবার্গের বিরোধীতা করেন। সঙ্গত কারণেই এই ধরনের বক্তব্য অন্তত বিজ্ঞানে পাত্তা দেয়া হয়না! ডুয়েসবার্গকেও আমি কোথাও দেখিনি এই শ্রেনীকে পাত্তা দিতে। বরং তিনি বিরোধীদের দ্বিতীয় দল, যাঁরা বৈজ্ঞানিক যুক্ত দিয়েছেন, তাঁদের যুক্তিগুলি ধরে ধরে নাকচ করবার চেষ্টা করেছেন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতেই! এই লেখাটিতে আমি ডুয়েসবার্গের নিজের যুক্তি-প্রমাণ অংশগুলো সংক্ষেপে বলব তাঁর সাম্প্রতিক গবেষণাপত্র থেকে। যেখানে যেখানে প্রয়োজন মনে হবে, সেই অংশগুলো খানিকটা ব্যাখ্যা করারও চেষ্টা করব।

———————————————————————————————

মূল অংশে যাওয়ার আগে সংক্রমণ বিজ্ঞান সম্পর্কে ধারনা নেই এরকম পাঠকের জন্য কিছু তথ্য দেয়া দরকার। এই লেখাটিতে বিস্তারিত বলা সম্ভব নয়, খুব সংক্ষেপে বলার চেষ্টা করি।

প্যাসেঞ্জার ভাইরাস হচ্ছে সেইসব ভাইরাস যেসব ভাইরাস সংক্রমণ ঘটালেও রোগ সৃষ্টি করে না! প্যাসেঞ্জার ভাইরাসে সংক্রামিত মানুষ সুস্থ ভাবে জীবন যাপন করে! এই ভাইরাসে আত্রান্ত মানুষের অন্যসব রোগ হতে পারে ঠিক কিন্তু সেগুলোর সঙ্গে এই ভাইরাসের সম্পর্ক থাকতে হবে তেমন কোনো কথা নেই!

– এইডসের জন্য দায়ী ভাইরাসটি রেট্রোভাইরাস পরিবারের অন্তর্ভূক্ত। রেট্রোভাইরাস হচ্ছে তারা যাদের ডিএনএ নেই, আছে আরএনএ। (সংযোজন: এরাই একমাত্র আরএনএ ভাইরাস নয়। রেট্রোভাইরাস সম্পর্কিত বিস্তারিত আলোচনা এই লেখাটির উদ্দেশ্য নয় বলে সেই প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেলাম)।

– ভাইরাস কোষকে সংক্রামিত করে তার ডিএনএ দিয়ে। সংক্রমণকারী ভাইরাসের ডিএনএ গিয়ে কোষের ডিএনএ তে জুড়ে যায়! তারপর ওই ডিএনএর বদোলতেই কোষের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় ভাইরাসের কাছে! কোষের ডিএনএ তে ভাইরাসের ডিএনএ থাকা মানেই তাই ওই কোষটি ভাইরাস দ্বারা সংক্রামিত হয়েছে! তাই কোষে ভাইরাস সংক্রমণ হয়েছে কীনা তা পরীক্ষার একটি পদ্ধতি হচ্ছে কোষের ডিএনএ’তে ভাইরাসের ডিএনএ আছে কিনা তা পরীক্ষা করে দেখা!

– ভাইরাস সংক্রমণ পরীক্ষার আরেকটি উপায় হলো অ্যন্টিবডি পরীক্ষা! একটা ক্ষতিকর কিছু শরীরে ঢুকলেই শরীরের বিশেষ কোষেরা সংকেত পেয়ে সেটার জন্য অ্যান্টিবডি বানাতে থাকে। (পড়তে পারেন: এই লেখাটি) । অ্যান্টিবডির ধর্ম হচ্ছে তা খুব রক্ষণশীল। তারমানে, কমলালেবুর জন্য কোনো অ্যান্টিবডি থাকলে তা ওই কমলালেবুতেই জোড়া লাগবে। আম-আপেলে তার রুচি হবে না। কারো শরীরে এইচআইভি ভাইরাসের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি আছে মানেই সে এইচআইভি ভাইরাস দ্বারা সংক্রামিত। সংক্রমণ না ঘটে থাকলে তার শরীরে ওই অ্যান্টিবডি স্বাভাবিকভাবে তৈরি হবে না। ব্যাপারটা এমন, গ্রামে পুলিশ আছে মানে চোরও এসেছে! চোর না থাকলে পুলিশ আসবে কেন!

