রহস্যময় অজানা সমাধি

আগস্ট ৭, ২০১৫

অজানা সমাধিএস এম আববাস: দেখলে মনে হবে নবাব বাড়ি। বাইরে থেকে একরকম। আর ভেরতে আরেক। ছোট্ট ভবনটির ভেতরে ঢুকলেই সত্যিই রহস্যের জালে জড়িয়ে পড়বেন। আর রাত হলে তো কথাই নেই।

ভবনটির বাইরে থেকে দেখতে চারকোনাকৃতির। আর ভেতরে ঢুকেই দেখা যাবে আটকোনাকৃতির। মাঝখানে কবর। শুয়ে আছেন কোনো মহারাজা। তাই কোনো পীরের মাজার না হলেও অনেকটা সে মর্যাদায় পাচ্ছে আজও। তবে ভক্তির বাড়াবাড়ি নেই এখানে।

কবরটিকে ঘীরে নবাব বাড়ির মতো ছোট্ট এই স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে। সম্রাট শাজাহানের তাজমহলের মতো বিত্ত-বৈভব নেই এখানে, কিন্তু মায়া-সমতা ও গৌরবের এতটুকুও কমতি নেই। পিতা-মাতা বা কোনো পরম আত্মীয়ের মমতা দিয়ে কাকে যেনো শুইয়ে রাখা হয়েছে।

কথিত আছে নবাব শায়েস্তা খানের কোনো একটি মেয়ের কবর এটি। তবে নিশ্চিত নন কেউ, কে শুয়ে আছেন এই কবরে। আর রহস্য এখানেই।

২০১৪ সালের ৭ জুন বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে অজানা সমাধিটির রহস্যের স্বাদ নিতেই মোহাম্মদপুরে সাত মসজিদ রোডে বাঁশবাড়ি রোডে যাওয়া। মধ্যরাতেও যান চলাচল অনেকটাই বেশি। বাঁশবাড়ি রোডের চৌরাস্তায় যানযট রাত সাড়ে ১২টাতেও। যদিও এক সময় নিরব নিস্তব্ধতায় আচ্ছন্ন ছিল।

ঘড়ির কাঁটায় রাত পৌনে একটা। বাইরে কোলাহল থাকলেও তখন নিরব মাজরের ভেতরে এবং পূর্ব পাশে। ছোট্ট এ ভবনটির চারপাশে চারটি মূল ফটক। যদিও দক্ষিণের গেটটা ছাড়া তিনিটিই বন্ধ থাকে সব সময়। চারপাশ থেকেই ভেতরের কবর এবং ভবনের ভেতরের প্রায় পুরোটাই দেখা যায়। মধ্যরাতে একটি মোম জ্বলছিল কবরটির মাথার পশ্চিম পাশে। আলো আধাঁরিতে যতটুকু বোঝা যাচ্ছিল সাদাসালুতেই ঢাকা কবরটি। কবরের উত্তর-পূর্ব কোনে আরও দু’টি কবর রয়েছে। এর মধ্যে একটি খাদেম ইউসুপ শাহ-এর। আরেকটি তার স্ত্রী সোনাভানু বেগমের।

শান্ত পরিবেশ ভবনটি ছোট্ট আঙ্গিনায়। দিনে বা রাতে কোনো সময়ই গাঁজা খোরদের আড্ডা নেই। নেই ভক্তির বাড়াবাড়ি। তবে যত্নের ঘাটতি রয়েছে। পূর্ব পুরুষের খাদেমের দায়িত্ব পালন করার ধারাবাহিকতায় বর্তমানে খাদেমের দায়িত্বে রয়েছেন শাজাহান শাহ সাজু।

শাহজান শাহ সাজুর ভাগ্নে আমিত হাসান জানান, মামা দেখাশুনা করেন মাজারটির। পূর্ব পূরুষের ধারাবাহিকতায় তিনি বর্তমান খাদেম।