– অনেক বছর আগে, যখন পাপের ফলে রোগ হত, সেই সময়ে ফরাসী মহামানব বিজ্ঞানী লুই পাস্তুর রোগের জীবাণু তত্ত্ব (Germ Theory of Diseases) দেন। এই তত্ত্ব বলে, জীবাণুর আক্রমণে রোগ হতে পারে। রোগীর দেহ থেকে জীবাণু সুস্থ লোকের দেহে সংক্রামিত হয়ে তাকেও অসুস্থ করে ফেলতে পারে। এই তত্ত্বটির প্রমাণ দেন আরেক মহামানব, জার্মান বিজ্ঞানী রবার্ট কখ। রবার্ট কখ জীবাণুর সংক্রমণে যে রোগ হতে পারে সেই প্রমাণ তো দেনই সঙ্গে সংক্রামক জীবাণু এবং রোগ বিষয়ে একটি প্রস্তাবণা দেন। এই প্রস্তাবণা কখস পস্টুলেট নামে পরিচিত। এই প্রস্তাবণা বলে, রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু রোগীর দেহ থেকে নিয়ে পরীক্ষাগারে কালচার (culture:চাষ) করা যায়। কালচার করা জীবাণু সুস্থ প্রাণির দেহে প্রবেশ করালে তা ওই একই রোগ সৃষ্টি করবে। ওই নতুন রোগীর শরীর থেকেও ওই একই জীবাণু কালচার করা যাবে!

মোদ্দা কথাটা হচ্ছে, কুদ্দুসের ফোঁড়া হয়ে থাকলে তার শরীরে ফোঁড়ার জীবাণু পাওয়া যাবে। কুদ্দুসের ফোঁড়ার জীবাণু গণেশের সুস্থ শরীরে প্রবেশ করালে গণেশেরও ফোঁড়া হবে।

– কোনো জীবাণুর জন্য রোগ হচ্ছে সেটা প্রমাণ করার জন্য কখস পস্টুলেট মেনে সেটার প্রমাণ দেয়া জরুরী। বলে রাখা ভালো, প্রাচীন কখস পস্টুলেট যথার্থ নয়। মূল ব্যপারটি ঠিক থাকলেও ব্যতিক্রম রয়েছে। ১৯৮৮ সালে স্ট্যানলি ফলকও মলিক্যুলার কখস পস্টুলেট প্রস্তাব করেন। সেটিই এখন পর্যন্ত গ্রহনযোগ্য।

———————————————————————————————

এবার ডুয়েসবার্গের গবেষণাপত্রটি নিয়ে কথা

এইডস কি মহামারী?

ডুয়েসবার্গ শুরু করেছেন ১৯৮৪ সালে প্রকাশিত গালো’র একটি গবেষণাপত্র এবং সেই বছরই নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত একটিপ্রবন্ধের কথা উল্লেখ করে। গালো’র গবেষণাপত্রটিতে বলা হয়েছিল, যেহেতু তাদের পরীক্ষিত বেশীরভাগ এইডস এবং ‘সম্ভাব্য এইডস’ রোগীর শরীরেই এইচটিএলভি-৩ (HTLV-III: Human T-lymphotropic Retrovirus type: III) ভাইরাসটি পাওয়া যাচ্ছে সুতরাং এই ভাইরাসটিই এইডস রোগের জন্য দায়ী সম্ভাব্য ভাইরাস। একই সময়ে ফরাসী ভাইরাসবিদ মন্তাগনিয়ের এলএভি ( LAV: lymphadenopathy-associated virus) নামক একটি ভাইরাস এইডসের জন্য দায়ী বলে দাবী করেন। নিউইয়র্ক টাইমসে লেখা হয়, গালো’র এইচটিএলভি-৩ ভাইরাস এবং মন্তাগনিয়ের-এর এলএভি ভাইরাস একই ভাইরাস হতে পারে বলে গবেষকরা ধারণা করেন! সেটা না হলে ব্যপারটা বেশ কেঁচে যায়!

পরবর্তীতে এইচটিএলভি-৩ এবং এলএভি ভাইরাস কে নাম দেয়া হয় এইচআইভি। যেটি এখন সব মহলে পরিচিত। এই নাম দেয়ার প্রকৃয়াটি কেমন ছিল এবং এই দুটি ভাইরাস আদতেই একশোভাগ একই ছিল কিনা সেটি আমার জানা নেই! ১৯৯৮ সালে মন্তাগনিয়ের এইচআইভি ভাইরাস আবিষ্কারের স্বীকৃতিস্বরুপ চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল পদক পান। গালো কেন এই পুরস্কারের অংশীদার হননি সেটিও একটি রহস্য!

ডুয়েসবার্গ শুরুতেই বলেন, গালো’র যে গবেষণাপত্রের সূত্র ধরে এইডসের চিকিৎসার জন্য এইচআইভির উপর বিস্তীর্ণ গবেষণা শুরু হয়! এবং তখনই ধারণা করা হয় এইডস আমেরিকাতে এবং বিশেষত আফ্রিকাতে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়বে। অথচ সেরকম দেখা যায়নি। সংক্রামক রোগের নিয়মটি হচ্ছে, সেটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে এবং যতদিন না সম্ভাব্য সকলেই এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাবে অথবা তাদের মধ্যে এই রোগের বিরুদ্ধে প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হবে ততদিন এই রোগটি ক্রমবর্ধমান (exponentially) হারে বাড়তেই থাকবে।

হিসেবটা এরকম, একটি সংক্রামক ব্যাধি (উদাহরণ স্বরূপ) ১ > ৫ > ২৫ > ১২৫ > ৬২৫ > ৩১২৫ > … এভাবে বাড়তেই থাকবে যতক্ষণ না সবাই অসুস্থ হয়ে মারা যাচ্ছে অথবা তাদের মধ্যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হচ্ছে। সাধারণ রোগগুলোর ক্ষেত্রে দেখা যায় একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সংক্রমণ বৃদ্ধি পেয়ে পরে ধীরে ধীরে কমে যায় এবং শেষে সংক্রমণের হার একটি সাম্যবস্থায় চলে আসে! [উদাহরণ স্বরূপ এরকম: ১ > ৫ > ২৫ > ১২৫ > ৬২৫ > ৩১২৫ > ২৯৮৭ > ১৯৮৭ > ৯৮৭ > ৮৭৬ > ৪৭৬ > ২৬৫ > ১০০ > ৫০ > ১০ > ১০ > ১০ ….]

ডুয়েসবার্গ বলেন, আমেরিকায় এইডস ১৯৮০ সাল থেকেই, গবেষকদের ধারনানুযায়ী ক্রমবর্ধিত হারে (exponentially) সংক্রামিত হয়নি বরং সংক্রমণের একটি সাম্যবস্থা বজায় রয়েছে! আমেরিকায় ১৯৮৪ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত (ক্রমবর্ধমান হারে/exponentially নয়) ধীরে ধীরে (Gradually) এইডস সংক্রামিত হয় এবং মৃত্যুহার বৃদ্ধি পায়। এরপর থেকে এই সংখ্যা কমতে শুরু করে এবং ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত কমতেই থাকে! ১৯৯৭’র পরে যখন এইডসের সংজ্ঞা মোটামুটি সর্বজনগ্রাহ্য হয়েছে এবং এইডস পরীক্ষারও একটি সাধারণ উপায় পাওয়া গেছেন তখন থেকে এইডস সংক্রমণের হারও দেখা গেছে স্থিতিশীল!