ভনটির আঙ্গিনার গেটে একটি সাইনবোর্ডে লেখা রয়েছে ‘অজানা সমাধি’। তাতে আরও লেখা রয়েছে, এই সমাধি ভবনটি খুব সম্ভবত সাত গম্বুজ সমজিদের একটি অচ্ছেদ্য স্থাপনা। স্থানীয়ভাবে পরিচালিত। লোককথা অনুযায়ী এর ভেতরে নবাব শায়েস্তা খানের কোনো এক কণ্যার মরদেহ সমাহিত রয়েছে। এ কবর কোঠাটির ভেতর দিক থেকে অষ্টকোনাকার এবং বাইরের দিক থেকে চতুষ্কোনাকার। কয়েক বছর আগে সম্পূর্ণ ধ্বংসপ্রাপ্ত পরিত্যক্ত অবস্থায় টিকে ছিল। যে ইমারতটি দেখা যায়, এটি একটি অতি উৎসাহী সাম্প্রতিক পূননির্মাণ কাজের ফলশ্রুতি।’

রাজধানীর মোহাম্মদপুরে সাত মসজিদের পূর্ব দিকে উঁচু জায়গায় ব্যস্ততম বাঁশবাড়ি রোডের ধারঘেঁষে পূর্ব পাশে কবর কোঠাটি নির্মিত হয়েছে ১৬৮০ শতকে। নবাব শায়েস্তা খাঁ সাত মসজিদ নির্মাণ করেন এই শতকে। কবর কোঠাটি মসজিদটির অবিচ্ছেদ্য স্থাপনা। মোগল শাসনের ধারাবাহিকতায় যে স্থাপত্যরীতি প্রচলিত ছিল তারই উজ্বল উদাহরণ ‘সাত গম্বুজ মসজিদ’। যদিও তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে নবাব শায়েস্তা খাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র বুজুর্গ উদ্দিন (উমিদ) খাঁ এই মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা। তবে এই মসজিদ আর করব কোঠা নবাব শায়েস্তা খাঁ হোক বা তার পুত্রই হোক, তাদেরই নির্মাণ। অন্য কোনো নবারের সময়ে নয়। বর্তমানে, মসজিদটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তত্বাবধানে আছে।

একটি সাইনবোর্ড ছাড়া তেমন কোনো যত্ন নেই ভনটির। তবে স্থানীয়ভাবে খাদেমের দেখভালে দারিদ্র্যতা থাকলেও আন্তরিকতার অভাব নেই। অন্যান্য কতিপয় মাজারের মতো ব্যবসা কেন্দ্র তৈরি করা হয়নি এটিকে। কবরটির রহস্যের জল্পনা-কল্পনাতেই ব্যবসা কেন্দ্র হয়নি বলে স্থানীয়দের মতামত।

স্থানীয়রা জানান, এক সময় কবরটির পশ্চিমের ঐতিহাসিক মসজিদটির পাশ দিয়ে বয়ে যেতো বুড়িগঙ্গা নদী। মসজিদের ঘাটেই ভেড়ানো হতো লঞ্চ ও নৌকা। কিন্তু বর্তমান অবস্থায় তা কল্পনা করাও অসম্ভব প্রায়। বড় দালানকোঠায় ভরে উঠেছে মসজিদের চারপাশ। কবরটির পাশ দিয়ে ব্যস্ততম রাজপথে রাতভর গাড়ি-ঘোড়া। সব ঠিকঠাক মতোই  চলছে। শুধু রহস্যে ঘোরা থেকে গেলো কবর কোঠাটি। ‘আজানা সমাধি’হিসেবেই রয়ে গেলো। ২০১৪ সালে রিপোর্টটি লিখেছে বাংলানিউজের রিপোর্টার এস এম আববাস।

ঢাকা জার্নাল,  আগস্ট ০৭, ২০১৫।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.