এইডস সংক্রমনের হারের উপর ১৯৮৮ সালে করা অ্যান্ডারসনের গাণিতিক হিসেব বলে যে, এই রোগটি উন্নয়নশীল বিশ্বের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ইতিবাচক সংখ্যা থেকে নেতিবাচক করে ফেলতে পারে মাত্র কয়েক দশকেই! ব্যপারটা এমন, কোনো দেশের জনসংখ্যা যা প্রতিবছর বৃদ্ধি পেত, এইডসের সংক্রমণে তা আর বৃদ্ধি না পেয়ে বরং প্রতিবছর কমতে থাকবে! ২০০০ সালে ৫ হাজারেরও বেশী গবেষকের স্বাক্ষর করা ডারবান ঘোষণানুযায়ী, পরবর্তী ৫ বছরে প্রায় আড়াইকোটি আফ্রিকানের মৃত্যু হওয়ার কথা এইডসের কারণে! কিন্তু তারপরও, যদিও পৃথিবীতে সেইসময়ে অন্তত ৩ কোটি লোক এইচআইভি ভাইরাসে সংক্রামিত ছিল, এইডসের কোনো মহামারী পৃথিবীর কোথাও এখনো দেখা যায়নি!

আফ্রিকাতে এইডস জনিত মৃত্যুর যে বিরাট সংখ্যা দাবী করা হয়, দেখা যায় সেই দাবী অগ্রহ্য করে আফ্রিকার জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার স্থিতিশীল! তাতে কোনো পতন নেই! এইডস জনিত মৃত্যুর যে সংখ্যা দাবী করা হয়, সেটা যাচাই করার জন্য ডুয়েসবার্গ তিনটি উৎসের তথ্য পর্যালোচনা করেছেন:

১। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং ইউএসএইডস: ১৯৯৭ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত এইচআইভি এইডস সনাক্ত হওয়া বিষয়ে কোনো পরিসংখ্যান নেই! খালি লেখ এঁকে রাখা হয়েছে (আশ্চর্যজনক?)! এই তথ্যের উপর ভিত্তি করেই ২০০৮ সালে হার্ভার্ডের গবেষক Chigwedere (সঠিক উচ্চারণ বুঝতে পারছি না) দক্ষিণ আফ্রিকায় এইডস মহামারীতে ২০০০ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত ১৮ লক্ষ লোকের মুত্যু হয়েছে বলে দাবী করেন!

২। দক্ষিণ আফ্রিকার এইডস জনিত মৃত্যুর পরিসংখ্যান: ২০০০ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত বছরে গড়ে ১০ হাজার। যা Chigwedere’র দাবী করা সংখ্যার মাত্র ৩০ ভাগের একভাগ! এমনকি এই যে ১০ হাজার মৃত্যুর হিসাব সেটাও এইডস-এর কারণে হয়েছে কিনা তা নিশ্চিত করা যায় না যেহেতু, যে ২৭ টি রোগ’কে এইডসের লক্ষণ হিসেবে ধরা হয় সেগুলোর কিছু কিছু দক্ষিন আফ্রিকায় মানুষের স্বাভাবিক মৃত্যুর প্রধান কারণ! এই রোগগুলোর মধ্যে রয়েছে, যক্ষা, নিউমোনিয়া এবং পাকস্থলীর সংক্রামক রোগ! এই জন্যে সাধারণ রোগগুলোকেই হয়তো অনেকক্ষেত্রে এইডস বলে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে শুধুমাত্র এই কারণে যে তাদের শরীরে এইচআইভি’র অ্যান্টিবডি পাওয়া গেছে!

৩। দক্ষিণ আফ্রিকার নতুন/অস্বাভাবিক কারণে মৃত্যুর শুমারী ২০০০ থেকে ২০০৫: দক্ষিণ আফ্রিকার জনসংখ্যা বৃদ্ধি এই সময়ে উল্লেখযোগ্য (৩০ লক্ষ)! জনসংখ্যা বৃদ্ধির এই হার অন্যান্য সময়ের তুলনায় স্বাভাবিক! এই সময়ে এইডস জনিত যে ১৮ লক্ষ মৃত্যুর হিসাব, সেটি বিবেচনা করলে জনসংখ্যা বৃদ্ধি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কম হওয়ার কথা ছিল!

পরিসংখ্যান বলছে, উগাণ্ডা এইডস মহামারীর মুল ক্ষেত্র! যদিও উগাণ্ডার জনসংখ্যা ১৯৮০ সালের পরে বেড়েছে প্রায় আড়াই গুণ! এই উগাণ্ডাতেই এইচআইভি আক্রান্ত লোকের সংখ্যা ১৯৮৯ সালে ৫.৮ ভাগ থেকে বেড়ে ১৯৯০ সালে হয় ১৩ ভাগ! যেটি আবার কমে ৫ ভাগে দাঁড়ায় ২০০৬ এ! আশ্চর্যজনক ভাবে এই ক্ষেত্রেও এইডস সনাক্তকরণের পরিসংখ্যান পাতাটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ওয়েব সাইটে ফাঁকা রয়েছে!

সাব-সাহারা আফ্রিকাতে ১৯৮০ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত জনসংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে! যদিও এইডসপক্ষীয় গবেষণাগুলো বলছে, এই দেশগুলোতে এইডস মহামারী হিসেবে দেখা দেয়ার কথা! ডুয়েসবার্গ দাবী করেন, যে মহামারীর কথা বলা হয়েছিল এবং যে ব্যপক মৃত্যুর কথা বলা হয় সেটি কখনোই আফ্রিকাতে অথবা বিশ্বের অন্য কোথাও ঘটেনি, ঘটছে না!

এইচআইভি কি তাহলে একটি প্যাসেঞ্জার ভাইরাস?

ডুয়েসবার্গ এইচআইভি ভাইরাসকে একটি প্যাসেঞ্জার ভাইরাস হিসেবে বিবেচনা করার প্রস্তাব রেখেছেন তার গবেষণাপত্রে। তাঁর যুক্তিগুলো এরকম:

  • এই ভাইরাসটি আফ্রিকায় ১৯৯০ সালে ৭% থেকে বেড়ে পরবর্তী ১০ বছরে ২৫-৩০% লোকের মাঝে সংক্রামিত হয়েছে। অথচ মৃত্যুহার বাড়ায়নি।
  • নতুন কোনো ভাইরাস যেটির সংক্রমণ ক্রমবর্ধমান হারে বৃদ্ধি পেতে থাকে তার ক্ষেত্রে সংক্রমণের এই হার নিতান্তই কম।
  • সম্প্রতি প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে যে, এইচআইভি মানুষের মধ্যে সংক্রামিত করেছে বিংশ শতাব্দির শুরুতেই!
  • সারা পৃথিবীতে ২০০০ সালে অন্তত ৩ কোটি মানুষ ছিল এইচআইভি দ্বারা সংক্রামিত যাদের (তখনও) এইডস হয়নি! সেক্ষেত্রে এইচআইভি এইডস রোগের জন্য দায়ী হতে পারেনা!
  • যেহেতু এইচআইভি সংক্রমণের পরেই শরীরে প্রাকৃতিক ভাবে অ্যান্টিবডি তৈরি হয় এবং সংক্রমণের পর এইডস হতে ৫-১০ বছর পর্যন্ত সময় লাগে সুতরাং এই ভাইরাসটি এইডস সৃষ্টির জন্য যথেষ্ট তা বলা যায়না!
  • যেহেতু, আমেরিকাতেই এইচআইভি সংক্রামিত মানুষের মৃত্যুর হার সেই ১৯৮৫ সাল থেকেই প্রায় স্বাভাবিক এবং সম্প্রতি দেখা গেছে যে এইচআইভি সংক্রামিত আমেরিকার সৈনিকদের অন্তত ৫ ভাগ কোনো চিকিৎসা না নেয়ার পরও তাদের পরবর্তী ২০ বছরের মধ্যেও এইডস হয়নি, সুতরাং এই ভাইরাসটি এইডসের জন্য দায়ী নয়!
  • যেহেতু, পরিচিত কিছু রোগ হলে যদি একই সঙ্গে এইচআইভি ভাইরাসটিও শরীরে পাওয়া যায় তাহলে তাকে এইডস বলা হচ্ছে! এবং এইচআইভি সংক্রামিত না হলেও মানুষের এই রোগগুলি হয়, সেহেতু এইচআইভি এইডসের জন্য দায়ী তা নিশ্চিত করে বলা যায়না!
  • এইডসের চিকিৎসার ক্ষতিকর দিকগুলো বিবেচনায় এটা যাচাই করে দেখার দরকার আছে যে, বর্তমানে এইডস নাকি এইডসের চিকিৎসায় মানুষ মারা যাচ্ছে!

ডুয়েসবার্গের এই হিসেবে এইচআইভি ভাইরাস এইডস রোগটির জন্য দায়ী সেটা প্রমাণিত বলা যায় না! ব্যপারটা অনেকটা এমন যে, লাল জামা পরলেই যে মানুষ গাড়ি চাপা পড়ে তা নয়! লাল জামা পরলেও মানুষ গাড়ি চাপা পড়তে পারে, না পরলেও পারে! তবে কেন মিছেমিছি লাল জামাকে গাড়িচাপা পড়ার কারণ বলা হবে!

ডুয়েসবার্গ বলছেন, এইডসের বর্তমান চিকিৎসা (ওষুধ) ক্ষতিকর। কারণ:

  • প্রাথমিক কারণটি সব ভাইরাসের চিকিৎসার জন্যেই প্রযোজ্য। ভাইরাসের নিজস্ব কোনো কোষ নেই। সে তার সমস্ত জৈবিক ক্রিয়ার জন্য সংক্রামিত করা কোষটির উপর নির্ভরশীল। যেহেতু জীবাণুরোধী মানেই জীবাণুর জৈবিক প্রক্রিয়ায় কোনোভাবে বাধা দেয়া সুতরাং ভাইরাসরোধী ওষুধ মাত্রই দেহের জন্য ক্ষতিকর! ধারনা করা হয় এই কারণেই প্রাকৃতিক ভাবে ভাইরাসরোধী কোনো পদার্থ/ওষুধ তৈরি হয়না! (ব্যাকটেরিয়ার ক্ষেত্রে যেমন অন্য ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক এবং উদ্ভিদের মধ্যে অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি হয়)! ভাইরাসের ক্ষেত্রে কেবল কোষীয় প্রতিরোধ তৈরি হতে পারে!
  • বৃদ্ধি পাওয়ার সময়ে এইচআইভি ভাইরাসের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হতে পারে এমন কোনো ওষুধ নেই কারণ পোষক শরীরের অ্যান্টিবডি ভাইরাসটির বৃদ্ধি থামিয়ে রাখে। এই কারণেই সাধারণত রোগীর শরীরে কোনো পূর্ণ এইচআইভি ভাইরাস পাওয়া যায়না! রোগীর কোষে এইচআইভি ভাইরাসের জিনটি আছে কিনা তা যাচাই করেই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়! এই যাচাই করার পদ্ধতিটিও এমন যে তা ওই ভাইরাসটির সত্যিকার কার্যকারিতা নির্ণয় করতে পারেনা!
  • আফ্রিকায় এইডসের চিকিৎসায় ব্যবহৃত একটি ওষুধ হচ্ছে অ্যাজিডোথাইমিডাইন (AZT) যেটি দীর্ঘকাল আগে থেকেই ক্যান্সারের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এটি কোষের জন্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিকর! এই ওষুধটির কার্যকারিতা পরীক্ষার সময় দেখা যায় কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই এটি ২৪% লোকের ক্ষেত্রে প্রাণনাশক রক্তশূন্যতা এবং ১৪% লোকের ক্ষেত্রে নিউট্রোপেনিয়ার (রক্তের একটি রোগপ্রতিরোধী কোষ কমে যাওয়া) সৃষ্টি করে! অন্য একটি গবেষণায় দেখা গেছে, এই ওষুধ রোগীর রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা দারুণভাবে কমিয়ে দেয়া যা ব্যাকটেরিয়া ঘটিত রোগ বাড়িয়ে দিতে পারে! দেখা যাচ্ছে, এইডসের লক্ষণ এবং এইডসের চিকিৎসার পার্শপ্রতিকৃয়া একই রকমের! পরীক্ষণের সময় সাধারণ AZT গ্রহনকারীদের মধ্যে প্রায় অর্ধেক, এবং কম মাত্রায় AZT গ্রহনকারীদের ৩ ভাগের ১ ভাগ লোক মাত্র ২১ মাসের মধ্যে মারা গেছে! (পূর্বের একটি পেপারে ডুয়েসবার্গ দাবী করেছেন, এরকম ভয়ঙ্কর ওষুধের ব্যবহারে লোক মরছে আর বলা হচ্ছে মৃত্যুর কারণ এইচআইভি)!
  • ১৯৯৪ সালে এইডস আক্রান্ত ১৭৪৯ লোকের উপর পরিচালিত একটি পরীক্ষায় দেখা গেছে AZT তাদের সুস্থ তো করেইনি! বরং মৃত্যুহার ২৫ ভাগ বাড়িয়ে দিয়েছে! সাম্প্রতিক পরীক্ষায় দেখা গেছে আমেরিকায় এইচআইভি সংক্রামিত অর্ধেক লোকের মৃত্যু হয়েছে এইডসের সঙ্গে সম্পর্কিত নয় এমন রোগে!
  • দুয়েকটি ক্ষেত্রে দেখা গেছে এইচআইভি সংক্রামিত নয় এমন লোক দূর্ঘটনাবশত এইডসের চিকিৎসা নেয়ায় তার মধ্যে এইডসের লক্ষণ প্রকাশ পেয়েছে! পরীক্ষাগারে প্রাণিদের মধ্যে পরীক্ষা করে দেখা গেছে, এইচআইভি বিরোধী ওষুধ তাদের মধ্যে এইডস এবং এইডস ছাড়াও অন্যান্য মারাত্মক রোগ এবং অন্যান্য শারীরিক সমস্যার জন্ম দেয়!

ডুয়েসবার্গ বলেন,

আমরা স্বীকার করছি যে, সাময়িকভাবে এইচআইভি বিরোধী ওষুধগুলো ক্যান্সার এবং কিছু আপাত নিরীহ রোগের ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে, কিন্তু এই ওষুধগুলো মারাত্মকভাবে ক্ষতিকর এবং এগুলো এইডসের লক্ষণ হিসেবে চিহ্নিত এবং চিহ্নিত নয় এমন রোগের জন্য দায়ী! সুতরাং এইচআইভি সংক্রামিত ব্যক্তিদের যাদের মধ্যে এইডসের লক্ষণ প্রকাশ পায়নি তাদের উপর এই চিকিৎসা প্রয়োগের আগে ভেবে দেখা দরকার!

আমাদের পরীক্ষণে দেখা যায়, কথিত এইচআইভি-এইডস মহামারীর কোনো অস্তিত্ব ছিলনা, নেই। এইচআইভি বিরোধী ওষুধগুলোর ক্ষতিকর দিক বিবেচনা করে, আমরা এইচআইভি ভাইরাসের সঙ্গে এইডস-এর সম্পর্কের ব্যাপারটি পুনরায় বিবেচনা করার দাবী করি। এবং এইচআইভি সংক্রামিত ব্যক্তিদের উপর এই ওষুধ ব্যবহারের ব্যাপারটিও বিবেচনা করতে বলি। আমরা মনে করি, যতক্ষণ না স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হচ্ছে যে, এইচআইভি ভাইরাসটির জন্যে এইডসের মতো প্রাণঘাতি কোনো রোগ হতে পারে ততক্ষণ, এইচআইভি বিরোধী ওষুধের ব্যবহার জীবন নয় বরং মানুষের মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করবে!

*** *** ***

এইচআইভি-এইডস বিরোধী ডুয়েসবার্গের এই গবেষণাপত্রটি সাম্প্রতিক। এর প্রভাব কতটুকু সেটি এখনো নিশ্চিত নয়। এইচআইভি এইডস সম্পর্ক অস্বীকারকারীদের প্রভাব সবচে বেশি দেখা গিয়েছিল ২০০০ সালে। সেই প্রভাব থেকে সাধারণ মানুষ এবং রাজনীতিকদের ফেরাতে সেই সময়ে এইডসের পক্ষের লোকেরা ৫ হাজারেরও বেশি গবেষক/স্কলারের স্বাক্ষর নিয়ে একটি প্রস্তাবণা তৈরি করেন। এটি ডারবান ঘোষনা হিসেবে পরিচিত। এখানে এইচআইভি এবং এইডসের সম্পর্ক কীভাবে প্রমাণ করা হয়েছে তা বলা হয়। বলা হয় এইডসের চিকিৎসার সুফলও। তীব্রভাবে প্রতিবাদ করা হয় যারা এইচআইভি এইডসের সম্পর্কের বিরোধিতা করছেন তাদের বক্তব্যের!
—————————————————————————————————-

ডারবান ঘোষণার মূল বক্তব্য

এইডস রোগটির জন্য যে এইচআইভি ভাইরাস দায়ী তা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত! এই প্রমাণ বিজ্ঞানের সর্বোচ্চ মান বজায় রেখেই করা হয়েছে। এই প্রমানের পেছনে যে তথ্য সেগুলো অন্যান্য ভাইরাস ঘটিত রোগ যেমন পোলিও, বসন্ত, মিজলস-এর ক্ষেত্রেও একই রকম। প্রমাণগুলো হলো:

  • সব এইডস আক্রান্ত রোগী এইচআইভি ভাইরাসটি দ্বারা সংক্রামিত।
  • চিকিৎসা করা না হলে এইচআইভি সংক্রামিত বেশিরভাগ লোকের ক্ষেত্রেই ৫-১০ বছরের মধ্যে এইডসের লক্ষণ প্রকাশ পায়। এইচআইভি’র সংক্রমণ নির্ণয় করা হয়েছে রক্তে অ্যান্টিবডি অথবা পূর্ণ ভাইরাসের উপস্থিতি অথবা কোষে ভাইরাসের জিনের উপস্থিতি থেকে। অন্যান্য ভাইরাসের সংক্রমণও একই পদ্ধতিতে নিশ্চিত করা হয়।
  • এইচআইভি সংক্রমিত রক্ত গ্রহনকারীদের এইডস হয়েছে।
  • এইডস আক্রান্ত লোকেদের শরীরের যে বিশেষ কোষ হ্রাস পায়, ল্যাবরেটরিতেও এইচআইভি একই কোষকে সংক্রামিত করে।
  • যেসব ওষুধ পরীক্ষাগারে এইচআইভি’র বৃদ্ধি থামিয়ে রাখে সেসব আক্রান্ত লোকেদের শরীরেও ভাইরাসের বৃদ্ধি থামিয়ে রাখে।
  • পরীক্ষাগারে বানরের শরীরে সংক্রামিত করা একই ধরনের ভাইরাস (SIV) এইডস সৃষ্টি করে।

—————————————————————————————————-
দুইপক্ষের বক্তব্য যদি আমি মেলাই তাহলে এরকম দাঁড়ায়:
এইডস পক্ষ: এইচআইভি থেকেই এইডস হয় তা প্রমাণিত।
বিপক্ষ: ওই প্রমাণ শক্ত না। এখন দেখা যাচ্ছে, এইচআইভি একটা নীরিহ ভাইরাস!
– এইডস মহামারী। লাখ লাখ লোক মেরে ফেলেছে। আরো ফেলবে।
– কই মারলো! তথ্য কোথায়! এতো লোক তো এমনিতেই মরে! জনসংখ্যা বৃদ্ধি তো সুস্থির!
– এইডসের চিকিৎসা দরকার। নাহলে লোক মরবে।
– মোটেই না। ওই ওষুধ বিষাক্ত। ওষুধে লোক মরছে আর তুমি দোষ দিচ্ছ ভাইরাসের! আর তাছাড়া তোমার চিকিৎসা তো এইডসের নয়, এইচআইভি’র! আগে দেখাও যে এটা এইডসের জন্য দায়ী!
– যেসব তথ্য আছে তা কি সব মিথ্যা?! কখ পস্টুলেট মেনে প্রমাণ পাওয়া গেছে!
– আর আমি যে তথ্য দিলাম সেগুলো?
– ফোঁস ফোঁস…
– গ্ররররর…

আমি আসলে অপেক্ষা করছি ডুয়েসবার্গের সাম্প্রতিক গবেষণাপত্রের যুক্তিগুলোকে তার বিরোধীরা কীভাবে খণ্ডন করে সেটা দেখার জন্য! তারপর হয়ত আরেকটা পোস্ট দেব! নাও দিতে পারি! আমার ইচ্ছা!

ঢাকা জার্নাল, ১৭ মার্চ, ২০১৩

তথ্যসূত্র: ইন্টারনেট।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.